ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

নিষিদ্ধ হচ্ছে জামায়াত

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

নিষিদ্ধ হচ্ছে জামায়াত

গত ১১ ফেব্রুয়ারিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠার একটা খবরের হেডলাইন থেকে আজকের শিরোনামটি নিয়েছি। প্রতিবেদন লিখেছেন, যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩-এর দুটি ধারায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনাসহ অনেক ধারায় পরিবর্তন, সংযোজন ও সংশোধন আনছে সরকার। ইতোমধ্যে সংশোধিত ও সংযোজিত অংশের খসড়াও প্রস্তুত করেছে আইন মন্ত্রণালয়। উল্লিখিত খবরের হেডলাইন প্রতিবেদক প্রশ্নবোধক রেখেছিলেন। কিন্তু আমি শিরোনামটি প্রশ্নবোধক রাখিনি। কারণ, আমরা যদি একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশ চাই তাহলে সেখানে জামায়াত থাকতে পারে না। জামায়াত আর বাংলাদেশ এক কাতারে চলতে পারে না। জামায়াত ও তাদের রাজনীতিসহ যে বাংলাদেশ হয়, সেই বাংলাদেশের জন্য আমরা ২৩ বছর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিনি, একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষের জীবন উৎসর্গ করিনি। সুতরাং জামায়াত থাকবে কি থাকবে না সেটিকে এখন আর প্রশ্নবোধকে রাখা যাবে না। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দ-াদেশের পর জামায়াত-শিবির যখন জাতীয় পতাকা পুড়িয়েছে, শহীদ মিনার ভেঙ্গেছে তখনই তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের দর্শন ও চেতনার পক্ষে যে জোয়ার উঠেছে, তাতে এবার আর জামায়াতকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এখন একটাই প্রশ্ন জামায়াত কবে নিষিদ্ধ হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করেছে। আদালত তাদের পর্যবেক্ষণে আরও বলেছে রাষ্ট্রের ও সমাজের সব অঙ্গন থেকে জামায়াতি আদর্শে বিশ্বাসী মানুষকে অপসারণ করতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশের সব অর্জন ওরা বিনষ্ট করবে এবং পেছন থেকে অগ্রগতির পিঠের ওপর কুড়াল মারবে। আদালতের দ্বিতীয় এই পর্যবেক্ষণটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াত এখন অর্ধ নিষিদ্ধ অবস্থায় আছে। আদালতের আদেশে তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। তাই বলা যায় জামায়াত পুরোপুরি নিষিদ্ধ হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, এই নামের দলটি নিষিদ্ধ হলেই কি জামায়াত ও তাদের ঔরসজাত ধর্মান্ধ জিহাদী জঙ্গীদের কবল থেকে বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃত মুক্তিলাভ করবে? নাকি আরও গভীরে যেতে হবে। জামায়াতের রাজনীতির মূল আদর্শ ওয়াহাবিতন্ত্র বা ওয়াহাবিবাদ। এই মতবাদের প্রবর্তক মুহম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব, যিনি ১৭০৩ সালে বর্তমান সৌদি আরবে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৭৯২ সালে মারা যান। ওয়াহাবি মতে সুন্নিরাই বিশুদ্ধ মুসলমান শিয়াসহ অন্য মতাবলম্বীরা মুসলমান নয়। ওয়াহাবি মতে গণতন্ত্র হচ্ছে মানব রচিত শয়তানি বিধান। তাদের মতে মুসলমান প্রধান রাষ্ট্র চলবে শরিয়া আইন অনুসারে। শরিয়া আইনের রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটা নমুনা দেখা যায় আফগানিস্তানের তালেবান শাসনামলে। পাকিস্তানে শরিয়া আইন চালু করেছিলেন সামরিক শাসক জিয়াউল হক। যিনি বিশ্বব্যাপী উগ্র জঙ্গীবাদ বিস্তারে মূল হোতা হিসেবে কাজ করেন। সেই সুবাদে পাকিস্তান আজ জঙ্গী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত। পাকিস্তানের জঙ্গীরা এখন নিজ দেশের স্কুলের কোমলমতি শিশুদেরও বোমা-গ্রেনেড মেরে হত্যা করছে। জামায়াতের গুরু আবুল আলা মওদুদীর হুকুমে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানের লাহোরে কাদিয়ানি হত্যাকা-ের তদন্ত কমিটির প্রধান পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মুহম্মদ মুনির এক ডজনের ওপর বড় বড় ধর্মীয় নেতা ও আলেমদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বিশুদ্ধ মোমিন বা একজন প্রকৃত মুসলমান কে? এ প্রশ্নের উত্তরে ধর্মীয় নেতারা কেউ কারও সঙ্গে একমত হতে পারেননি, এমনকি দু’জন ধর্ম নেতা একমত পোষণ করতে পারেননি (মৌলবাদ-মাসুদুল হক, পৃ. ৮০)। একবিংশ শতাব্দীতে তো বটেই, কোনকালেই এই কট্টর ধর্মান্ধ মতবাদের প্রতি কোন দেশেই বৃহত্তর জনগণের কোন সমর্থন ছিল না, এখনও নেই। ইরাক-সিরিয়ার আইএস এখন কট্টর ওয়াহাবিবাদের চরম বহির্প্রকাশ। সৌদি আরব এবং মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যান্ড মুফতি কমিটি বলেছে, আইএস যা করছে তার মধ্যে কোন ইসলাম নেই, বরং তারা ইসলাম ধর্মের ভয়াবহ অবমাননা ও ক্ষতি করছে। বাংলাদেশের জামায়াত ওয়াহাবিতন্ত্রে বিশ্বাসী সেটা তাদের দলের মেনিফেস্টো এবং কর্মসূচী দেখলেই বোঝা যায়। জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট, হেফাজত যে নামেই ডাকা হোক না কেন এরা সবাই এবং এদের বর্ধিত অংশ জিহাদী জঙ্গী সংগঠন জেএমবি, জেএমজেবি, হরকাত-উল-জিহাদ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ইত্যাদি সবার আদর্শ এবং লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। এর ভূরি ভূরি প্রমাণ ইতোমধ্যে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকার কারণে ’৭২ সালে জামায়াত বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়। পাকিস্তানের ২৩ বছরে রাজনৈতিক ইসলাম এবং রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের তিক্ত অভিজ্ঞতায় বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়। ফলে জামায়াতের পুনরুত্থানের সুযোগ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু পঁচাত্তরের পর জিয়াউর রহমান সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারা বাতিল করে দিলে প্রথমে আইডিএল (ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ) নামে জামায়াত রাজনীতির মাঠে নামে। আইডিএলের প্রথম আমির হন মাওলানা আবদুর রহিম। তারপর সুযোগ মতো খোলস ফেলে দিয়ে স্বনামে আত্মপ্রকাশ করে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। তাদের আদর্শ, লক্ষ্য, কর্মসূচী সবকিছু আগের পাকিস্তানের সময়ের মতো অপরিবর্তিত থাকার পরও তারা রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার সুযোগ পায়। কিছু দিনের মাথায় গোলাম আযম পাকিস্তান ও লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন জারি রেখে বাংলাদেশে আসেন এবং পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে জামায়াতের আমির হন। বাংলাদেশের মানুষ, ৩০ লাখ শহীদ এবং সব মুক্তিযোদ্ধার জন্য এটা ছিল লজ্জাকর চপেটাঘাত। একজন বীরউত্তম খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা হয়ে জামায়াত এবং গোলাম আযমকে প্রথম সুযোগটি দেন জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্ভাগ্যের রজনী সেখান থেকেই শুরু, যে রজনীর ভোর এখনও আসেনি। রজনী কেটে ভোর কখন হবে তা নিয়ে এখনও চলছে আলাপ, আলোচনা এবং বিচার বিশ্লেষণ। জাতি হিসেবে আমরা যদি সামনের দিকে এগোতে চাই তাহলে দল, হিসেবে তো বটেই, জামায়াতের ধর্মান্ধ উগ্র জিহাদী আদর্শবাদের পক্ষে কথা বলাও বন্ধ করতে হবে। সেটি কিভাবে করা যায় তার উদাহরণ ইতিহাসেই আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরাজিত জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য মিত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে লিপজিগ (জার্মানের একটি শহরের নাম) ট্রায়ালের আয়োজন করা হয়। তবে বিচারের দায়িত্ব জার্মানির ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু দেখা গেল ৯০০ অভিযুক্তের মধ্যে মাত্র দু’জন শাস্তি পেল, বাকিরা সব খালাস পেয়ে গেল। খালাস পাওয়ার মধ্যে একজন ছিলেন ফিল্ড মার্শাল ভন হিল্ডেনবার্গ, যিনি তিরিশের দশকের শুরুতে জার্মানির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এই হিল্ডেনবার্গের ছত্রছায়ায় এবং আদর্শে ১৯৩৩ সালে এডলফ হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হন। হিটলারের উগ্র জাতীয়তাবাদী উন্মাদনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়। তাতে ২৭টি দেশের ৬.৪ কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটে, যার মধ্যে প্রায় ৪ কোটি ছিল বেসামরিক নিরীহ মানুষ। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ব্রিটেনসহ মিত্রপক্ষ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন যাতে হিল্ডেনবার্গ ও হিটলারের উগ্রবাদ যেন ইউরোপে আর কখনও মাথাচাড়া দিতে না পারে। স্বল্প সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হয় এবং শাস্তি কার্যকর করা হয়। একই সঙ্গে হিটলারের নাজি দলসহ ছয়টি সংগঠনকে চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। আইন করা হয় হিটলারের আদর্শের পক্ষে কথা বলা হবে দ-নীয় অপরাধ। এই আইন এখনও বলবৎ আছে (পল রোনাল্ড-দ্য নূরেমবার্গ ট্রায়াল, লন্ডন, ২০১২)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের অনেক বিশ্লেষক বলেছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানের যুদ্ধাপরাধের বিচার যদি ঠিকমতো হতো এবং উগ্রবাদকে নিষিদ্ধ করা হতো তাহলে এত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় দৃশ্য বিশ্ববাসীকে দেখতে হতো না। তাই জামায়াত ও তাদের উগ্র আদর্শের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জঙ্গী উত্থান ও তৎপরতার বিভীষিকাময় দৃশ্য বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। জামায়াত প্রসূত জেএমবি নেতা সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই নিজস্ব স্টাইলের শরিয়া আইন চালু করে রাজশাহীর বাঘা এলাকায় ২৩ জন মানুষকে হত্যা করে। তারা আবার সুযোগ পেলে বাংলাদেশকে পাকিস্তান-আফগানিস্তান বানিয়ে ছাড়বে। একদল ছদ্মবেশী বুদ্ধিজীবী বলে বেড়ান জামায়াত নিষিদ্ধ হলে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে জঙ্গী সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাবে। এটা বিভ্রান্তমূলক ও প্রতারণাপূর্ণ বক্তব্য। কারণ, ইতোমধ্যে ছদ্ম নামে জামায়াতপ্রসূত কয়েক ডজন জিহাদী সন্ত্রাসী গ্রুপের আন্ডারগ্রাউন্ড তৎপরতা রাষ্ট্র সাফল্যজনকভাবে মোকাবেলা করেছে। অতিরিক্ত জামায়াত শিবিরের প্রকাশ্য অংশ আন্ডারগ্রাউন্ডে গেলে তাদেরও সন্ত্রাসী হিসেবে একইভাবে মোকাবেলা করতে হবে। জঙ্গী সন্ত্রাসী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ এখন আর একা নয়। এটা এখন এই অঞ্চল ও বিশ্বের চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ আঞ্চলিক সমন্বয় ও সহযোগিতার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে। এটাই কঠিন বাস্তবতা। সব চ্যালেঞ্জ জেনেই বাংলাদেশের মানুষ জামায়াত থেকে মুক্ত হতে চায়। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×