ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

শিক্ষা আবাসনে অবহেলায় শিক্ষার্থী মৃত্যুর দায় কার?

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

শিক্ষা আবাসনে অবহেলায় শিক্ষার্থী মৃত্যুর দায় কার?

এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে চিনতে পারছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু যে ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল তা নয়। ’৬৯, ’৭০, ’৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধিকার ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে ১১ দফা, ৬ দফা প্রচার, নতুন জাতীয় পতাকা তৈরি এবং বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট গঠনে, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে যে ধারাবাহিক অবদান রেখে গিয়েছে সেসবের পাশে এমন নির্দয়, উদাসীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মেলাতে পারছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য বহন করে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সুদিনে-দুর্দিনে বজায় ছিল- সেটি এভাবে দুমড়ে-মুচড়ে যেতে পারে, তা ছিল সবার কল্পনার বাইরে। প্রশ্ন জাগছে- ১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পর বছর উচ্চশিক্ষা গ্রহণরত প্রায় দু’শয়ের মতো শিক্ষার্থী একটি হলের বারান্দায় বাস করে কেন? ২. এ ব্যবস্থা তাৎক্ষণিক হতে পারে, দু’তিন মাসের জন্য, তারপর অবশ্যই সব ছাত্রের কক্ষ লাভ করার ব্যবস্থা করতে প্রশাসন দায়িত্ববদ্ধ নয় কি? ৩. যদি দু’তিন মাসও কোন ছাত্রকে সাময়িকভাবে বারান্দায় ঘুমানো, পড়াশোনাসহ যাবতীয় কাজ করতে হয়, তাহলে উপাচার্য, প্রভোস্ট, হাউস টিউটর, প্রক্টর, প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ সবার ওই হলের পাশে নতুন ভবন নির্মাণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কি পারতেন না? অথবা হলটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় এটিকে বহুতল ভবন হিসেবে নির্মাণ করা হলো না কেন? দুই বছরে একটি ভবনের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব এবং ওই সময়ে ছাত্রদের বসবাসের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে কয়েকটি বাড়ি ভাড়া নেয়া যেতে পারত, তাই নয় কি? ৪. সরকারের কাছে এ বাড়ি নির্মাণের ব্যয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ চাইলে সরকার অবশ্যই করত। কেননা প্রধানমন্ত্রী শিক্ষায়, বিশেষত দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বাধাবিঘœ দূর করতে সব সময় আন্তরিক। এ ছাড়াও আবেদন করলে বিভিন্ন ব্যাংক তাদের সামাজিক দায়িত্ব খাত থেকে অর্থ বরাদ্দ দেবে বলেও মনে করি। এ উদ্যোগগুলো কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছে কি? ৫. যে কোন শিক্ষার্থীর মৃত্যু আমাদের জন্য বিপুল ক্ষতিকর। সে ক্ষেত্রে একজন দরিদ্র বাবা-মার একমাত্র পুত্রটি শুধু কঠোর অধ্যবসায় ও মেধাবী হওয়ার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরে পরিবার, বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশী, গ্রামবাসীকে গৌরবান্বিত করেও সাধারণ একটি চিকিৎসাযোগ্য ঠা-াজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে শিক্ষার প্রথম বর্ষেই প্রাণ হারাল কেন? ৬. প্রশ্ন হচ্ছে- শিক্ষার্থীরা কি পরিবেশে থাকে তা মাঝে-মধ্যেই দেখার দায়িত্ব প্রভোস্ট, হাউস টিউটরের এবং উপাচার্য অন্তত ৬ মাসে বা বছরে একবারও কি শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়ার মান দেখবেন না? শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হলে প্রথমে মেডিক্যাল সেন্টারে যায়, বন্ধুরা নিয়ে যায়, প্রভোস্ট, হাউস টিউটরকে অবহিত করা হয়, সেরকম কঠিন রোগ হলে মেডিক্যাল সেন্টার থেকে মেডিক্যাল কলেজে রেফার করার নিয়ম আছে। দরিদ্রের এই সন্তানটিকে বারান্দার ঠা-া মেঝেতে থেকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে দেখে মেডিক্যাল কলেজে রেফার করা হয়েছিল কি? বিগত ৫-৬ বছরে দেশে নিউমোনিয়ার ভাল উন্নত চিকিৎসা এসেছে। অন্তত নেবুলাইজার ব্যবহার, ইন্ট্রাভেনাস আধুনিক ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে উন্নত ওষুধ দেয়া হলে রোগী ৫-৬ দিনেই রোগমুক্ত হয়ে যায়। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এই ২০১৬ সালে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুবরণ করে শুধু যে তার পরিবারকে অকূল পাথারে ভাসিয়ে দিয়েছে তাই নয়, বরং তার মৃত্যু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ সব ছাত্র-শিক্ষক-প্রশাসককে কর্তব্যবোধের ব্যাপারে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। যারা নিজেদের মান এবং বেতন ইত্যাদি সুবিধা বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করেন, তাঁদের ছাত্ররা কি অবস্থায় আছে, তা জানবেন না, নজর দেবেন না- এ কিভাবে হতে পারে? এ তো গ্রহণযোগ্য কোনভাবেই হতে পারে না। ৭. রুগ্ণ, জ্বরাক্রান্ত ছাত্রটিকে কারা বাইরে কুয়াশা ও ঠা-ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, বোঝা গেল এই নির্দয় তরুণরা মানুষ হয়নি, তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে কি? ৮. রুগ্্ণ ছাত্রটির বিভাগের শিক্ষক, সহপাঠীরা কি একটু ওর খেয়াল রাখেনি? প্রথম বর্ষে সে ও অন্যরা নতুন ছাত্র, তবুও নতুনদের মধ্যে তো সবাই সহপাঠী। শুরুতেই তো পরিচয়, ভাব, বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয়, তেমন হলো না কেন? কেন দরিদ্র মানুষের সন্তানটি দেশের সবচাইতে খ্যাতিমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েও সুচিকিৎসা লাভ করল না? কেন তাকে ঢাকার উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়ে মফস্বলের ভালমানের চিকিৎসাসেবাহীন গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে হয়েছিল? কারা তাকে চরম অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা থেকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিল? হয়ত তাকে কেউই সঠিক স্থানে চিকিৎসার জন্য পাঠায়নি। সেজন্য সে নিজে মা-বাবার কাছে চলে গিয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠা-া মেঝে ও বারান্দার কনকনে শীত থেকে নিউমোনিয়া রোগ নিয়ে একেবারেই মাটির ঠা-া কবরে ঠাঁই নিতে বাধ্য হলো। এমন মর্মবিদারক ঘটনা কেন ঘটবে? নিজেকেও দোষী মনে হচ্ছে, কারণ বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। আমাদের ছোট্ট একটি গবেষণা অফিসের পিওনের কাজে থাকা ছেলেটি শীতের সময় প্রায়ই ঘনঘন কাশিতে ভুগত। একদিন দেখলাম তার নিউমোনিয়ার মতোই হয়েছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দেখে বললাম, ‘তুমি বিকেল চারটায় আসবে, আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব’। বিকেলে ওকে স্কয়ারের চেস্ট বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে বলেছি- ‘ডাক্তার সাহেব, আমার ছেলেটাকে আজই সুস্থ করে দিতে হবে।’ ডাক্তার একটু তাকিয়ে বললেন, ‘ঘণ্টা চারেকের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।’ সব রোগীকে অপেক্ষা করতে বলে উনি আমাদের ইমারজেন্সিতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা শুরু করলেন। আমি ফরম পূরণ ও আনুষঙ্গিক কাজ করলাম। ইঞ্জেকশন দিলেন, নেবুলাইজ করা হলো, ইনহেলার লিখে দিলেন। সত্যি সত্যি চার ঘণ্টা পর ছেলেটিকে নিয়ে ওকে ওর বাড়িতে নামিয়ে রাতে বাড়ি ফিরে এসে মনে একটি শান্তি পেয়েছিলাম, যা আর কখনও পেয়েছি বলে মনে হয় না। ও এখন অন্যত্র কাজ করে। ভাল থাকার উপায়টি জেনেছে, সেটি অনুসরণ করে চলে। এখন তো নিউমোনিয়া না হওয়ার জন্য বার্ষিক, ছয় মাসিক ইঞ্জেকশন আছে। এগুলো নিয়ে শিশু ছাড়া বেশিরভাগ বয়স্ক রোগী সুস্থই আছেন। তাহলে এই দেশ গড়ার মেধাবী তরুণকে নিউমোনিয়ার সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে কেন জীবন দিতে হলো? বেচারা ছেলেটা উদাসীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-প্রশাসক-সহপাঠীদের মনোযোগ লাভে ব্যর্থ হয়েছে কেন? সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায়ই আমরা ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমজীবী, নারী, শিশু-পুরুষদের অসময়ে, সম্পূর্ণ অকারণে হারাচ্ছি, যার সংখ্যা বর্তমানে ভয়াবহ রকমের বেশি। এই সেদিন দক্ষ চালক-চিকিৎসকের মৃত্যু হলো সপরিবারে অদক্ষ ট্রাক চালকের প্রাইভেট গাড়িকে গুঁড়িয়ে দেয়ার কারণে। অসময়ে মৃত্যুর সংখ্যা যেভাবেই হোক কমিয়ে আনতে হবে। আশা করব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের বারান্দায় কোন ছাত্রকে আর থাকতে হবে না অথবা বারান্দাটি দেয়াল তুলে আপাতত ঘিরে দিতে হবে এবং ছাত্রদের প্রত্যেককে শক্ত ফোমের সিঙ্গল বেডের সমান টুকরো দিয়ে তার ওপর শোবার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে খুব বেশি অর্থ ব্যয় হবে না। এটি স্থায়ী বাড়ি নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত ছাত্রদের ঠা-ার হাত থেকে রক্ষা করবে। ডিয়ার ঢাকা ভার্সিটি, আর ইউ লিসেনিং?
×