ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ছোট কাগজের হাতছানিতে বহেড়াতলায় ভিন্ন দৃশ্যপট

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ছোট কাগজের হাতছানিতে বহেড়াতলায় ভিন্ন দৃশ্যপট

মনোয়ার হোসেন ॥ সবাইকে টানে না লিটল ম্যাগাজিন। তাই বাংলা একাডেমির বহেড়াতলায় চোখে পড়ে না উপচেপড়া পাঠকের ভিড়। তবে এখানে দেখা মেলে অন্যরকম দৃশ্যপট। ছোট কাগজের হাতছানি দেয়া প্রতিবাদী চেতনার আবহটি ঠিকই ধরা দেয়। ছোট ছোট বাহারি নামের বই বিতানগুলোয় তরুণ লেখকদের সাহিত্যনির্ভর আড্ডার সঙ্গে চলে বইয়ের বিকিকিনি। এখানে সব রকমের পাঠকের সমাগম না ঘটলেও সাহিত্যের নতুন দিগন্তের সন্ধানীরা ঠিকই জড়ো হন। প্রচলিত সাহিত্যের বাইরে বিকল্প ধারার সাহিত্যের স্বাদ নিতে আসা এসব পাঠকের সংখ্যা বিপুল না হলেও স্বল্পতার মাঝেই মেলে মননের ঋদ্ধতা। যৌবন পেরিয়ে পরিপক্বতার দিকে ধাবিত হওয়া বইমেলায় এখন স্নিগ্ধ রূপ ছড়িয়েছে লিটল ম্যাগাজিন কর্নার। পরিণত হয়েছে ছোট কাগজে বড় স্বপ্ন আঁকিয়েদের প্রাণকেন্দ্রে। সোমবার বসন্ত বিকেলে বহেড়াতলায় কথা হয় ছোট কাগজের নিয়মিত পাঠক মৃদুলা মতিনের সঙ্গে। লিটল ম্যাগাজিন কেন পড়েন- এমন প্রশ্নের জবাবে এই উন্নয়নকর্মী ও আবৃত্তিশিল্পী বলেন, সাহিত্যের স্বাদটি গ্রহণের মাঝেও খুঁজি ভিন্নতা। খুব জনপ্রিয় নয় অথচ লেখাটি সৃষ্টিশীলÑ এমন তরুণ লেখকদের রচনাকে বেছে নেয়ার সুযোগ থাকে লিটল ম্যাগাজিনে। এছাড়া দেশের প্রান্তিক অঞ্চলে বসেও ভাল লিখছে সেসব নবীন লেখকদেরও চেনা যায়। এর বাইরে আমি সাহিত্য সমালোচনা পড়তে ভালবাসি। এখন সমালোচনার সেই পরিসরটি হয়ে পড়েছে সঙ্কুচিত। লিটলম্যাগে সহজেই পেয়ে যাচ্ছি সেই সমালোচনামূলক সাহিত্য। এছাড়া গ্রাম, নিসর্গ কিংবা বিশিষ্টজনদের নিয়ে নানারকম সংখ্যার হদিস মেলে এ ধারার কাগজে। এসব থেকে খুঁজে পাই নতুন ভাবনার খোরাক। একই বিষয়ে কথা হয় আলমগীর মাসুদ নামে ছোট কাগজের আরেক পাঠকের সঙ্গে। এই পাঠকের ভাষ্যমতে, ছোট কাগজের লেখকরা সাহিত্যের প্রতি যেমন নিবেদিত তেমনি প্রকাশকরাও ভালবাসা থেকে এ ধরনের কাগজ প্রকাশ করেন। সে কারণেই এ ধরনের পত্রিকায় ভাঙ্গা-গড়ার সঙ্গে সাহিত্যের নিরীক্ষার ছাপটি পাওয়া যায়। গতানুগতিক বা প্রথাগত সাহিত্যের বাইরে নতুন ধারা ও স্বতন্ত্র গতিপথের রচনার দেখা মেলে লিটলম্যাগে। বহেড়াতলায় পাঠকের আনাগোনা প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সাফি সমুদ্র বলেন, কখনই এখানে তুমূলভাবে পাঠকের ভিড় জমে না। তবে ছোট কাগজের প্রকৃত পাঠক যারা তাদের পদচারণায় এখন সরব হয়েছে এই প্রাঙ্গণ। খুব বেচাকেনা না হলেও চলছে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের জম্পেশ আড্ডা। আর এটাই হচ্ছে লিটলম্যাগ কর্নারের মূল বৈশিষ্ট্য। লোকসানের বোঝা বইতে গিয়ে এবারের গ্রন্থমেলায় বেশ কিছু ছোট কাগজের নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে পাল্টা যুক্তি তুলে ধরেন ছোট কাগজের মাধ্যমে আবির্ভূত হওয়া তরুণ ঔপন্যাসিক ইকবাল মাহমুদ। তিনি বলেন, কোন ছোট কাগজই লাভ করে না। মূলত সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা থেকেই এ ধরনের পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সেখানে মুনাফা করার বাজারি ভাবনার বদলে স্বতন্ত্র চরিত্রটাই থাকে মূল বৈশিষ্ট্য। তাই সব সময় ছোট পত্রিকার নতুন সংখ্যার প্রকাশনা অব্যাহত থাকবেÑ এমনটা আশা করা বাহুল্য। এবারের বইমেলায় ৯০টি ছোট কাগজের সমাবেশ ঘটেছে বহেড়াতলায়। বিশাল বৃক্ষটিকে ঘিরে নান্দনিক সাজের প্রতিটি স্টলের নামকরণের মধ্যেও রয়েছে সৌন্দর্যবোধের পরিচয়। মনছোঁয়া এমন কয়েকটি স্টলের নাম হলোÑ বেহুলা বাংলা, রোদ্দুর, চিরকুট, কুঁড়েঘর, সাম্প্রতিক, মেঘফুল, কবিতাপত্র, প্রান্তস্বর, শব্দগুচ্ছ, লোক, শাহবাগ, নিসর্গ, অর্বাক, চর্যাপদ, কালের ধ্বনি, মত ও পথ, চালচিত্র, গল্পকথা, খেয়া, চৈতন্য, দাঁড়কাক, শালুক, সুন্দরম, সপ্তবর্ণ, শিরদাঁড়া, নতুন দিগন্ত, জংশন, তৃতীয় চোখ, চারবাক, জলছবি বাতায়ন, অনুরণন, কোরাস, প্রতিকথা, স্বপ্ন ’৭১’, হাতেখড়ি, পান্থজনের সখা, তুষারধারা, মানুষ, সরলরেখা, চারকোল, ম্যাজিক লণ্ঠন, ঘাসফুল, আড্ডাপত্র, পড়শি, অনুপ্রাণন ও ল্যাম্পপোস্ট। চলছে বই কেনার সুসময় ॥ সোমবার পেরিয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২২তম দিন। মেলা শেষ হতেও বাকি মাত্র অল্প ক’টা দিন। তাই এখন দেখার চেয়ে বই কেনার চিত্রটাই বেশি চোখে পড়ছে মেলায়। বয়ে যাচ্ছে পছন্দের বইটি সংগ্রহের সুসময়। ২২তম দিনের বসন্ত বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেই দৃশ্যের দেখা মেলে। প্রতিটি স্টলেই পাঠক সমাগমের পাশাপাশি বিকিকিনিও হয়েছে ভাল। এখানে কথা হয় আদাবরের বাসিন্দা রেজওয়ানা আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, এর আগে দু’দিন মেলায় এসেছি। তখন পুরো মেলা ঘুরে দেখলেও বই কেনা হয়নি। একুশে ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে যাওয়ার পর তুলনামূলকভাবে এখন মেলায় ভিড়ভাট্টা কম। তাই পছন্দ করে বইটি কেনার সুযোগ থাকে। এই পাঠকের কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় অবসর প্রকাশনীর বিপণন ব্যবস্থাপক মাসুদ রানার কণ্ঠে। তিনি বলেন, এখন আর কেউ মেলায় ঘুরে বেড়াতে আসছেন না, যারা আসছেন তারা বই নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। ফলে বেচাকেনাটাও ভাল হচ্ছে। মোড়ক উন্মোচন ॥ ভাষাচিত্র থেকে প্রকাশিত সাংবাদিক ওমর ফারুকের লেখা ‘ছোট সাহেবের ফাঁসি’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ। মীরা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত রায়হান আহমেদের ‘হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেছেন দেশের প্রথম এভারেস্টজয়ী মুসা ইব্রাহীম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন লেখক গবেষক খালেক বিন জয়েনউদ্দিন, গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়েজী প্রমুখ। নতুন বই ॥ বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী সোমবার মেলায় এসেছে ৬৪টি নতুন বই। এর মধ্যে গল্প ৪, উপন্যাস ১১, প্রবন্ধ ২, কবিতা ২৭, গবেষণা ১, ছড়া ২, শিশুতোষ ৩, রচনাবলী ১, মুক্তিযুদ্ধ ২, ভ্রমণ ২, রাজনীতি ৩, অনুবাদ ২ ও অন্যান্য ৪। এছাড়া এদিন পর্যন্ত বাংলা একাডেমির নিজস্ব স্টলে মোট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৭ লাখ ১৫ হাজার ৭৭১ টাকা। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যেÑ কথাপ্রকাশ থেকে এসেছে যতীন সরকারের ‘সাঁকো বাঁধার প্রত্যয়’, অবসর থেকে শিশির কুমার ভট্টাচার্য্যরে ‘ব্ল্যাকহোল’, অন্যপ্রকাশ থেকে মোশতাক আহমেদের ‘লিলির ভালোবাসা’, সময় থেকে আলম তালুকদারের ‘ষোল কোটি ভোর’, কালিকলম প্রকাশনী এনেছে ড. তারেক শামসুর রেহমানের ‘যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি’, অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদের ‘জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষণ’, কথা প্রকাশ এনেছে খন্দকার মাহমুদুল হাসানের ‘সুন্দরবনের গল্প’, এ্যাডর্ন পাবলিকেশন্স এনেছে এবিএম নুরুল হকের ‘বজ্রকণ্ঠ ও স্বাধীনতা : বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের’, পারিজাত প্রকাশনী এনেছে আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরীর ‘ডানপিটে শওকত’, অনন্যা এনেছে ডাঃ সজল আশফাকের ‘সুস্বাস্থ্যেও সাত সতের’, জয়তী এনেছে কাফি কামালের ‘আত্মীয়তার বন্ধনে রাজনীতি’, আগামী এনেছে রোকসানা মালেকের ‘উপকণ্ঠের মানুষ’। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ সোমবার বিকেলে গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘শাহ্ আবদুল করিম জন্মশতবার্ষিকী’ শীর্ষক আলোচনা সভা। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক আবুল হাসান চৌধুরী। আলোচনায় অংশ নেন ড. ভীষ্মদেব চৌধুরী, শরদিন্দু ভট্টাচার্য ও সাইমন জাকারিয়া। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ড. আবুল আহসান চৌধুরী। প্রাবন্ধিক বলেন, শাহ্ আবদুল করিমের জন্মশতবর্ষ অতিক্রান্তির এ শুভলগ্ন থেকেই তার জীবনকথা ও কীর্তি নিয়ে, নির্দয় নিয়তি আর ঘোরতর বৈষম্যমূলক সমাজসৃষ্ট দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত তার জীবনসংগ্রাম নিয়ে, তার সঙ্গীতমালার বিধৃত বাঙালীর লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান বিশেষত বহু জাতি-বর্ণ-ধর্ম সমন্বিত ইহবাদী জীবনচেতনা এবং মরমি দর্শন নিয়ে আরও ব্যাপক ও গভীর বিশেষণাত্মক কাজ হওয়া দরকার। তবেই এক মানবপন্থী সংস্কৃতিসাধক হিসেবে বাউল শাহ আবদুল করিমের যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে বলে মনে করি। আলোচকবৃন্দ বলেন, এ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ লোককবি শাহ আবদুল করিম। প্রচলিত লোকবাংলার সুর নিয়েই তিনি এক ধরনের ‘করিমী’ সুর সৃষ্টি করেছেন। তার বাউল গানে আছে মুর্শিদের কথা। তিনি আমাদের জন্য রচনা করেছেন সুফিধারার প্রেমের গান। ‘মানবগাছ’, ‘মানবতরী’ ইত্যাদি শব্দবন্ধের মধ্য দিয়ে করিম তার গানে এক অন্যরকম ব্যঞ্জনা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছেন। সভাপতির বক্তব্যে আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, শাহ্ আবদুল করিম কখনও চারণ কবি, কখনও লোক কবি, কখনও বা বাউল কবি। এই মরমি সাধক আমাদের বাউল গানকে যে মাত্রা দিয়েছেন, তা তাকে আমাদের মাঝে স্মরণীয় করে রাখবে। বাংলা একাডেমি তার জন্মশতবর্ষকে কেন্দ্র করে তার গান ও জীবন নিয়ে একটি আলাদা অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারে, যে আয়োজনে উঠে আসবে বাউল আবদুল করিমের জীবন ও সাধনার সামগ্রিক প্রেক্ষাপট। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেয় সাকার মুস্তাফার পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ভাবনগর ফাউন্ডেশন এবং সালাউদ্দীন বাদলের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন- স্বপ্না রায়, আবু বকর সিদ্দিক, সালমা চৌধুরী, শতাব্দী রায়, মেহেরুন আশরাফ, লাকী সরকার ও খোকন বাউল। আজকের আয়োজন ॥ আজ মঙ্গলবার গ্রন্থমেলার ২৩তম দিনে বিকেল ৪টায় মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘মোহাম্মদ নাসির আলী জন্মশতবার্ষিকী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন কবি আসাদ চৌধুরী, শিশুসাহিত্যিক লুৎফর রহমান রিটন এবং শিশুসাহিত্যিক কাইজার চৌধুরী। সভাপতিত্ব করবেন লেখক গবেষক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ।
×