ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পঞ্চগড়ে সন্তগৌড়ীয় মঠের অধ্যক্ষ হত্যার নেপথ্যেও জেএমবি

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

পঞ্চগড়ে সন্তগৌড়ীয় মঠের অধ্যক্ষ হত্যার নেপথ্যেও জেএমবি

শংকর কুমার দে ॥ আবারও রবিবার পঞ্চগড়ে সন্তগৌড়ীয় মঠের অধ্যক্ষকে গলা কেটে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় উপাসনালয়, মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, দুই বিদেশীসহ ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর যেসব হামলা অব্যাহত আছে- তা ঘটাচ্ছে জামায়াত-শিবিরের মদতে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। জেএমবির জঙ্গীরাই আবার আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নাম দিয়ে এ ধরনের হত্যাকা- ও হামলা করে যাচ্ছে। এ ধরনের হত্যাকা- ও হামলায় জড়িতরা সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য। বিদায়ী বছর ২০১৫ সালের শেষ ৩ মাসে অন্তত ১২টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে এবং দেড় শতাধিক ধর্মপ্রাণ মানুষ আহত হয়েছেন। হামলার শিকারে পরিণত হয়েছে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের আহমদিয়া মসজিদ, হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের গীর্জাগুলোতে হামলার ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার, বিচারের রায় কার্যকর করার পর থেকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র মদতে ও ঢাকার পাকিস্তান দূতাবাসের এক শ্রেণীর কর্মকর্তার সহায়তায় জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোকে মাঠে নামিয়ে এ ধরনের হামলা ও হত্যাকা-ের মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে বিদেশের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। রবিবার সকালে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের সন্তগৌড়ীয় মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়কে (৫০) গলা কেটে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তাতে জেএমবি বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গীগোষ্ঠীরই কাজ বলে সন্দেহ করছে গোয়েন্দা সংস্থা। অধ্যক্ষকে হত্যার পর যেভাবে হোন্ডাযোগে হত্যাকারীরা পালিয়ে গেছে, ঠিক একই কায়দায় ঢাকায় ইতালীয় ও রংপুরে দুই বিদেশী হত্যাকা-সহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার পর হত্যাকারীরা পালিয়ে গেছে হোন্ডাযোগে। ঢাকায় পুলিশ, ব্লগার, লেখক ও প্রগতিশীলদের ওপর হামলা করার পর জবাই করার মধ্যে হত্যাকা-ও সংঘটিত করেছে জঙ্গীগোষ্ঠীই, যা পঞ্চগড়ের অধ্যক্ষ বা পুরোহিত হত্যাকা-ের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীর পশ্চিম পাড়ে ওই মঠে পূজার প্রস্তুতির সময় হত্যাকা- ও হামলার সময়ে হত্যাকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলিবর্ষণ, বোমাবাজি ও ধারাল ছুরি ব্যবহার করেছে, যা অতীতে যেভাবে হামলা ও হত্যাকা- সংঘটিত করেছে জঙ্গীগাষ্ঠী। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ২০১৫ সালে বিশেষ করে শেষের ৩ মাসে অন্তত ১২টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা করা হয়েছে; তাতে দেড় শতাধিক ধর্মপ্রাণ মানুষ হামলার শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের আহমদিয়া মুসিলম সম্প্রদায়ের মসজিদের ওপর হামলার প্রথম ঘটনা ঘটে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এবং সেই হামলা করেছে জেএমবি নামক জঙ্গী সংগঠনটি। তারপর থেকেই মূলত দেশের মসজিদ-মাজারগুলোতে গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে জেএমবি। এ হামলাগুলোর বাইরে ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক ও রংপুরের জাপানী নাগরিক হত্যাকা-, ঢাকায় পুলিশ হত্যাকা-, প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক হত্যাকা- ও হামলার ঘটনাগুলোও একই জঙ্গীগোষ্ঠীর কাজ বলে গোয়েন্দা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গত বছর ২০১৫ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের দিনাজপুরের কাহারোলে কান্তজিউ মন্দিরে হামলা হয়েছে গত ৪ ডিসেম্বর এবং ১০ ডিসেম্বর দিনাজপুরে ইসকন মন্দিরে হামলা হয়। দিনাজপুরে কাহারোল উপজেলায় আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভবনামৃত সংঘের (ইসকন) মন্দিরে হামলার ঘটনায় দিনাজপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে ১৬৪ ধারায় ওই জবানবন্দী দেন গ্রেফতার হওয়া জেএমবি সদস্য শরিফুল ইসলাম। শরিফুল নিজেকে জেএমবির সদস্য বলে স্বীকার করেছেন। জবানবন্দীতে তিনি ইসকন মন্দিরে হামলা এবং ধর্মযাজক পিয়েরো পিচমকে গুলির ঘটনা জেএমবি ঘটিয়েছে বলে স্বীকার করেছে। এ ছাড়াও দিনাজপুরে মন্দিরে হামলা এবং ইতালীয় ধর্মযাজককে গুলির ঘটনায় নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) জড়িত বলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন গ্রেফতার হওয়া আরও এক জঙ্গী সদস্য। এছাড়াও গত ২৫ ডিসেম্বরে রাজশাহী জেলার বাগমারার শুভডাঙ্গা ইউনিয়নের সৈয়দপুর চকপড়া আহমাদিয়া জামে (কাদিয়ানী) মসজিদে বোমা বিস্ফোরণে অজ্ঞাত এক যুবক নিহত এবং আহত হন ১০ জন। হামলায় নিহত যুবককে এখনও শনাক্ত করা যায়নি। ওই যুবকই যে নামাজ পড়ার নামে বিস্ফোরক নিয়ে মসজিদে ঢুকে নাশকতা করতে চেয়েছিল, তা নিশ্চিত হতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, ওই যুবক আহমদিয়া জামে মসজিদে এর আগে কোন দিন আসেননি বা তাকে দেখেছে এমন কোন প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হওয়ায় তারা নিজেদের সবাই একে অন্যের পরিচিত। দিনটি ছিল শুক্রবার ও পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা) দিন। এ কারণে ঘটনার দিন (২৫ ডিসেম্বর) মসজিদে মুসল্লিদের অনেক ভিড় ছিল। নামাজের ভিড়ে ঠেলাঠেলি হওয়ায় বোমাটি ওই যুবকের শরীরেই বিস্ফোরিত হয়। তদন্তকারীদের ধারণাÑ ওই যুবক সম্ভবত জেএমবির সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য। ২০১৫ সালের ২৪ অক্টোবর মধ্যরাতে পুরান ঢাকার হোসেনী দালানে তাজিয়া প্রস্তুতির সময় হামলায় একজন ও পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজন নিহত হন। আহত হন ১৫০ জন। গত ২৬ নবেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুর গ্রামে শিয়া মুসলিমদের আল মোস্তফা মসজিদে দুর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত ও তিনজন আহত হন। এ ছাড়াও কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মুসলিমরা বিচ্ছিন্নভাবে অনেক হামলার শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটানো হয়েছে। গত ১৮ ডিসেম্বর শুক্রবার জুমার নামাজের সময় চট্টগ্রামে নৌবাহিনী ঘাঁটি ঈশা খাঁ মসজিদে পর পর দুটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। এতে ৬ জন মুসল্লি আহত হন এবং ঘটনাস্থল থেকে দু’জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গীগোষ্ঠীর সম্পর্কে একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে।
×