ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে একুশে উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী

বিদেশী ভাষা শিখতে হবে, কিন্তু মাতৃভাষাকে অবহেলা নয়

প্রকাশিত: ০৫:০১, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বিদেশী ভাষা শিখতে হবে, কিন্তু মাতৃভাষাকে অবহেলা নয়

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষার বিকৃতি রোধে সবাইকে সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়ে বলেছেন, আমাদের দেশের একটি শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এমন তৈরি হয়েছে যে তাদের শিশু-সন্তানদের ইংরেজী মাধ্যমে না পড়ালে যেন ইজ্জতই থাকে না! এ চিন্তাটা চলে এসেছে। বাংলা ভাষাটা ভুলে যাওয়াটা যেন বিরাট একটা গুণের কাজ। কষ্ট হয় তখনই যখন দেখি মানুষের মধ্যে বাংলা ভাষাকে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা। কিছু কিছু মানুষের মধ্যে এই চরিত্রদোষটা আমি দেখতে পাই। বিশ্বায়নের যুগে বিদেশী ভাষা শিখতেই হবে। কিন্তু তা যেন মাতৃভাষাকে অবহেলা করে না হয়। ভাষার বিকৃতিটা যেন না হয়, সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রবিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের প্রবণতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মানুষ আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করবে, এটি তার নিজস্ব এলাকার ভাষা- কিন্তু বাংলাকে ভুলে যাবে না। আর অঞ্চলভেদে বাংলা ভাষার যে তারতম্য দেখা যায় সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ভিনদেশী উচ্চারণে বাংলা বলতে শোনা যায়, যা গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, এখানে একটা কালচার (সংস্কৃতি) দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাকে বিবৃত করে ইংরেজী একসেন্টে বলতে পারাটাকে মনে করে যেন গৌরবের বিষয়! এ বিষয়ে মানুষকে বেশি সচেতন করা উচিত যাতে ভাষার বিকৃতিটা যেন না হয়। তিনি বলেন, জীবন-জীবিকার জন্য নতুন নতুন ভাষা শিখতে হবে। ভাষা শেখায় অপরাধ নেই। যে যত ভাষা শিখতে পারবে ততই উন্নতি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালীর মননের বাতিঘর’ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান। স্বাগত বক্তব্য দেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব সোহরাব হোসেন। অন্যদের মধ্যে ঢাকায় ইউনেস্কোর প্রধান বিয়েত্রিস কালদুম অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। তিনি শুভেচ্ছা বক্তৃতায় ইউনেস্কোর মহাপরিচালক মিজ ইরিনা বুকোভার শুভেচ্ছা বাণীও অনুষ্ঠানে পড়ে শোনান। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে ইউনেস্কোর দুই নম্বর ক্যাটাগরির মর্যাদা দেয়ার চুক্তিপত্রটি প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্যবৃন্দ, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দফতর-অধিদফতর এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যবৃন্দ, কূটনৈতিক মিশনের সদস্যবৃন্দ এবং উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানকার মানুষজনের মধ্যে একটা বিষয় লক্ষ্য করি তা হলো- ছোট বাচ্চাদের ইংরেজী মিডিয়ামে না পড়ালে যেন ইজ্জত থাকে না। কয়টা ছেলেমেয়ে ইংরেজী মিডিয়ামে পড়ে এসএসসিতে ভাল রেজাল্ট করেছে? তেমন কিন্তু খুব বেশি দেখা যায় না। তাহলে এই ধরনের মানসিকতটা কেন থাকবে? আর বাংলাকে বিকৃত করে ইংরেজী ধাঁচে বলার প্রবণতাও এখন তৈরি হয়েছে। এসব থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলার পাশাপাশি বিদেশী ভাষা শেখার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই পৃথিবী এখন ‘গ্লোবাল ভিলেজে’ পরিণত হয়েছে; জীবন-জীবিকার জন্য মানুষকে নানা ভাষা শিখতে হয়। ভাষা শেখার একটা বিশেষ স্কিল লাগে। সকলে পারে না। অনেকে অনেক ভাষা একসঙ্গে শিখতে পারে। ভাষা শেখায় কোন অপরাধ নেই। যে যত ভাষা শিখতে পারবে, তাতে আমরা অনেক সময় উৎসাহিত করি। তিনি কর্মসংস্থানের জন্য যারা বিদেশে যান, তাদের ভাষা শেখার সুযোগ করে দেয়ার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী। মাতৃভাষার জন্য বাঙালীর দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা ভাষা আমাদের ভাষা। ভাষাকে ভালবাসি আমরা, মায়ের ভাষায় কথা বলব। এটি তো আমাদের অধিকার। কাজেই এ ভাষাকে আরও উন্নত করার জন্য আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে। তিনি বলেন, শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা মাতৃভাষার অধিকার পেয়েছি। ১৯৫২ সালের পর উর্দু হরফে বাংলা এবং পরে লাতিন হরবে বাংলা লেখার চেষ্টা হয়েছিল। তখন রবীন্দ্রনাথ পড়া যাবে না, শোনা যাবে না। কারণ একটা জাতিকে ধ্বংস করতে গেলে প্রথমে আঘাত হানতে হয় ভাষার ওপর, সংস্কৃতির ওপর। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মিছিলে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশে গুলি চালায় পুলিশ। প্রাণ দেন সালাম, রফিক, বরকত, শফিউরসহ নাম না জানা অনেকে। এরপর বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয় তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই ইতিহাস স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ’৪৭-এর পর থেকে বাঙালীর ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ওপর বার বার আঘাত করেছে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী। তারা আমাদের জাতি ধ্বংস করতে ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে। কী দুর্ভাগ্য আমাদের বাঙালী জাতির, এ জাতির কিছু সন্তানও ছিল যারা তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। তিনি বলেন, কোন অর্জনই হঠাৎ করে আসে না। অর্জনের পেছনে নেতৃত্ব থাকে। আর সেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির পিতা। এ আন্দোলনের শুরুতেই চারবার কারাবরণ করেন বঙ্গবন্ধু। এ ছাড়া এ আন্দোলনে অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন। তবে কোন অর্জনই সহজে আসে না। তাদের রক্তেই আমরা পেয়েছি মাতৃভাষা বাংলা। আমাদের প্রতিটি অর্জন ত্যাগের বিনিময়ে পেতে হয়েছে। আজকে আমরা যা পেয়েছি, জাতির পিতার জন্য পেয়েছি। ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানাই। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার কথা স্মরণ করে তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গোটা দেশ যেন আবার পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে যায়। এই সময়টাতে অনেকে এমন ছিল, যেন পাকিস্তানের পদলেহন করতে পারলেই তারা কৃতার্থ হন। আজও সে রকম আছেন অনেকে। ২১ বছর পর ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মানুষ আবার স্বাধীনতার সত্য ইতিহাস জানতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালীর এই আত্মত্যাগের দিনটি এখন আর বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়; ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর ইউনেস্কোর এক ঘোষণায় ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপর প্রতি বছরই দিনটি পালন করা হচ্ছে সারা বিশ্বে। বাঙালীর ভাষার সংগ্রামের একুশ এখন বিশ্বের সব ভাষাভাষীর অধিকার রক্ষার দিন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’- এই সুর আমরা এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও শুনতে পাই। এ ব্যাপারে আমাদের আরও কিছু করার আছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ভাষা রক্ষার কাজ এবং গবেষণা বাড়াতে হবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের সব ভাষা রক্ষার দায়িত্ব এখন আমাদের ওপর। সে দায়িত্বটা যেন আমরা যথাযথভাবে পালন করতে পারি। শহীদের রক্ত কখনও বৃথা যায় না, কখনও বৃথা যায়নি, বৃথা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের জন্য আলাদা তহবিল গঠনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, আমি ধন্যবাদ জানাই এই প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উঠে এসেছে। এই প্রতিষ্ঠানটাই হবে বিশ্বে মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণার কেন্দ্র। আশা করি এই প্রতিষ্ঠান হবে বিশ্বের মাতৃভাষার গবেষণার স্থান। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে গবেষণার জন্য আলাদা বরাদ্দের। ইতোমধ্যে আইন করে দেয়া হয়েছে, যেন ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম বন্ধ না হয়। আগামীতে যা যা লাগবে তাই করব। আমাদের সরকার চায় গবেষণা হোক। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের বয়স বেশি দিন না হলেও ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি দেশে-বিদেশে পরিচিতি অর্জন করেছে। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বর্ণমালা ও ভাষা সংরক্ষণ, সেই ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থা করার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও আর সমৃদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষার গবেষণাও এখানে করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এই দেশ আমাদের দেশ, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। ভাষা ব্যবহার ও চর্চায়, সংবাদমাধ্যমে যেন সচেতনতা তৈরি করে আমি সে আহ্বান জানাব। এ ছাড়া ধন্যবাদ জানাই যারা মোবাইল ফোনে বাংলায় এসএমএস পদ্ধতি তৈরি করেছেন তাদের। তিনি বলেন, আমরা চাই মাতৃভাষার ওপর আরও চর্চা হোক। আমরা এই প্রতিষ্ঠানকে আরও সমৃদ্ধ ও উন্নত করতে চাই, যা বিশ্বের মানুষকে আকর্ষণ করবে। এই দেশ আমাদের। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষার প্রচারে আমাদের আরও উদ্যোগ নিতে হবে।
×