ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পোলিশ নাগরিকসহ সিটি ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক, রিমান্ডে;###;আগেই পালিয়েছে অপর দুই বিদেশী;###;তদন্তে নেমেছে সিটি ব্যাংক, সিইও বললেন প্রমাণ মিললে কঠোর ব্যবস্থা

চক্রে জড়িত বিদেশী ॥ এটিএম বুথে জালিয়াতি

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

চক্রে জড়িত বিদেশী ॥ এটিএম বুথে জালিয়াতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এটিএম বুথে জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা তুলে নেয়ার বহুল আলোচিত ঘটনায় এক বিদেশীসহ সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়েছে। তিন ব্যাংক কর্মকর্তাকে ছয় দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। বুথে থাকা সিসি ক্যামেরার ছবি দেখে ওই বিদেশীকে গ্রেফতার করা হয়। সাইবার জালিয়াতি বিষয়ক মামলায় এই প্রথমবারের মতো কোন বিদেশীকে শনাক্ত ও পরে গ্রেফতার করল পুলিশ। এদিকে সিটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের তিন কর্মকর্তা গ্রেফতারের ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তদন্তে আটক তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে সিটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) এক গ্রাহকের এ্যাকাউন্ট থেকে অন্য ব্যাংকের এটিএম বুথ ব্যবহার করে কৌশলে টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটে। আরও অন্তত ২১ গ্রাহকের এ্যাকাউন্ট থেকে একই ভাবে আনুমানিক ১০ লাখ টাকা তুলে নেয়া হয়। এ ঘটনায় বনানী থানায় একটি মামলা করা হয় ব্যাংকের তরফ থেকে। এছাড়া গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) রাজধানীর বনানী মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) একটি বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে গ্রাহকের এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করা হয়েছে। এর পর সেই তথ্য মোতাবেক এটিএম কার্ড বানানো হয়। আর সেই কার্ডে বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটে। ডিভাইসটি বসানোর সময় এটিএম বুথে থাকা সিসি ক্যামেরায় ওই বিদেশীর ছবি রেকর্ড হয়ে থাকে। মামলার সঙ্গে সেই ভিডিও ছবিটিও জমা দেয়া হয়। দুই মামলারই তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্ত সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ইউসিবিএল ছাড়াও ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ও সিটি ব্যাংকের ছয়টি বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে তথ্য চুরির প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই যন্ত্র বসানো অবস্থায় বুথগুলোতে ১২শ’ কার্ডের লেনদেন হয়েছে। আর এ পর্যন্ত ৪০ কার্ড ক্লোন করে গ্রাহকদের প্রায় ২০ লাখ টাকা তুলে নেয়ার তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, তদন্তে স্কিমিং ডিভাইস বসানোর সিস্টেমটি পরবর্তীতে জানা যায়। প্রতিটি এটিএম বুথেই এটিএম কার্ড প্রবেশ করানোর একটি নির্ধারিত জায়গা থাকে। জায়গাটি অপেক্ষাকৃত ফাঁকা। সেই ফাঁক দিয়ে অনায়াসে দুটি এটিএম কার্ড একত্রে বুথে প্রবেশ করানো সম্ভব। এই সুযোগটিই কাজে লাগায় চক্রটি। তারা টার্গেট বুথে টাকা তোলার কথা বলে ঢোকে। এর পর তারা একটি পাতলা স্কিমিং ডিভাইস এটিএম কার্ড প্রবেশ করানোর জায়গায় বসিয়ে রাখে। এতে যখনই কোন এটিএম কার্ড বুথে প্রবেশ করানো হয়, স্বাভাবিক কারণেই তা স্কিমিং ডিভাইসের ওপর দিয়ে বুথে প্রবেশ করে। ঢোকার সময়ই স্কিমিং ডিভাইসটি এটিএম কার্ডের সমস্ত তথ্য কপি করে নিয়ে যায়। বেশ কয়েকদিন পর ওই স্কিমিং ডিভাইসটি বের করে আনে। এরপর স্কিমিং ডিভাইসের তথ্য মোতাবেক এটিএম কার্ড তৈরি করা হয়। আর সেই কার্ড দিয়ে অনায়াসে এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলা যায়। এভাবেই তারা বিভিন্ন এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নিচ্ছিল। তদন্ত সূত্র বলছে, তদন্তের ধারাবাহিকতায় এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে প্রথমে পাঁচ বিদেশীকে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। এর পর নিশ্চিত হয়ে রবিবার সন্ধ্যায় গুলশান থেকে গ্রেফতার করা হয় পোল্যান্ডের নাগরিক পিটার স্কেজেফান মাজুরেককে (৫০)। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে পিটার পুরো চক্র সম্পর্কে তথ্য দেন। পিটারের দেয়া তথ্যমতে গ্রেফতার করা হয় মোকসেদ আলী মাকসুদ, রেজাউল করিম শাহীন ও রেফাত আহমেদ রনিকে। এ তিনজনই বেসরকারী সিটি ব্যাংকের আইটি শাখার কর্মকর্তা। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এবং কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান (ডিআইজি) মনিরুল ইসলাম জানান, আটক বিদেশী পিটার স্কেজেফান মাজুরেক পোল্যান্ডের একটি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। সে অনুযায়ী তিনি পোল্যান্ডের নাগরিক হওয়ার কথা। তবে তার জন্ম ইউক্রেনে। তার পাসপোর্টটিও ভুয়া। কারণ তিনি পিটার টমসন নামে একজনের পাসপোর্ট চুরি করে সেই অনুযায়ী পাসপোর্ট করেন। এছাড়া তার কাছে জার্মান নাগরিকত্বের একটি পরিচয়পত্রও পাওয়া গেছে। যদিও জার্মান নাগরিকের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বিষয়গুলো ভালভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিদেশীর জবানবন্দীর বরাত দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, এটিএম জালিয়াতির ঘটনার পরিকল্পনায় লন্ডন প্রবাসী এক বাংলাদেশী, এক বুলগেরিয়ান এবং ইউক্রেনের এক নাগরিক ছিলেন। গত বছর বিজনেস ভিসায় গ্রেফতারকৃত বিদেশী বাংলাদেশে আসেন। বসবাস শুরু করেন হোটেলে। সেই হোটেলেই পরিচয় হয় গ্রেফতারকৃত সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তার সঙ্গে। বাংলাদেশে আদম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন গ্রেফতারকৃত বিদেশী। এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনাটি অনেক গড়িয়েছে বুঝতে পেরে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রবাসী এবং অপর দুই বিদেশী আগেই পালিয়ে যায়। মনিরুল ইসলাম বলেন, পিটার আন্তর্জাতিক অপরাধে জড়িত। তার বিশাল অপরাধ চক্রের নেটওয়ার্ক রয়েছে। চক্রটি পূর্ব ইউরোপের রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, ইউক্রেনেও কাজ করে। এছাড়া পোল্যান্ডভিত্তিক এই অপরাধ চক্রটি এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও তৎপর রয়েছে। পুরো চক্রটির সঙ্গে আরও কোন ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত আছে কি-না সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশী ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তা থাকায় বিদেশী চক্রটি ব্যাংক জালিয়াতির জন্য বাংলাদেশকে বেছে নেয়। পাশাপাশি বিদেশীরা বাংলাদেশের প্রযুক্তি দুর্বল ভেবে এমন তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছিল। এদিকে এটিএমে জালিয়াতি করে গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে আটক তিন ব্যাংক কর্মকর্তার বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে সিটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, তদন্তে তিনজনের দোষ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। জানা গেছে, গ্রেফতারকৃত সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা মার্চেন্ট এ্যাকোয়ার্ড জোনের পয়েন্ট অব সেল (পস) লেনদেন বিষয়ক কাজের দায়িত্বে ছিলেন। গ্রেফতারকৃত সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তার বিষয়ে ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সোহেল আর কে হোসাইন জানান, তাদের তিন কর্মকর্তা গ্রেফতারের বিষয়টি ডিবি পুলিশ জানিয়েছে। তবে কী অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানায়নি। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে গ্রেফতারকৃত সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি তাদের পেছনে কারা আছে তাদেরও খুঁজে বের করা হবে। এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে ব্যাংকের তরফ থেকে। তাদের চার কাস্টমারের খোয়া যাওয়া টাকা ছোট হলেও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গেই দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
×