ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বত্রই মানুষের ঢল

অশুভ শক্তির বিনাশ ॥ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অঙ্গীকার

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

অশুভ শক্তির বিনাশ ॥ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অঙ্গীকার

মনোয়ার হোসেন ॥ মাগো, ওরা বলে/সবার কথা কেড়ে নেবে/তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না/ বলো, মা, তাই কি হয়? বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা সে কথাকে সত্য হতে দেয়নি। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় নেমেছিল রাজপথে। আত্মপরিচয়ের প্রতিজ্ঞায় অবিচল থেকে রক্ষা করেছিল মায়ের ভাষা ও জাতিসত্তার পরিচয়কে। পরাভব না মেনে বুকের রক্ত ঢেলে শামিল হয়েছিল বায়ান্নর ভাষাযুদ্ধে। ছেলেহারা মায়ের অশ্রু গড়িয়ে এসেছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। রবিবার ছিল সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউরসহ নাম না জানা শহীদদের রক্ত শপথে পাওয়া সেই অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। মাথা নত না করার চেতনাস্নাত মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দিবসটিতে সকাল থেকে রাত অবধি একুশের মর্মবাণী প্রতিধ্বনিত হয়েছে বাঙালীর হৃদয়ের গহীনে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়েছে বর্ণমালার জন্য প্রাণ সঁপে দেয়া সেই অমর শহীদদের। ভাষার স্মারক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেমে এসেছিল শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে আসা জনস্রোত। রাজধানীর সব পথ এসে মিশে গিয়েছিল এই স্মৃতির মিনারে। শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি চেতনার বিচ্ছুরণে উচ্চারিত হয়েছে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। ব্যক্ত হয়েছে অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে হারিয়ে কল্যাণময় ও মানবহিতৈষী দেশ গড়ার প্রত্যয়। একুশের নানা আনুষ্ঠানিকতায় প্রকাশিত হয়েছে অপশক্তিকে রুখে দিয়ে সম্প্রীতির বন্ধনে দারিদ্র্যমুক্ত স্বনির্ভর স্বদেশ নির্মাণের আকাক্সক্ষা। আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার দিনটিতে উচ্চারিত হয়েছে বিশ্ব দরবারে মর্যাদাসম্পন্ন জাতির পরিচয় গড়ে নেয়ার কথা। পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সুসম্পন্নভাবে এগিয়ে যাওয়ায় স্বস্তির সুবাতাসের কথা বলেছেন একুশে উদ্্যাপনে আসা দেশকে ভালবাসা মানুষেরা। সব মিলিয়ে শহীদদের প্রতি ভালবাসা ও আগামীর সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ভাবনায় সারাদেশে দিবসটি পালিত হয়েছে। এদিন শহীদদের স্মরণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। সবখানে উড়েছে শোকের কালো পতাকা। একুশকে স্মরণ করা মানুষেরা ধারণ করেছেন কালো ব্যাজ। দৈনিক পত্রিকাগুলোয় প্রকাশিত হয়েছে অমর একুশে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন ও নিবন্ধ। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর দিনভর প্রচার করেছে একুশের নানা অনুষ্ঠানমালা। সরকারী প্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো পালন করেছে বিশেষ কর্মসূচী। হয়েছে পাড়া-মহল্লায় একুশের অনুষ্ঠান। রাজধানীর অজস্র স্কুলে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ গান-কবিতায় সাজানো অনুষ্ঠান। আর শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের পাশাপাশি অফিস-আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের দাবিটিও উচ্চারিত হয়েছে মুখে মুখে। একুশকে কেন্দ্র করে লাখো মানুষ পথে নামলেও ঘটেনি নিরাপত্তাজনিত কোন সমস্যা কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনা। বিঘœ ঘটেনি শোককে ছাপিয়ে উদ্যাপনে পরিণত হওয়া উচ্ছ্বাসের আবাহনে। একুশের প্রথম প্রহর থেকেই শহীদ মিনারে শুরু হয় ভাষাশহীদদের নিবেদিত শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্ব। মাতৃভাষার গর্বের অনুভব নিয়ে ভোরবেলার প্রভাতফেরিতে সমবেত হয়েছে শেকড়সন্ধানী বাঙালী। প্রভাতফেরি শেষ করে অনেকেই ছুটে গেছেন অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। কেউবা বাংলা একাডেমির মেলা মঞ্চের সামনে বসে উপভোগ করেছেন স্বরচিত কবিতাপাঠের আসর। পোশাক ও মননে চেতনা ঋদ্ধ হয়ে ফাগুনের দিনে রাজধানীর নানা প্রান্তে ঘুরে বেরিয়েছে শহরবাসী। বাবা-মার সঙ্গে বেরুনো শিশুদের কোমল গালে জুড়ে বসেছিল শহীদ মিনার কিংবা বর্ণমালা আঁকা আল্পনা। সব কিছুর মাঝেই যেন ছিল ভাষা আন্দোলন থেকে আহরিত বিপ্লবী চেতনার বহ্নিশিখা। শহরময় যেন নাগরিকদের সঙ্গী করে প্রাণের ভাষা যেন হেঁটে বেরিয়েছে তার বর্ণমালাদের নিয়ে। কবির ভাষায়Ñ ফাগুন এলেই একটি পাখি ডাকে/থেকে থেকেই ডাকে/তাকে তোমরা কোকিল বলবে? বলো/আমি যে তার নাম রেখেছি আশা/নাম দিয়েছি ভাষা ...। মায়ের ভাষার জন্য মৃত্যুকে যাঁরা ভয় না করে বরণ করেছিল সেই সব শহীদরা দিনটিতে পেয়েছেন অমরত্বের মর্যাদায় আপামর মানুষের পরম ভালবাসা। কবির কথায়Ñ অজস্র দিনের মধ্যে জ্বলেছে একুশে ফেব্রুয়ারি/সালাম বরকত শফি রফিক জব্বার/আত্মায় আহত হয়ে তুলেছে উদ্দীপ্ত তরবারি...। বিগত বছরের মতো এবারও একুশে ফেব্রুয়ারিতে বিনম্র শ্রদ্ধায় ভাষাশহীদদের স্মরণ করেছে বীর বাঙালী। দেশজুড়ে নানা আনুষ্ঠানিকতার মাঝে একুশের প্রথম প্রহর রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর একে একে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাতীয় সংসদের স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বী মিয়া, চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ মন্ত্রিপরিষদ সদস্যসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফসহ দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে দ্বিতীয়বার শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা। এ ছাড়াও ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে ১৪ দলের নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীপ্রধান, আইজিপি, এ্যাটর্নি জেনারেল, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও ভাষাসৈনিকরা। রাত দেড়টার দিকে শ্রদ্ধা জানান বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। রাত ১টার পর শহীদ মিনার খুলে দেয়া হয় সবার জন্য। ততক্ষণে মিনারের চারপাশে ঢল নামে সাধারণ মানুষের। পোশাকে শোকের কালো ও শহীদের বুকের খুনে রাঙা ফুল হাতে হাতে দাঁড়িয়েছিলেন সুশৃঙ্খল সারি বেঁধে। ১২টা বাজার অনেক আগে থেকেই আসতে শুরু করেছিলেন তারা। সর্বসাধারণের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা পুষ্পস্তবক হাতে সারিবদ্ধভাবে জানিয়েছেন শ্রদ্ধাঞ্জলি। গভীর রাতে নারী-পুরুষ এমনকি বাড়ির শিশুটিও খালি পায়ে শহীদের প্রতি মমত্ব নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে বেদির সম্মুখে। এ সময় মাইকে ভেসেছে শহীদের রক্ত ঋণে লেখা শোকসঙ্গীতÑ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/ ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি...। এই সুরের সঙ্গে সারারাত চলে শ্রদ্ধা নিবেদনের আনুষ্ঠানিকতা। ভোর পেরিয়ে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলেছে সেই শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন পর্ব। সূর্যোদয়ের আলোয় উদ্ভাসিত শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ যেন নতুন চেহারা পায়। দৃশ্যমান হয় প্রভাতফেরিতে অংশ নেয়া নানা পেশা, শ্রেণী ও বয়সী মানুষের স্রোত। বেলা যত বেড়েছে ফুল দিতে আসা মানুষের সারি তত দীর্ঘ হয়েছে। শাহবাগ, জগন্নাথ হল, পলাশী মোড়, নীলক্ষেত ও ইডেন কলেজের দিক থেকে বানের স্রোতের মতো এসেছে একুশের চেতনাস্নাত জনতা। দুপুর একটা পর্যন্ত লাখো মানুষের দেয়া রাশি রাশি ফুলে ভরে ওঠে শহীদ মিনার। এক সময় শহীদদের নিবেদিত ফুলগুলো দিয়ে বেদিমূলে নান্দনিক আল্পনা সৃজন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাডেট সদস্যরা। বিকেল বেলায়ও সাংস্কৃতিক আয়োজনের টানে ও শহীদদের বিলম্বিত শ্রদ্ধা নিবেদনে আকাক্সক্ষায় শহীদ মিনারে জড়ো হয় হাজার হাজার মানুষ। সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি সেই স্রোতধারা অব্যাহত চলমান থাকে। আট বছরের মেয়ে রোদেলাকে নিয়ে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে এসেছিলেন সূত্রাপুরের বাসিন্দা ডাঃ কাজী শফিক। কাজী শফিকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিনিধির। বলেন, ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালীর জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটেছিল। বাংলা বর্ণমালার জন্য আমাদেরই ভাইয়েরা তাদের প্রাণটি বিসর্জন দিয়েছিলেন। আজ এই দিনটি বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। বাঙালীত্বের এই গৌরবগাথা ও চেতনার পবিত্রতা ছড়িয়ে দিতে চাই আমার মেয়ের মাঝে। সে কারণেই ওকে নিয়ে এসেছি ভাষার জন্য আমাদের অবিস্মরণীয় ইতিহাস ও বোধের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে। এদেশের মানুষের পাশাপাশি ভাষাকে ভালবাসা ভিনদেশী নাগরিকরাও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্্যাপনের আনন্দে শামিল হয়েছিলেন রাজধানীতে। দোয়েল চত্বরের সামনে কথা হয় মাতৃভাষা দিবসের আয়োজন দেখতে আসা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সুনীত কুমার সিনহার সঙ্গে। অবসরপ্রাপ্ত এই ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার মতো দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল। এই বিরল ঘটনাটিই ঘটিয়েছেন এ দেশের ভাষার যোদ্ধারা। তাদের কল্যাণেই আজ সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঠাঁই করে আজ বাংলা ভাষা। পৃথিবীজুড়ে এখন বাংলা ভাষা অহঙ্কার করা হয়। সেই ভাষা দিবসের উদ্্যাপনটি কেমন হয় তা দেখার জন্য আমরা বন্ধুরা মিলে এখানে এসেছি। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়ে ও অমর একুশে গ্রন্থমেলা ঘুরে শোক থেকে উদ্্যাপনে পরিণত হওয়া সেই অভূতপূর্ব অনুভবটুকু গ্রহণ করলাম সবাই মিলে। এবারও শহীদ মিনারের জনস্র্রোত ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা শহরে। শাহবাগ, টিএসসি, পলাশী, দোয়েল চত্বর এলাকা ছিল লোকে লোকারণ্য। ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের পোশাকে ছিল শোকের কালো রং। সাদা-কালো শাড়ি পরে বের হয়েছিলেন নারীরা। পুরুষের পাঞ্জাবিতেও ছিল সাদা-কালো রঙের বিস্তার। জাতীয় পতাকার লাল সবুজটি জুড়ে গিয়েছিল কারও কারও পোশাকে। শহীদ মিনার থেকে অনেকেই সরাসরি চলে যান অমর একুশের গ্রন্থমেলায়। এদিন সকাল ৮টায় খুলে দেয়া হয় মেলার প্রবেশদ্বার। দেখতে দেখতে ভরে ওঠে বাংলা একাডেমি ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান। বিপণি বিতানগুলো ঘুরে একুশ উদ্্যাপনকারী বই দেখেছেন ও কিনেছেন। বাইরে ফুটপাথে বসেছিল হাজারো পণ্যের পসরা। সেখানে জমেছিল জনতার ভিড়। সব মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটি যেন মাতৃভাষার গৌরবে নতুন করে জেগে উঠেছিল। রাত পর্যন্ত চলেছে অভিন্ন উদ্্যাপন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে ছিল নানা আনুষ্ঠানিকতা। বসন্ত দিনের সকালে বাংলা একাডেমির মেলা মঞ্চে স্বরচিত কবিতা পাঠের আসরের আয়োজন করা হয়। সভাপতিত্ব করেন কবি আসাদ চৌধুরী। বিকেলে একই মঞ্চে ছিল অমর একুশের বক্তৃতা। আবাসন : বিশ্বে ও বাংলাদেশে শীর্ষক একুশে বক্তৃতা করেন সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। স্বাগত ভাষণ দেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। সভাপতির বক্তব্যে আনিসুজ্জামান বলেন, আজকের একুশে বক্তৃতার এই সময়ে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা-আন্দোলনে আহত সংগ্রামীরা চিকিৎসা নিচ্ছিলেন হাসপাতালে, ভাষাশহীদদের কারও কারও লাশ ছিল মর্গে, মেডিক্যাল কলেজে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছাত্রদের বক্তৃতা চলছিল, প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক পরিষদেও ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলনের উত্তাপ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল আমরা বুঝি হেরে গেলাম। কিন্তু শেষ বিচারে বাংলা ভাষা ও আমাদেরই বিজয় ঘোষিত হলো। সকালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিশু-কিশোরদের সাংস্কৃতিক সংগঠন কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা। আলোচনা সভা এবং নাচ-গানের সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় সাজানো হয় অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন ভাষা সংগ্রামী ডাঃ মোহাম্মদ শফিকুর রহমান। আলোচনায় আরও অংশ নেন মেলার সহ-সভাপতি দিল মনোয়ারা মনু, এ বছর শিল্পকলায় একুশে পদকপ্রাপ্ত মেলার উপদেষ্টা সদস্য আমানুল হক এবং শিশু বক্তা অরুনিমা ও দিবা। সভাপতিত্ব করেন মেলার পরিচালক খোন্দকার খালেদ ইব্রাহিম খালেদ। অনুষ্ঠানে সুন্দর হাতের লেখা, শুদ্ধ বানান ও বক্তৃতা প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হয়। অনুষ্ঠানে ‘শহীদ বরকতের রক্তে আমার শরীর ভিজে যায়’ শিরোনামের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করেন মোহাম্মদ শফিকুর রহমান। তার স্মৃতির বয়ানে উঠে আসে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি সেই উত্তাল দিনটির কথা। সভাপতির বক্তব্যে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, মূলত বাঙালী জাতিসত্তার স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা হয় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। বায়ান্নর পথ ধরেই রচিত হয়েছিল বাঙালীর মুক্তির সনদ ছয় দফা থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হলেও কাক্সিক্ষত সেই মুক্তি আজও অর্জিত হয়নি। দারিদ্র্য, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার মূলোৎপাটন করার মাধ্যমেই অর্জিত হবে সেই কাক্সিক্ষত মুক্তি। বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দেশী-বিদেশী শিল্পীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। দেশের শিল্পীদের সঙ্গে ভিন্ন ভাষার গান পরিবেশন করেন বিদেশী শিল্পীরা। অমর একুশের গান দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। ভিন্ন ভাষার গান শোনায় ভুটান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, চীন, জাপান, নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, রাশিয়া ও মালদ্বীপের শিল্পীরা। দেশের খ্যাতিমান শিল্পী আবিদা সুলতানা ভিয়েতনামের কিংবদন্তি নেতা হো চি মিন স্মরণে একটি সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এ ছাড়া সন্ধ্যায় একাডেমির নন্দন মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় নাচ-গান ও কবিতায় সজ্জিত সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভাষাশহীদদের কবর জিয়ারত করাসহ মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে। বসন্ত বিকেলে ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবরে অনুষ্ঠিত হয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের একুশের অনুষ্ঠানমালা। ‘রাষ্ট্র চলবে বাংলায়, না চলা অন্যায়’ সেøাগানে ১৪ দিনব্যাপী এ আয়োজনের শেষ দিন ছিল রবিবার। এই দিনের পরিবেশনায় ছিল গান, কবিতা ও পথনাটকের উপস্থাপনা। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভাষাশহীদদের কবর জিয়ারত করাসহ মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে। এভাবেই বহুমাত্রিক আনুষ্ঠানিকতায় প্রতি ফাল্গুনের মতোই যেন ৬৪ বছর পর আবার দিনটিতে সেই সব শহীদ জেগে উঠেছিল এবং জাগিয়ে গেল জাতিকে। বলে গেল, তাঁরা ভাষা চায় ও অপরকে ভাষা দেয়।
×