ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

বাংলাদেশে টেলিকম শিল্পে ধস

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বাংলাদেশে টেলিকম শিল্পে ধস

বাংলাদেশের টেলিকম শিল্পে ধস নামতে শুরু করেছে। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর বাংলালিংকে। বড় আকারে কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু করার পর থেকেই ঝামেলা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় অফিসে বেশ বড়সড় বিবাদে জড়িয়ে পড়েন কর্তৃপক্ষ বনাম কর্মীরা। তাদের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা প্রায় ৯ ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিলেন। চলমান সঙ্কট নিরসনে ৬ দফা দাবি এবং একদিনের সময় দিয়ে আল্টিমেটাম দিয়েছে ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা। গত মঙ্গলবার সকালে বাংলালিংকের সিইও বরাবর এ দাবিপত্র জমা দিলে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করেছে। নেতারা গণমাধ্যমকে বলছেন, দাবি মানা না হলে নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে। এবারে একটু দেখে নেয়া যাক কী আছে ওই ৬ দফার দাবিতে। ১. মানসিকভাবে নির্যাতনের অসুস্থ ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক মোশতাক আহমেদকে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। প্রয়োজন হলে দেশের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। ২. যারা মোশতাক আহমেদকে নির্যাতন করেছে তাদের খুঁজে বের করে বাংলালিংক থেকে বহিষ্কার করা। ৩. সদ্য বাংলালিংক থেকে চাকরিচ্যুত ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন্স ডিপার্টমেন্টের প্রধান প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়াকে পুনরায় চাকরিতে ফেরত নেয়া। ৪. অবৈধভাবে বাংলালিংকের যেসব কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা। ৫. স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসর নেয়ার সময় ন্যূনতম জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা। ৬. অফিসে কাজের পরিবেশ তৈরি করতে ভীতিকর যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা প্রত্যাহার করা। প্রথম অভিযোগটি হলো- একজন কর্মীকে প্রশাসন নির্যাতন করেছে। তিনি এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হাসপাতালে নিয়ে গেলে দেখা যায় তার হার্ট এটাক হয়েছিল। অর্থাৎ বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ এমন নির্যাতন করতে পারে, যার কারণে একজন কর্মীর হার্ট এটাক হতে পারে। ট্রেড ইউনিয়ন করার জন্য বাংলালিংক তাদের প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়াকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়। একটি প্রকৌশলী দলকে কেন ট্রেড ইউনিয়ন করতে হয় এই প্রশ্নটি এখানে নিশ্চয়ই আসতে পারে। বাংলালিংক বড় আকারে কর্মী ছাঁটাই করতে যাচ্ছে। সেটাকে ঠেকানোর জন্যই তারা ট্রেড ইউনিয়ন করতে গিয়েছেন। এ বছর বাংলালিংক প্রায় ৭০০ মানুষ ছাঁটাই করবে এবং এই ফেব্রুয়ারিতেই তাদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে বাংলালিংক। তবে ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা চাইছেন, সেটা জুন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হোক। তবে সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো শেষের দফাটিÑ অফিসে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। আরও একটি তথ্য জানা গেছে, বাংলালিংক আগামী ৩ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশে অপারেশন খুব ছোট করে ফেলবে। সেটা ২ হাজার ২০০ থেকে নেমে দাঁড়াতে পারে ৪০০ লোকের প্রতিষ্ঠানে। কেন এই বিশাল পরিবর্তন? বাংলাদেশের টেলিকম শিল্পে আরও একটি বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। এয়ারটেল এবং রবি এই দুটি অপারেটর মিলে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে যাচ্ছে। অন্যদিকে সিটিসেল তো দীর্ঘদিন ধরে বিটিআরসির দেনাই পরিশোধ করতে পারছে না। অর্থাৎ বাজার আরও সঙ্কুচিত হতে চলেছে। বিষয়গুলোর আরেকটু ভেতরে যাওয়া যাক। ॥ দুই ॥ বাংলাদেশের শীর্ষ দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল ফোন অপারেটর বাংলালিংক এই ফেব্রুয়ারিতে ১২ বছরে পা দিয়েছে। ২০০৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলালিংক নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে বাংলালিংকের নতুন সিইও এরিক অস্ (যিনি এক সময় গ্রামীণফোনের সিইও ছিলেন) ১০ ফেব্রুয়ারিকে বর্ষপূর্তি হিসেবে সবাইকে মেইল করেছেন। বাংলালিংকের তৎকালীন মূল কোম্পানি ওরাসকম তখন ‘সেবা টেলিকম’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে কিনে নেয়। তখন গ্রাহক ছিল মাত্র ৪৫ হাজার। আর ১১ বছর শেষে তাদের গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ২৮ লাখ ৬৫ হাজার এবং প্রায় দেড় কোটির বেশি ইন্টারনেট সংযোগও রয়েছে। মোট গ্রাহকের ২৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ এখন বাংলালিংকের দখলে। বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, ১৯৮৯ সালে ‘সেবা টেলিকম (প্রা.) লিমিটেড’ বাংলাদেশের ১৯৯টি গ্রামীণ উপজেলায় টেলিফোন সেবা প্রদানের লক্ষ্যে নিবন্ধীকরণ করে। ওরাসকম টেলিকম ২০০৪ সালের জুলাই মাসে সেবা টেলিকমের মালয়েশিয়ান অংশীদারিত্ব কিনে নেয়। এখানে ওরাসকমের সঙ্গে ২৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি গোপনে সম্পাদিত হয়। সেবা টেলিকমের বাংলাদেশী অংশীদার ‘ইন্টিগ্রেটেড সার্ভিসেস লিমিটেড’ (আইএসএল) প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মালয়েশীয় অংশীদার টেকনোলজি রিসোর্স ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার ১৫ মিলিয়ন ডলারে কিনেছে বলে দেখানো হয়। আইএসএল পরে আরও ১০ মিলিয়ন ডলার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংককে পরিশোধ করে সেবার দায় শোধ করে। ওরাসকম টেলিকম ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেবা টেলিকমের ১০০% শেয়ার কিনে নেয়। তারা ৬০ মিলিয়ন ডলার মূলধন বিনিয়োগ করে এবং টেলিফোন ব্র্যান্ডের নাম পরিবর্তন করে রাখে বাংলালিংক। বাংলালিংকের লাইসেন্স ১৫ বছর মেয়াদী। ওরাসকম টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড (বাংলালিংক) সম্পূর্ণরূপে মিসরীয় কোম্পানি ওরাসকম টেলিকম হোল্ডিং এসএই (ওটিএইচ)-এর মালিকানাধীন ছিল। ২০১৪ সালে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক কোম্পানি ভিম্পেলকম (যারা গ্রামীণফোনেরও মালিক) এ দেশে অপারেটরটির সব শেয়ার কিনে নেয় ওরাসকমের কাছ থেকে। শুরুতে বাংলালিংকের ডোরাকাটা লোগোর নিচের ছোট ইংরেজী হরফে ‘এ্যান ওরাসকম টেলিকম কোম্পানি’ লেখা থাকলেও ভিম্পেলকম দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১৪ সালে লোগো থেকে ওই অংশটি সরিয়ে ফেলা হয়। যদিও ভিম্পেলকমের মূল অফিস নেদারল্যান্ডসে, তবে এটি একটি রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান। এর অনেক উত্থান-পতন রয়েছে। এরা প্রতিষ্ঠানটিকে রেজিস্ট্রেশন করিয়েছে বারমুডাতে এবং রাশিয়া, ইতালি, উক্রেইন, আলজেরিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ইত্যাদি দেশে তাদের টেলিকম অপারেশন রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটির ৫৬.২% মালিক হলো রাশিয়ার আলফা গ্রুপ। আর ৩৩%-এর মালিক হলো টেলিনর (গ্রামীণফোনের মূল প্রতিষ্ঠান)। সেই হিসেবে টেলিনরের বাংলাদেশে গ্রামীণফোন এবং বাংলালিংকের মালিকানা রয়েছে। বাংলাদেশের বাজারে জোর গুজব রয়েছে যে, ভিম্পেলকমে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের অংশীদারিত্ব রয়েছে। বাংলালিংক প্রায় এক যুগ ধরে বাংলাদেশে অপারেট করার পর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যে, বাংলাদেশের বাজারে আর করার কিছুই নেই। যেটুকু মধু খাওয়ার তা হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। ॥ তিন ॥ বাংলাদেশে আরও দুটি বড় মোবাইল অপারেটর এয়ারটেল এবং রবি একত্রীভূত হতে যাচ্ছে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে এই বিষয়ে একটি গণশুনানির আয়োজন করে বিটিআরসি। গণশুনানির অর্থ হলো, যদি কারও কিছু বলার থাকে তাহলে সেটা সেখানে গিয়ে বলা যেতে পারে। ওখানে গিয়ে দাবি দিলেই যে তা গৃহীত হবে তা নয়; তবে ভবিষ্যতের ঝামেলা থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে এটা করা হয়েছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে মোবাইল ফোন অপারেটর রবি ও এয়ারটেল ব্যবসা পরিচালনা একীভূত করার জন্য বিটিআরসি বরাবর আবেদন করে। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে অনুষ্ঠিত কমিশনের ১৮৯তম সভায় বেশকিছু শর্তসাপেক্ষে একীভূত হওয়ার প্রস্তাবটি পূর্বানুমতি গ্রহণের জন্য ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং শর্ত প্রতিপালনের জন্য প্রতিষ্ঠান দুটিকে চিঠি দেয়। বাংলাদেশে এই ধরনের বড় দুটি কোম্পানির একীভূত হওয়ার ঘটনা বিরল এবং দেশের মোবাইল ফোন খাতে প্রথম হওয়ায় কমিশন ১৯২তম বৈঠকে একীভূত হওয়ার আর্থ-সামাজিক ও কারিগরি ফলাফল এবং প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সমীক্ষা পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরবর্তীতে গত ২৫ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে মহামান্য হাইকোর্ট রবি ও এয়ারটেল একীভূতকরণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কমিশনের মতামত সংবলিত প্রতিবেদন আগামী ৭ মার্চ ২০১৬ তারিখের মধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ বরাবর প্রেরণের জন্য কমিশনকে নির্দেশনা প্রদান করেছে। ওই নির্দেশনা মোতাবেক ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখের মধ্যে সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা প্রদানের জন্য বিশেষজ্ঞ দলকে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, যে কোন সময় এই দুটি প্রতিষ্ঠান এক হয়ে যাবে। বাকিটা শুধু সময়ক্ষেপণ। গ্রাহক সংখ্যার দিক থেকে বর্তমানে তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে থাকা রবি ও এয়ারটেল এক হলে গ্রামীণফোনের পরে এটিই হবে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ মোবাইল অপারেটর। গ্রাহক সংখ্যা হিসেবে বর্তমানে দ্বিতীয় স্থানে আছে বাংলালিংক। ভারতীয় এয়ারটেলের বাংলাদেশে অপারেট করতে আসার ইতিহাসটিও বেশ জটিল। এই প্রতিষ্ঠানটির প্রথম লাইসেন্স নিয়েছিল ওয়ারিদ টেলিকম। দুবাইভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে এমন একটি রটনা ছড়াতে সক্ষম হয় যে, বাংলাদেশের টেলিকম শিল্পকে পাল্টে দেবে তারা। বাজারে এমন গুজবও শোনা গিয়েছিল যে, বিনামূল্যে সকল গ্রাহককে মোবাইল দেবে ওয়ারিদ। তারপর ধীরে ধীরে মুনাফা গুনবে তারা। দুবাইয়ের প্রিন্সদের টাকা বলে কথা। সেগুলো বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে ঢাললে ভালই তো! সেই সময় অনেক ওয়ারিদ কর্মী এগুলোই বলতেন। এর কারণও ছিল বটে। সেই সময় বাজারে জোর গুজব ছিল যে, এই লাইসেন্স পেতে ৫ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দিতে হয়েছিল। পরবর্তীতে ওয়ারিদের এই লাইসেন্স কেলেঙ্কারি নিয়ে মামলাও হয়েছে। বিখ্যাত নাহিয়ান গ্রুপের আরও অনেক প্রজেক্ট হওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশে। সেই লোভ দেখিয়ে, কথা শুনিয়ে প্রথমেই টেলিকম লাইসেন্স নেয় তারা। তবে যে আশা ওয়ারিদের বাংলাদেশের কর্মী এবং মানুষ ভাবতেন সেই আশা তাদের পূরণ হয়নি। ওয়ারিদ টেলিকম সেবায় ভাল করেনি। তবে কেলেঙ্কারির এখানেই শেষ নয়। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে তারা প্রতিষ্ঠানটির ৭০ ভাগ মাত্র ১ লাখ ডলারে (তৎকালীন প্রায় ৬৫ লাখ টাকায়) এয়ারটেলের কাছে বিক্রি করে দেয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে এয়ারটেল বাকি ৩০ ভাগও কিনে নেয়। একটি মোবাইল কোম্পানি মাত্র ১ লাখ ডলারে বিক্রি হতে পারে, এতে পুরো শিল্পের মানুষ অবাক হয়। মূলত কর ফাঁকি দেয়ার জন্যই এই কাজটি করা হয়। বাংলাদেশে মূল্য দেখানো হয় ১ লাখ ডলার। আর বাকি লেনদেন হয়ে যায় বিদেশের মাটিতে। উল্লেখ্য, একীভূত হওয়ার পর মালয়েশিয়ার ‘আজিয়াটা গ্রুপ বারহাদ’ ও জাপানের ‘এনটিটি ডোকোমো’-এর কাছে থাকবে প্রতিষ্ঠানটির ৭৫ শতাংশ শেয়ার। বাকি ২৫ শতাংশের মালিকানা থাকবে ভারতী এয়ারটেলের। চলমান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে বরাদ্দ দেয়া তরঙ্গও ব্যবহার করবে একীভূত প্রতিষ্ঠানটি। টুজি ও থ্রিজি লাইসেন্সের আওতায় প্রতিষ্ঠান দুটিকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মোট ৩৯ দশমিক ৮ মেগাহার্টজ তরঙ্গ। এর মধ্যে টুজির তরঙ্গ হিসেবে ৯০০ মেগাহার্টজ ব্র্যান্ডে রবির ৭.৪ ও এয়ারটেলের ৫ মেগাহার্টজ এবং ১৮০০ মেগাহার্টজ ব্র্যান্ডে রবির ৭.৪ এবং এয়ারটেলের ১০ মেগাহার্টজ বরাদ্দ রয়েছে। এছাড়া থ্রিজির তরঙ্গ হিসেবে দুটি প্রতিষ্ঠানকেই ২১০০ মেগাহার্টজ ব্র্যান্ডে ৫ মেগাহার্টজ করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ॥ চার ॥ অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে, আগামীতে বাংলাদেশে মূলত দুটি মোবাইল অপারেটর প্রতিযোগিতা করবে। প্রথমে থাকবে গ্রামীণফোন এবং দ্বিতীয় নম্বরে থাকবে রবি-এয়ারটেল যৌথ প্রতিষ্ঠান। তৃতীয় স্থানে থাকবে ছোট আকারে বাংলালিংক। তবে এখানে কয়েকটি বিষয় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ক) বাংলাদেশের টেলিকম ইতিহাসে গ্রামীণফোন ছাড়া আর কোন মোবাইল অপারেটরের বাৎসরিক অডিট হয়নি। বিটিআরসি বিভিন্ন সময় ক্ষুদ্র প্রয়াস নিয়েছিল। কিন্তু সেগুলো কাজে লাগাতে পারেনি। সরকার এই মোবাইল অপারেটরগুলো থেকে শতকরা ৫ শতাংশের বেশি রেভিনিউ শেয়ার পাবার কথা। এখন পর্যন্ত মোবাইল অপারেটররা যা হিসাব দিয়ে আসছে সেটাকেই মেনে নিয়ে সরকার তার অংশ বুঝে নিচ্ছে। নিয়মানুযায়ী এটা অডিট করানোর কথা। নইলে সরকার নিশ্চিত হচ্ছে কিভাবে যে, তার হিসাব সঠিক হচ্ছে? বিগত ১৫ বছরেও বিটিআরসি এটা করতে পারেনি। এর থেকে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে। এখন এগুলোর খেলা শেষের দিকে। আর কখনই এই রেভিনিউ পাওয়া যাবে না। খ) দীর্ঘদিন অপারেট করার পরও গ্রামীণফোন ছাড়া (সম্প্রতি রবি) লাভ ঘোষণা করেনি। এরা দেখিয়েছে, এখানে তারা বিনিয়োগ করেছে; কিন্তু লাভ হচ্ছে না। এমনকি বাংলালিংকের মতো বিশাল প্রতিষ্ঠান ৩ কোটির উপর গ্রাহক নিয়েও নিজের মুনাফা দেখায়নি। এরা বলেছে, ক্ষতিতে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ ১২ বছর ক্ষতিতে ব্যবসা করে যাচ্ছে, এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য? এরা তাদের মুনাফা নিয়ে গেছে অনেক আগেই, বহুগুণ। সেটা গ্রামীণফোনের মুনাফা দেখলেই বুঝা যায়। কিন্তু এটা নিয়ে কারও কোন উচ্চবাচ্য নেই। এখন যদি অপারেশন ছোট করে ফেলা হয় তাহলে তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সরকার যে কত হাজার কোটি টাকা হারিয়েছে সেই হিসাব কে রাখে? গ) একটা বিষয় খেয়াল করা যেতে পারে, একমাত্র গ্রামীণফোন ছাড়া আর কোন অপারেটর থ্রিজির জন্য ৫ মেগাহার্টজের বেশি ব্র্যান্ডউইডথ নেয়নি। গ্রামীণফোন নিয়েছে ১০ মেগাহার্টজ। বাকিরা কেন ৫ মেগাহার্টজ করে তরঙ্গ নিয়েছিল? তাহলে তারা কি আগে থেকেই জানত যে, বেশি তরঙ্গ কিনে লাভ নেই? নয়ত, তারা আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল যে, ৫ মেগাহার্টজ করে কিনে তারপর দুটি প্রতিষ্ঠানকে একত্রে করলে মোট ১০ মেগাহার্টজ হয়ে যাবে। এই তরঙ্গ বাবদ সরকার যা পরিকল্পনা করেছিল সেই পরিমাণ মুনাফা পায়নি। তখন বিটিআরসি বেশ মনক্ষুণœ হয়েছিল। ঘ) টেলিকম ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কাজের জায়গা। বাংলাদেশের অনেক ভাল ভাল ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রফেশনালের ভাল কাজের জায়গা ছিল এই ক্ষেত্রটি (যদিও এখানে দুর্নীতির কোন সীমা নেই)। বড় ধরনের এই পরিবর্তনের ফলে, বড় অংশের একদল কর্মী চাকরি হারাবেন এবং একই ধরনের কাজের জায়গা আর তৈরি হয়নি। এই লোকগুলো এক ধরনের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে পড়বেন। বড় একটি অংশ দেশ ছাড়বেন। দেশে আর কোন খাত তৈরি হয়নি কেন? ॥ পাঁচ ॥ বাংলাদেশের পরবর্তী বড় খাত কোন্টি? বাংলালিংকের ঘটনাগুলো যেদিন ঘটে সেদিন কিভাবে যেন ঠিক ভবনটির সামনেই আমি ছিলাম। সেখানে কর্মীদের মিছিল, পুলিশের ব্যারিকেড, ডগ স্কোয়াডের মহড়া, কর্মীদের দৌড়াদৌড়ি- সবই নিজের চোখে দেখেছি। গেটের সামনে গিয়ে ছবি তুলেছি। মোবাইলে ভিডিও করেছি। খারাপ লেগেছে। বাংলাদেশে অনেক বিতর্কিত বিষয়ের জন্ম দিয়েছিল বাংলালিংক। তবুও আমার দেশের ছেলেমেয়েরা ওখানে কাজ করে। তাদের এই পরিণতি কি আমরা চেয়েছিলাম? অবশ্যই নয়। আমাদের দেশে কাজের পরিধি খুব কম, বিশেষ করে হাইটেক শিল্পে। সেখানে এ ধরনের হুট করে পরিবর্তন ওই ছেলেমেয়েগুলোর জীবনে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়ে যাবে। তারপর যখন রবি আর এয়ারটেল একীভূত হবে, তখন আরও কিছু মানুষের চাকরি চলে যাবে। সমাজে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বৈকি! কেউ কেউ হয়ত দেশ ছেড়ে বিদেশেও চলে যেতে পারেন। কিন্তু এই বড় একটি প্রফেশনাল দলকে কাজে লাগানোর ভাল জায়গা কি আমাদের আছে? বাংলাদেশের পরবর্তী বড় খাতটি হতে পারে সফটওয়্যার। টেলিকম ইনফ্রাস্ট্রাকচার তো তৈরি হয়ে গেছে। এখন ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে সেই গ্রামের ভেতর। এটাকে ভিত্তি করে বাংলাদেশে তৈরি হতে পারে শক্তিশালী সফটওয়্যার শিল্প। সরকার যদি সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয় তাহলে এই শিল্পটি পরবর্তী বড় একটি শিল্প হয়ে ধরা দিতে পারে। সফটওয়্যারকে এখনও বাংলাদেশে শিল্প হিসেবে বলা যাবে না। তবে এন্টারপ্রেনার, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে এলে এটাও পাল্টে দিতে পারে বাংলাদেশ। লেখক : সম্পাদক, প্রিয়.কম ys@pri“o.com
×