ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষার মাসেও দর্শনার্থী নেই ভাষা জাদুঘরে;###;প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরে শেষ হয়েছে ২৩ কাজের একটি

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট চলছে ঢিমেতালে

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট চলছে ঢিমেতালে

আনোয়ার রোজেন ॥ আইনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের কাজ আছে মোট ২৩টি। অথচ প্রতিষ্ঠার ৫ বছরে কাজ শেষ হয়েছে মাত্র একটির। সেটির ফল এখনও জানা যায়নি। চার বছর আগে প্রতিষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে নির্মাণ করা হয় ভাষা জাদুঘর। এরপর থেকে জাদুঘরে সংযোজিত হয়নি নতুন কোন উপকরণ। তাই ভাষার মাসেও দেখা মেলে না দর্শনার্থীদের। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে গত বছরের নবেম্বরে জাতিসংঘের ইউনেস্কোর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পেয়েছে ইনস্টিটিউট। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরুর জন্য আইনে যে প্রয়োজনীয় সংস্কার দরকার তা থমকে আছে খসড়া তৈরি পর্যন্তই। ইনস্টিটিউটটি পরিচালনার জন্য ৯১ জনের জনবল কাঠামো অনুমোদিত হলেও তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। ফলে বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষার প্রসার, বিলুপ্তপ্রায় ভাষার ইতিহাস সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটটি চলছে ঢিমে তালে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইনস্টিটিউটের অবকাঠামো আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু এর গবেষণা ও অন্যান্য কার্যক্রম এখনও আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত হতে পারেনি। তবে গত ৫ বছরে ইনস্টিটিউটের যা অর্জন তাকে ‘যথেষ্ট’ বলেই মনে করেন এর মহাপরিচালক অধ্যাপক জীনাত ইমতিয়াজ আলী। তার মতে, বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানও প্রথম ৫ বছরে খুব বেশি এগোতে পারেনি। সেই হিসেবে কেবল ভাষা চর্চার জন্য বিশেষায়িত এ প্রতিষ্ঠানটির অগ্রগতি সন্তোষজনক। পর্যাপ্ত জনবল ও কারিগরি সুবিধা থাকলে কাজের গতি আরও বাড়ত। ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়। এরপর বিশ্বের বিপন্ন ও প্রায় বিপন্ন ভাষার বিকাশ এবং এসব ভাষার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ১৯৯৯ সালের ৭ ডিসেম্বর পল্টনের এক জনসভায় এ সিদ্ধান্তের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে ঘোষণা অনুযায়ী ২০০১ সালের ১৫ মার্চ রাজধানীর ১/ক সেগুনবাগিচায় ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিনি। সে সময় উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান। তবে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে ইনস্টিটিউটের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ইনস্টিটিউটের প্রাথমিক নির্মাণকাজ শেষ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১২তলা ভিত্তির ওপর তিনতলা ভবন উদ্বোধন করেন। ইনস্টিটিউট পরিচালনার জন্য একই বছরের ১১ অক্টোবর প্রণয়ন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন। ওই আইনে ইনস্টিটিউটের মোট ২৩টি সুস্পষ্ট দায়িত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটিই হলো দেশে ও দেশের বাইরে বাংলাভাষার প্রচার ও প্রসারে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ। বাকিগুলোর মধ্যে রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও দেশের ক্ষুদ্র জাতিসমূহের ভাষা সংগ্রহ ও সংরক্ষণে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা, বাংলাসহ অন্যান্য ভাষা ও ভাষা আন্দোলন বিষয়ে গবেষণা ও ইউনেস্কোর সদস্য দেশসমূহের মধ্যে প্রচার, বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার অভিধান বা কোষগ্রন্থ প্রকাশ ও হালনাগাদকরণ, বিভিন্ন ভাষা ও বর্ণমালার জন্য একটি আর্কাইভ নির্মাণ, সংরক্ষণ ও হালনাগাদকরণ এবং ভাষা জাদুঘর তথ্য সমৃদ্ধকরণ, সংরক্ষণ ও পরিচালনা করা ইত্যাদি। এর মধ্যে ২০১১ সালে ইনস্টিটিউটির প্রথম তলার একটি কক্ষে শুরু হয় ভাষা জাদুঘরের কার্যক্রম। সম্প্রতি সরেজমিন ইনস্টিটিউট ঘুরে দেখা যায়, ডিজিটাল ব্যানারে বিভিন্ন দেশের ভাষা ও ভাষা জনগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয়েছে। দেয়ালে ঝুলছে প্রাচীন মিসরীয় ভাষার লিপি, চার হাজার বছর আগের গুহাচিত্রের প্রতিলিপি। তবে সাজানো গোছানো আলোকোজ্জ্বল জাদুঘরটি নির্জন। এসব দেখার জন্য একজন দর্শনার্থীও নেই! আর এজন্যই বোধহয় বিশাল কক্ষের জাদুঘর পরিদর্শনে আসা দর্শনার্থীদের জন্য নেই সঠিক কোন নির্দেশনা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক জীনাত ইমতিয়াজ আলী জনকণ্ঠকে বলেন, ভাষা জাদুঘরে মোট ৬৬টি দেশের ভাষা ও ভাষা জনগোষ্ঠীর তথ্য রয়েছে। দেশগুলোর নামের বাংলা বর্ণ ক্রমানুসারে সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয়েছে। জাদুঘরের আরও আধুনিকায়নের জন্য সংস্কার কাজ চলছে। এটি শেষ হলে দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও জাদুঘরে দেয়া থাকবে। ইনস্টিটিউটের আইনে উল্লেখিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো দেশের আদিবাসীদের নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা পরিচালনা করা। এর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর অবস্থান চিহ্নিত করা এবং তাদের ভাষিক পরিস্থিতির বাস্তব পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হবে। দুই বছর আগে এই সমীক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক জীনাত বলেন, সমীক্ষার কার্যক্রম শেষ হয়েছে। তবে প্রতিবেদন এখনও তৈরি হয়নি। এজন্য আরও কিছুটা সময় লাগবে। তবে নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার পর হাতে নেয়া হয়নি আর কোন গবেষণাধর্মী প্রকল্প। ইনস্টিটিউটের লক্ষ্য অনুযায়ী শুরু হয়নি বহুভাষিক অভিধান প্রণয়নের কাজ। আবার আইন অনুযায়ী ইনস্টিটিউটের এক নম্বর কাজ হলো দেশে ও দেশের বাইরে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইনস্টিটিউট এক্ষেত্রে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, আমাদের জানতে ইচ্ছে করে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি কয়টি দেশে উদযাপিত হয়। কারণ জাতিসংঘ ঘোষিত দিবস কোন দেশ সাড়ম্বরে পালন করে, কোন দেশে তা নীরবে চলে যায়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ও বাংলাভাষী অঞ্চলের বাইরে এটি পালিত হয় বলে আমার জানা নেই। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রচারে ইনস্টিটিউট ভূমিকা রাখতে পারে। তবে বিদ্যমান জনবল কাঠামোয় বিশ্বের কোন কোন দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয় সেই খোঁজ রাখা ইনস্টিটিউটের পক্ষে সম্ভব নয় বলে মনে করেন অধ্যাপক জীনাত ইমতিয়াজ আলী। তিনি বলেন, কেবল ভাষা নিয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গোটা বিশ্বে হাতেগোনা। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর আটটি মাত্র দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সবই গবেষণামূলক এবং ভাষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট টেকন্যিকাল লোকজনই এসবের সঙ্গে যুক্ত। তাছাড়া এখন ইউনেস্কোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইনস্টিটিউটের তরফে বিধিবদ্ধ কাজের বাইরে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সীমিত। জানা গেছে, ইউনেস্কোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় ইনস্টিটিউটের ভবিষ্যত কার্যক্রমে পরিবর্তন আসবে। পরিবর্তন আসবে ইনস্টিটিউটের পরিচালনা বোর্ডেও। সাত সদস্যের পরিচালনা বোর্ডে ইউনেস্কোর প্রতিনিধি থাকবেন চারজন। আর বাংলাদেশের প্রতিনিধি থাকবেন তিনজন। তারা হলেনÑ শিক্ষা সচিব, সংস্কৃতি সচিব এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব। বর্তমান মহাপরিচালকের পদটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এর পরিবর্তে ইউনেস্কোর অনুমোদনক্রমে নিয়োজিত একজন পরিচালক ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। এজন্য বিদ্যমান আইনের সংস্কার করতে হবে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক জীনাত বলেন, ইউনেস্কো সহযোগী হওয়ায় বিশ্বব্যাপী ইনস্টিটিউটের কাজের সুযোগ তৈরি হবে। প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক পরিচিতি বাড়বে। এটা বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার জন্য বিরাট এক সুযোগ। ইউনেস্কোর পরামর্শ মেনে আইনের নতুন খসড়া ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে। চূড়ান্ত হতে আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে। ইনস্টিটিউট পরিচালনায় যে ৯১ জন জনবল নিয়োগের কথা ছিল সে বিষয়ে জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, রাজস্ব খাতের আওতায় পুরো জনবল কাঠামোর অনুমোদন পাওয়া গেছে। এখন ইউনেস্কোর পরামর্শ মেনে দুই-একটি পদ সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে। জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু রয়েছে। শীঘ্রই সব শূন্য পদে নিয়োগ সম্পন্ন হবে। বর্তমানে ইনস্টিটিউটের অবকাঠামোগত উন্নয়নে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলছে। এতে ব্যয় হবে মোট ৫৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
×