ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শহীদ মিনার থেকে সোজা মেলায়, ৩ হাজার নতুন বই

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

শহীদ মিনার থেকে সোজা মেলায়, ৩ হাজার নতুন বই

মোরসালিন মিজান ফেব্রুয়ারির পুরোটা জুড়ে মেলা। মাসের প্রথম দিন শুরু হয়েছিল। প্রতিদিনই আসছেন বইপ্রেমীরা। শেষ দিন পর্যন্ত এই আসা-যাওয়া অব্যাহত থাকবে। তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিনটি অবশ্যই ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাই হারানোর ব্যথা ও মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার ঐতিহাসিক দিনটি ঘিরেই সমস্ত আয়োজন। দিনটির জন্য প্রতীক্ষা করে থাকেন লেখক পাঠক প্রকাশকরা। রবিবার ছিল সেই কাক্সিক্ষত দিন। অমর একুশের দিনে সকাল ৮টায় খুলে দেয়া হয় মেলা। পাশেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। সেখানে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় সর্বস্তরের জনগণ। শহীদ মিনারের এই জনস্রোত এসে আছড়ে পড়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। সকালে মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে দেখা যায় সেই চিরচেনা চেহারা। বিভিন্ন বয়সী মানুষ দীর্ঘ পথ হেঁটে মেলায় প্রবেশ করছিলেন। শোকের দিন হওয়ায় এদিন পোশাকে ছিল কালো রঙের প্রাধান্য। কেউ কেউ পতাকার লাল-সবুজ রঙে সেজে এসেছিলেন। বড় অংশটি শুরু করে বাংলা একাডেমি থেকে। শেষ হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে। পরিবার পরিজন নিয়ে মেলায় এসেছিলেন বহু মানুষ। আগে থেকে পরিকল্পনা করে এসেছিলেন বন্ধু-বান্ধবরা। প্রচুর লোকসমাগমের কথা মাথায় রেখে এদিন প্রকাশ করা হয়েছে অনেক নতুন বই। ২১তম দিনে শুধু একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমা পড়ে ২১০টি নতুন বই। আর মেলার প্রথম দিন থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত নতুন বইয়ের সংখ্যা হবে ৩ হাজারের বেশি। প্রতিদিন মেলা ঘুরে, প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা হয়েছে। ২১তম দিন পর্যন্ত একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমা পড়েছে দুই হাজার ৬০৬টি নতুন বই। গল্প, উপন্যাস, কবিতার সংখ্যা বেশি। এসেছে ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা বিষয়ে লেখা নতুন বই। জীবনীগ্রন্থ, স্মৃতিচারণমূলক রচনা, অনুবাদ সাহিত্য এসেছে। আরও কত কত বই! কত কত মানুষের নিত্য আসা-যাওয়া। কিন্তু বইয়ের সঙ্গে এই আসা-যাওয়া কতটা সংশ্লিষ্ট? ক’জন বই কিনে বাড়ি ফেরেন? প্রশ্নটির উত্তর জানার ভাল কোন তরিকা নেই। নিজেদের বিক্রি সম্পর্কে কোন তথ্য কখনই দেন না প্রকাশকরা। বাংলা একাডেমির কাছেও এই তথ্য পৌঁছে না। সেই ব্যবস্থা নেই। ফলে মেলা ঘুরে যা দেখা যায় তার ওপর ভরসা করতে হয়। এদিন সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে কালীমন্দির গেট দিয়ে বেরিয়ে আসার পথে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে দেখা গেল, প্রতি ২০ জনের মধ্যে মাত্র চারজন বই হাতে বের হচ্ছেন। দুই দফায় গুনে বিশেষ পার্থক্য বের করা গেল না। বই ও ক্রেতার আনুপাতিক হারে এত পার্থক্য যে কাউকে অবাক করবে। কী এর কারণ? জানতে কথা হয় কয়েকজন পাঠকের সঙ্গে। বন্ধুদের বিশাল একটি দল মেলা ঘুরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ব্যাপক হুলস্থুুল করছিল। তাদের আনন্দের যেন সীমা নেই। অথচ সকলেরই হাত বইশূন্য। এই আনন্দ তবে কীসের? জানতে চাইলে শাহনেওয়াজ নামের এক তরুণ এগিয়ে আসেন। বলেন, ‘বই তো পড়ি। আজকে ধরেন, বেড়াতে আসছিলাম। কালকে পরশু আবার আসলে কিনব।’ প্রতিবেদককে খুশি করার এই চেষ্টাই অবশ্য শেষ কথা নয়। বই কম কেনার যৌক্তিক কারণও তুলে ধরার চেষ্টা করলেন কেউ কেউ। ইশতিয়াক হোসেন নামের এক পাঠক দুই হাত ভরে বই নিয়ে ফিরছিলেন। তার সঙ্গে আরও একজন। তার হাতেও বই। তাতে কী? বইপ্রেমী প্রবীণ বললেন, ‘মানসম্পন্ন বইয়ের খুব অভাব। অনেক আগে পড়া বই এখানে নতুন মোড়কে বিক্রি করা হচ্ছে। নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতা হাতে নিয়ে কয়েক পাতা উল্টেছিলাম। দেখি, অসংখ্য বানান ভুল। অনুবাদগ্রন্থ, যা বেশিরভাগই কাঁচা। একেবারে অজানা-অচেনা ব্যক্তিরা অনুবাদ করেছেন।’ তাহলে এত বই যে নিয়ে যাচ্ছেন, এগুলো কেমন? প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘সব তো মন্দ নয়। ভাল বইও আছে। বাজে বই থেকে ভালগুলোকে আলাদা করা শুধু কঠিন হয়ে গেছে!’ নতুন বই ॥ মেলায় প্রতিদিনই আসছে নতুন বই। কিছু নতুন বইয়ের কথা পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে। শ্রাবণ থেকে এসেছে এই মেলার অন্যতম আলোচিত গ্রন্থ ‘নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু’। সম্পাদনা করেছেন রাজীব পারভেজ। বইয়ে মহান নেতার বহুমাত্রিক কর্মকা-কে ২০টি অধ্যায়ে ভাগ করে আলোচনা করা হয়েছে। মূল্য ৭৫০ টাকা। কথা প্রকাশ থেকে এসেছে ‘বাংলাদেশের বাউল সমাজ ॥ সাহিত্য ও সংগীত’। লিখেছেন ডক্টর আনোয়ারুল করীম। গবেষণাগ্রন্থে বাউলের সমাজ, সাহিত্য ও সঙ্গীত নিয়ে বিশদভাবে তথ্যসহ বর্ণনা করা হয়েছে। জ্যোতি প্রকাশ থেকে এসেছে তৌহিদুর রহমানের উপন্যাস ‘শঙ্খচিলের মৃত্যুদৃশ্যের পর’। কথাশিল্পী একাত্তরের এক বীরাঙ্গনা মায়ের জীবন থেকে নিয়েছেন। কল্পনা নয়, বরং বাস্তব চরিত্রকে উপন্যাসের মৌল উপাদান করেছেন তিনি। ঐতিহ্য থেকে মেলায় এসেছে অদিতি ফাল্গুনীর গল্পের বই ‘প্রমথেশ প্রমিথিউস’। সঙ্কলনে মোট ১৬টি গল্প স্থান পেয়েছে। মেলায় এসেছে এমএ ওয়াহিদের লেখা বই ‘নজরুলের জীবনে নার্গিস’। নজরুল ও নার্গিসের প্রেম-বিরহের আখ্যান প্রকাশ করেছে রিদম প্রকাশনা সংস্থা। র‌্যামন পাবলিশার্স থেকে এসেছে কবি ও সাংবাদিক এমদাদুল হক তুহিনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘থমকে গেছে প্রেম’। নাম থেকেই ধারণা নেয়া যায়, প্রেমের কবিতা দিয়ে সাজানো। মোট কবিতা ৫৪টি। ভালবাসার জন্য কাতর হৃদয় এই সব কবিতায় যেন আশ্রয় করে আছে। সিঁড়ি প্রকাশন থেকে এসেছে মানসুবা তাবাসসুম হকের লেখা ‘মা ও শিশু : স্বাস্থ্য ও অধিকার’। বইটি সংশ্লিষ্টদের জন্য বিশেষ কাজে আসবে। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ অমর গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে ছিল অমর একুশে বক্তৃতা-২০১৬। ‘আবাসন : বিশ্বে ও বাংলাদেশে’ শীর্ষক একুশে বক্তৃতা প্রদান করেন সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। প্রাবন্ধিক বলেন, বিশ্ব ইতিহাসে বিশেষত ইউরোপে আজ আবাসনের ভাঙ্গাগড়ার বিরাট এক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। ২০১৫ সালে প্রায় দশ লাখ লোক মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক ও সিরিয়ায় মুখ্যত যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের আগ্রাসন ও নব্য ঔপনিবেশিক চক্রান্তে গৃহহীন হয়ে, বাঁচার আশায় তুরস্ক উপকূল থেকে ইজিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে গ্রীস হয়ে ইউরোপের নানা দেশে ঢুকছে। পঞ্চাশ কোটি লোক অধ্যুষিত ইউরোপ এই বিপুলসংখ্যক লোকের ধাক্কা সামলাতে তার অর্থনীতি-রাজনীতির প্রায় সবক্ষেত্রে টালমাটাল অবস্থায় পৌঁছেছে। আমাদের দেশে আমরাও গত প্রায় দু’দশক ধরে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের নিয়ে সমস্যা-আক্রান্ত। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশেরও প্রায় এক কোটি লোক বিশ্বের নানা দেশে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে স্থায়ী ও অস্থায়ী আবাসন গড়ে তুলেছে। অস্থায়ীরা যখন হঠাৎ করে দলবেঁধে ফিরে আসে তখন আমাদের সামাজিক-অর্থনীতিও সমস্যাকীর্ণ হয়। তাই বিশ্বজুড়ে এই আবাসন সমস্যা আমাদের বোঝা প্রয়োজন। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, আজকের একুশে বক্তৃতার এই সময়ে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনে আহত সংগ্রামীরা চিকিৎসা নিচ্ছিলেন হাসপাতালে, ভাষা শহীদদের কারও কারও লাশ ছিল মর্গে, মেডিক্যাল কলেজে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছাত্রদের বক্তৃতা চলছিল, প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক পরিষদেও ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলনের উত্তাপ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল আমরা বুঝি হেরে গেলাম। কিন্তু শেষ বিচারে বাংলা ভাষা ও আমাদেরই বিজয় ঘোষিত হলো। সন্ধ্যায় থিয়েট্রেক্স বাংলাদেশ পরিবেশন করে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী রচিত ভাষা আন্দোলনের অমর নাটক ‘কবর’।
×