ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

বহুমাত্রিক পরিবেশনায় ভাষা শহীদদের স্মরণ

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বহুমাত্রিক পরিবেশনায় ভাষা শহীদদের স্মরণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আমার এমন মধুর বাঙলা ভাষা/ভায়ের বোনের আদর মাখা/মায়ের বুকের ভালোবাসা ...। এভাবেই কবিতার আশ্রয়ে মাতৃভাষার প্রতি মমত্ব প্রকাশ করেছিলেন কবি জসীম উদ্্দীন। সেই মমত্ববোধের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে গড়া বাঙালীর রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সংগ্রাম ও আন্দোলনের ইতিহাসে দারুণভাবে সমৃদ্ধ এই দেশ। রবিবার ছিল এ রাষ্ট্রের কৃষ্টিলালিত সংগ্রামী ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ একদিন। বাংলা বর্ণমালার জন্য প্রাণ বিসর্জনকারী বাংলা মায়ের দামাল ছেলের রক্তস্নাত অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। একইসঙ্গে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আর ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঝরানো দিনটিতে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয়েছে ভাষাশহীদদের। নানা আয়োজনে বহুমাত্রিক পরিবেশনায় স্নিগ্ধ রূপ বিরাজ করেছে রাজধানী সংস্কৃতি অঙ্গনজুড়ে। রকমারি পরিবেশনায় ভালবাসা জানানো হয়েছে বর্ণমালার সেই শহীদদের। প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায়ও ছিল নানা আয়োজন। গানের সুরে, কবিতার ছন্দে, নৃত্যের প্রকাশে কিংবা বক্তার কথা অথবা নৃত্যশিল্পীর নাচের মুদ্রায় ছিল ভাষাসৈনিকদের বন্দনা। এসব পরিবেশনায় উঠে এসেছে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা। শহীদ মিনারে নানা ভাষার গান-কবিতা : ফাগুনের রংমাখা বসন্ত বিকেলে আয়োজনটি অনুষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। ব্যতিক্রমী এ আয়োজনে ছিল বাংলার সঙ্গে বিদেশী ভাষার গান ও কবিতার পরিবেশনা। নানান দেশের নানা ভাষার বৈচিত্র্যময় সুর ও কবিতার ছন্দোময়তায় আলোড়িত হয় স্মৃতির মিনার। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উপলক্ষে পাঁচ বছরের ধারাবাহিকতায় বিদেশীদের নিয়ে ভাষার গান ও কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে শিল্পকলা একাডেমি। শহীদ মিনারের বিপরীত প্রান্তের গগন শিরীষে বৃক্ষতলটি অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ। ভিনদেশীদের মুখে গান ছাড়াও বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন শিল্পী এই আয়োজনের অংশ নেন। এবারের আয়োজনে বিশেষ দিক ছিল ঢাকা সাংস্কৃতিক দলের ১০ জন শিল্পীর দলগত পরিবেশনায় ১২টি দেশের গান। ২০ মিনিটের এই পরিবেশনায় শিল্পীরা গেয়ে শোনান ভুটান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, চীন, জাপান, আরব, নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, রাশিয়া ও মালদ্বীপের গান। দলগত পরিবেশনার সমাপ্তি হয় বিশ্বের সকল ভাষাভাষীদের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ‘আমরা করব জয়’ গানটি পরিবেশনের মাধ্যমে। এর আগে বাউলসাধক শাহ আবদুল করিমের ‘বসন্ত বাতাসে সই গো’ গানটি পরিবেশন করেন শিল্পীরা। সম্মেলক পরিবেশনায় অংশ নেন তালবিদা, মোমেন, সোহান, সাদমান, রাফি, তনয়, ইয়াসমিন, রূপসা, সুচিত্রা ও ঈশিতা। অনুষ্ঠানের সূচনা হয় বাংলা ও ইংরেজি ভাষার গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। আড়াই ঘণ্টা ব্যাপ্তির অনুষ্ঠানে ১৫টি পরিবেশনায় অংশ নেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তা ও তাঁদের সন্তানরা। নিজ দেশের ভাষায় কবিতা আবৃত্তি করেন ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা, নেপালের চার্জ দ্য এ্যাফেয়ার্স সুশীল কুমার লামসাল ও নির্মল প্রসাদ ভেট্টরি, ভুটানের কারমা, ইরানের আজগর খোশো আবেদি, স্পেনের আমপারো পোর্তো, চীনের ঝেং লুইফাই ও ওয়াং কুইঙ্গলিন। সঙ্গীত পরিবেশন করেন রাশিয়ার শিল্পী জুলিয়ানা জার্ভনকোভা, ফ্রান্সের ভিনসেন্ট মিয়ের ও হুমাইয়ারা। বাংলাদেশের আদিবাসী গান পরিবেশন করেন সোয়ে সোয়ে ইউ মারমা। ভিয়েতনামের অবিসংবাদিত নেতা হো চি মিন স্মরণে ‘ভিয়েতনাম-হো চি মিন’ শীর্ষক সঙ্গীত পরিবেশন করেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী আবিদা সুলতানা। সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির নন্দন মঞ্চেও ছিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা পর্ব। এতে সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করে বহ্নিশিখা, ভাওয়াইয়া সঙ্গীত দল, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, পিপলস লিটল থিয়েটার ও ঢাকা সাংস্কৃতিক দল। সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে বাংলার মাটি ও একাডেমির শিল্পীরা। আদিবাসী সঙ্গীত পরিবেশন করেন চৈতী চাকমা। এছাড়াও আয়োজনে ছিল বিভিন্ন শিল্পীর একক কণ্ঠের সঙ্গীত পরিবেশনা। রবীন্দ্র সরোবরে জোটের একুশের অনুষ্ঠানমালা ॥ একুশের বিকেলে ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবরের উন্মুক্ত মঞ্চটিকে ঘিরে বয়ে প্রাণের হিল্লোল। জল-হাওয়া বেষ্টিত এ মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশাত্মবোধক গান, নাচ, আবৃত্তি ও পথনাটসহ রকমারি পরিবেশনা। ‘রাষ্ট্র চলবে বাংলায়, না চলা অন্যায়’ সেøাগানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত ১৪ দিনব্যাপী একুশে অনুষ্ঠানমালার শেষ দিন ছিল রবিবার। সমাপনী দিনে বিকেল থেকে শুরু হয় অনুষ্ঠান। শুরুতে ‘বর্ণমালা আমার বর্ণমালা’ গানের সঙ্গে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে আংগিকালের শিল্পীরা। ‘বিহান বেলার গান’ আবৃত্তি প্রযোজনা নিয়ে মঞ্চে আসে ঢাকা স্বরকল্পের শিল্পীরা। এরপর সম্মেলক কণ্ঠে ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল’ গানটি পরিবেশন করে দোয়েল ললিতকলা একাডেমি। সম্মেলক সুর শেষে একক কণ্ঠে গান শোনান শ্যামল কুমার নট্ট ও ফেরদৌসী কাকলী। কিশোর থিয়েটারের দলীয় আবৃত্তি প্রযোজনায় ছিল ‘লাল টুকটুক বর্ণমালা লাল সবুজের স্বাধীনতা’। একক আবৃত্তি করেন শিল্পী মজুমদার জুয়েল। নৃত্যজন সংগঠনের শিল্পীদের ‘আমায় গেঁথে দাওনা মাগো’ গানের সঙ্গে দলীয় নৃত্য পরিবেশনার পর একক গান পরিবেশন করেন ভারতীয় শিল্পীদ্বয় এরিনা মুখার্জী ও শীর্ষ রায়। এছাড়া একক গান পরিবেশন করেন আরিফ রহমান, মাহমুদুল হাসান ও সেমন্তী মঞ্জরী। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন গোলাম সারোয়ার, বেলায়েত হোসেন ও অনন্যা লাবণী। অনুষ্ঠানে দলীয় গান পরিবেশন করে কলকাতার গানের দল দোহার, ঢাকার স্বভূমি ও আনন্দ সংগঠনের শিল্পীরা। সব শেষে পথনাটক পরিবেশন করে নাট্যসংগঠন ‘নন্দন কানন’ ও ‘বাতিঘর’। ছায়ানটের আয়োজনে একুশের শ্রদ্ধার্ঘ্য ॥ রবিবার একুশের সন্ধ্যায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষাশহীদদের নিবেদিত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। সঙ্গীত পরিবেশনা ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর দিয়ে সাজানো হয় অনুষ্ঠান। ছায়ানট মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল ‘একুশের শ্রদ্ধার্ঘ্য’। শিশু শিল্পীদের সম্মেলক কণ্ঠে ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ গানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। খুদে শিল্পীদের পরিবেশনায় ছিল দলীয় গান ‘মানুষ হ’ মানুষ হ’ আবার তোরা মানুষ হ’। এরপর প্রদর্শিত হয় সেন্টু রায় নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’। সম্মেলক কণ্ঠে শিল্পীরা গেয়ে শোনান ‘মিলিত প্রাণের কলরবে’ ও ‘রক্ত শিমুল তপ্ত পলাশ দিল ডাক’। সব শেষে পরিবেশিত হয় জাতীয় সঙ্গীত। প্রভাতফেরির প্রথম প্রহর ॥ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে তীরন্দাজ নাট্য বরাবরের মতো এবারও জাতীয় জাদুঘরের শিমুলতলায় ‘প্রভাতফেরির প্রথম প্রহর’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। একুশের প্রথম প্রহর রবিবার রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে শুরু হয়ে সূর্যোদয় পর্যন্ত বিস্তৃত অনুষ্ঠানটির মধ্য দিয়ে মাতৃভাষার জন্য আত্মদানকারী ভাষা শহীদদের স্মরণ করে তীরন্দাজ রেপার্টরিসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় থিয়েটার ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আরণ্যক, প্রাচ্যনাট, থিয়েটার আর্ট ইউনিট, বটতলা, বাতিঘর, থিয়েটার বাহান্ন এবং গানের দল চিৎকার, কবিয়াল ও মুক্তস্বর।
×