ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পরম্পরা

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

পরম্পরা

থানার বড় দারোগা ঘন ঘন বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসে। এই নিয়ে বাড়ির অন্যান্য শরিকসহ মা অত্যন্ত শঙ্কিত। বাবাকে জিজ্ঞেস করে কোনো ফল পাওয়া যায়নি। বাবা এমনিতে গম্ভীর মানুষ। এরপর থেকে আরও গম্ভীর হয়ে গেছে। মাকে বাবা বুঝিয়েছে, এমনি আসে। বাবা শিক্ষক। এলাকার সম্মানিত মানুষ। আইনশৃংখলা বাহিনীও তার প্রতি আলাদা মর্যাদা দেয়। সামাজিক কাজকর্ম থেকে পারিবারিক কোনো জটিল বিষয় বাবাকে স্পর্শ করেছে বলে শোনা যায়নি। স্কুল থেকে ফিরে পরেশ মাস্টারের সঙ্গে দাবা খেলা ছাড়া জগতে বাবার কোনো কাজ নেই। বাবা সুখী মানুষ। ‘আমার ব্রিলিয়ান্ট ছেলেটির খোঁজে পুলিশ আসে!’ ‘বলো কি মাস্টার? এলিন! কেন? কি করেছে ও?’ ‘হ্যা। ওর বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগ। প্রত্যেকটাই অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। খুন থেকে বাড়ি দখল।’ ‘বল কি? আমার পা কাঁপছে। এলিন এ কাজগুলো করেছে! বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। ওতো সেদিনের ছেলে। ও রাম।’ ‘ওর মাকে তো ঘটনা জানাতে পারিনি। কেন, কী কারণে এলিনের বিরুদ্ধে কেস হয়েছে আমি জানতেও চাইনি।’ বাবা খুব গম্ভীর কণ্ঠে বলে। ‘তাহলে উপায়?’ পরেশ মাস্টারের কণ্ঠ উদ্বিগ্ন। বাবা কথা বলে না। পড়ন্ত বিকেলে পরেশ মাস্টারের সঙ্গে কথাহীন কাটিয়ে দেয়। দাবা খেলা হয় না। তার নিস্তরঙ্গ জীবনপ্রণালীর সঙ্গে মেলে না। সংসারে বাবার কোনো প্রাপ্তি নেই। মারও নেই। সাদামাটা মহিলা। চার সন্তানের জননী সেজে সুখে আছে। তিন কন্যা বিধুষি। সুন্দরী। স্কুল পেরুতেই বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামীরা শিক্ষিত। চাকরিজীবী। রেনু আপা থাকে ইতালির মিলানে। স্বামীর সঙ্গে। ওরা ওখানে স্যাটেল। দুবছর পর পর আসে। হৈ-হুল্লোড় করে আবার মিলানে ফিরে যায়। মা সারা বছর বেলা আপার সঙ্গে গল্পে মেতে থাকে। মিনুবুবু কুমিল্লায়। চিনুবুবু মধুপুরে ভালো আছে। বাবা-মা কন্যা দায়গ্রস্ত নয়। শুধু এলিনকে নিয়ে ভাবনার শেকড়-বাঁকড়। এলিন মেধাবী ছাত্র। ঢাকা কলেজে পড়ে। বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এলিনের প্রতি বাবার ভরসা অনেক। অজপাড়া গাঁয়ের শিক্ষকের সঙ্গে যাতে জীবন মিলে না যায়, তা বাবা মনে মনে পোষণ করে। এলিন ইন্টারমিডিয়েটে সেকে- ইয়ারে পড়ে। মেধাবী। চুপচাপ। শান্ত প্রকৃতির তরুণ। গত সেমিস্টারে ভালো করেছে। বাবা আশান্বিত। ঠিক এ সময় বাড়িতে পুলিশ আসে। প্রথমে বাবা ধরে নিয়েছিলেন, পুলিশের কোনো ভুল ইনফরমেশন আছে। শুধু নামের মিল থাকাতে বছরের পর বছর জেল খাটে কতজন? এমন তো হতে পারে? অপরাধের ক্রাইটরিয়াতে এলিনের মিল খুঁজে পায় না। তারপর দুরুদুরু সত্তা নিয়ে বাবা সারাক্ষণ বিষণœ থাকে। বাবার ধারণা নিহার বেগম অন্য ধাঁচের রমণী। হঠাৎ করে এ সংবাদে ভেঙ্গে পড়তে পারে। তার হার্টের সমস্যা। মিথ্যা বিষয়ে নিহারের টেন্স বাড়ানো ঠিক হবে না। বাবা মাকে ভালোবাসে। বাবার ধারণা, নিহার সংসারের সম্রাজ্ঞী। বাবার আচরণে মাঝে মধ্যে কাঙালপনা থাকে। থাকবেই তো! মা সংসার শিল্পী। বাবা সবকিছুতেই উদাসীন। মা বাবাকে বয়ে বেড়ায়। মার প্রাথমিক শিক্ষা জ্ঞান বাবাকে ছাড়িয়ে যায়। বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মা তা বিশ্বাস করতে চায় না। মার সহস্র অভিযোগ। তন্মধ্যে বড় অভিযোগ, বাবা মূর্খ। সংসারের কিছুই জানে না। শিক্ষিত কিন্তু স্কুল মাস্টার। ইত্যাকার বিষয়গুলো বাবা গা করে না। সংসারে সব মেয়েরা করিৎকর্মা। নিহার একটু বেশি। সেদিনের বেলা, ক্যামন করে স্বামীর সঙ্গে কথা বলে! ভাবখানা এমন ওর জামাই কিছুই জানে না। প্রাকৃতিক নিয়ম নারীরা সংসারের আধিপত্য রাখতে চায়। ছেলে-মেয়েগুলো আস্তে আস্তে মা ঘেঁষা হয়। তারপরও নিহারের ওপর ভরসা রাখা যায়। সর্বসহা। এরপর আরও দুদিন পুলিশ এলো। বাবা মাকে কিছ্্ুই জানাতে পারলো না। পরেশ মাস্টার থানা থেকে এফ আই আরের নকল তুলে নিয়ে আসে। পুঙ্খানুপুঙ্খ অভিযোগগুলো পড়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তা কি করে হয়? এলিন এ কাজ করেছে আমার বিশ্বাস হতে চায় না। তারপরও আইনগতভাবে এগোতে হবে।’ বাবা বলল, ‘নিহার?’ পরেশ মাস্টার বলল, ‘বৌদিকে অবশ্য জানাতে হবে।’ বাবা কিছু বলল না। অনেকক্ষণ নীরবতার মধ্যে কেটে যায়। বাবা খুব অসহায় দৃষ্টিতে পরেশ মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘নিহারকে জানানোর আগে তোমাকে একবার ঢাকা যেতে হবে। এলিনের হোস্টেলে গেলে জানা যাবে। আমি বিশ্বাস করতে পাচ্ছি না, এলিন এতোটা বদলে যাবে?’ বাবার কণ্ঠ কান্নার মতো শোনায়। পরেশ মাস্টার কোনো কথা বলে না। তার মধ্যে এক ধরনের অনুতাপ কাজ করতে থাকে। নিজকে শূন্য মনে হয়। পরদিন পরেশ মাস্টার ঢাকা চলে যায়। বাবার শিক্ষকতা জীবনে অকারণে স্কুল কামাই দেওয়ার রেকর্ড নেই। শত প্রতিকূলতায় স্কুলে উপস্থিতি অনিবার্য। বাবা স্কুলে যায় না। সব সময় মার কাছাকাছি থাকে। মনমরা। কপালের বলিরেখা স্পষ্ট হয়। মা কোনো অভিযোগ করে না। পরপর দুদিন বাবা স্কুলে যায় না। তার পরদিন পরেশ মাস্টার ঢাকা থেকে ফেরে। বিষণœ, ক্লান্ত। দুদিনেই ক্যামন বুড়ো হয়েছেন। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হোস্টেল সুপারকে পুলিশের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এলিন লা-পাত্তা!’ বাবা কোনো কথা বলে না। মৌনতায় ডুবে থাকে। অসহায় দৃষ্টিতে পরেশ মাস্টারের দিকে তাকায়। ‘আমি এখন কি করব পরেশ?’ ‘কিছুই করতে হবে না। তুমি শুধু নিয়মিত স্কুলে যাবে।’ দ্রুত জবাব দেয় পরেশ মাস্টার। বাবা আবার মৌনতায় ডুবে যায়। ‘নিহার-এলিনের কি হবে?’ ‘জানি না! ধৈর্ষ ধরতে হবে। ভগবানের উপর বিশ্বাস রাখো। বিপদ চিরস্থায়ী নয়।’ পরেশ মাস্টার বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে ক্লান্ত পায়ে বেরিয়ে যায়। বাবা অনেক সময় বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে নিসঙ্গ বেদনার পীড়নে শূন্যতার বাসিন্দা। দীর্ঘজীবন ছাত্র গড়ার কারিগর কী ব্যর্থ? কষ্টে মুহ্যমান বাবার চোখে জল এলো। চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত সময়, শুধু কী হতাশার কালো মেঘ! না। কেউ বাবাকে কাঁদতে দেখেনি। সদাহাস্য, শান্ত শিক্ষাব্রতী মানুষ। সেই বাবা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। তারপর অনেকদিন বাড়িতে পুলিশ আসে। বাবার নির্বিকার উত্তর, ‘বাবা হিসেবে ওর সংবাদ আমার থাকা উচিত ছিল। আমি হতাশ। শিক্ষক হিসেবে শুধু জ্ঞান বিলিয়ে গেছি। পদ্ম ফুঁটেছে। দাঁতালও জন্ম নিয়েছে।’ বাবার ব্যক্তিত্বের কাছে আইনেও অসহায়। কিছুই বলেনি। বাবা হিসেবে কোর্টের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে ক্লান্ত। ঠিক এ সময় এলিন ফিরে আসে। এক বছর সাত মাস তিনদিন পর এলিন সুবোধ বালকের মতো মার শরীর ঘেঁষে বসে বলে, ‘মা, আমার বিরুদ্ধে প্রত্যেক অভিযোগ সত্য, তুমি বিশ্বাস করবে?’ মার উত্তর, ‘না!’ ‘কিন্তু মা, অনেক অভিযোগ সত্য। কাজগুলো আমি করেছি।’ মা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। ‘বলিস কীরে, এই জন্য তোরে পেটে ধরেছিলাম?’ ‘শুধু খুনগুলো করেনি।’ ‘কেন খুনি হলি না, বাকি কি?’ বাবা অসহায়ের মতো পরেশ মাস্টারের খোঁজে বেড়িয়ে যায়। এলিন মার সঙ্গে খুনসুটি করতে থাকে। মা শুধু বার বার বলছে, ‘তোকে আমি পেটে ধরেছিলাম!’ তিন ঘণ্টা পর বাড়িতে পুলিশ আসে। বাবাকে যেতে হলো না। এলিন এগিয়ে গিয়ে পুলিশকে কী সব কাগজ দেখায়, ওরা ‘সরি’ বলে বাবা এবং এলিনের কাছ থেকে বিদায় নেয়। বাবা কোনো কথা বলল না। একটু পর বকুল গাছের নিচে পাটি বিছিয়ে পরেশ মাস্টারের সঙ্গে দাবা খেলতে বসে যায়। মা বলল, ‘তোর বাবা অনেকদিন পর দাবা খেলতে বসেছে।’ এরপর থেকে বাবা আরও নীরব হতে থাকে। সারাক্ষণ ধ্যান মৌন তাপসের মতন ভেতরের রুমে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখে। নীলাকাশ। মেঘে ঢাকা আকাশ। সোনালি ডানার আকাশ। ‘মা বলে, ‘তোমার কি শরীর খারাপ?’ ‘না।’ বাবা উত্তর। বাবার চোখে মুখে সন্দেহের ছায়া। মার দিকে উদাস তাকিয়ে বলে, ‘মা হিসেবে তুমি এলিনকে বুঝতে পারনি!’ মা কোনো উত্তর দেয় না। নিঃশব্দে তার কাছ থেকে সরে আসে। তারপর থেকে মা যেন বাবার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ায়। বাবার মুখোমুখি হতে ভয় পায়। প্রতি মুহূর্ত পরস্পরের দিকে অসহায় তাকায়। বাবা স্কুলে মনোযোগী হতে থাকে। দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর জ্ঞান বিতরণের পাঠ চুকিয়ে ঘরে ফেরে। ঠিক ওইদিন বাবার নামে এলিনের চিঠি আসে ঢাকা থেকে। দু’একদিন খুলেও দেখে না। মা উশখুশ করে। খুলতে সাহস করে না। বাবা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। অন্ধকার রুমে মা পায়চারি করে। বাবা বলে, ‘কিছু বলবে?’ ‘এলিনের চিঠি এসেছে?’ ‘তুমি খুলে দেখ।’ ‘রাগ করবে নাতো?’ ‘কেন রাগ করবো?’ মা কথা বলে না। দ্রুততার সঙ্গে রুমের আলো জ্বেলে দেয়। টেবিলে রাখা এলিনের চিঠি বাবার দিকে এগিয়ে দেয়। বাবা পুরুলেন্সের চশমার আড়ালে এলিনের রাবীন্দ্রিক ঢংয়ে লেখা ভেসে ওঠে। ‘বাবা ও মা, আমার প্রতি তোমাদের অবিশ্বাস আমি সমর্থন করি তোমাদের জায়গায় আমি হলে ওই রকম ব্যথিত হতাম। আমার উপর ঘৃণা, তাপিত শোক দিন-মাস-বছর আমিও লালন করেছি। বাবাকে আমি চিনি। তার জীবনচরিত মুখস্থ। সত্যিকারে বলি, অপরাধগুলো আমি করিনি। আমাদের অসুস্থ রাজনীতি খুনি, দখলদার, অশুভ আত্মায় পরিণত করতে চেয়েছিল মাত্র। আমি তা থেকে নিজকে রক্ষা করার কবজ অর্জন করেছি। তাদের জন্য আমাকে খুনি হতে হয়েছে। বর্তমানে এটা দোষের নয়। নিজকে সুন্দরের পথে হাঁটিয়ে নেয়ার অধিকার আমার আছে। শুধু তোমরা আমাকে ক্ষমা করলেই হবে। বাবা, তোমাকে খুশি করার অস্ত্র আমার জানা। সে অস্ত্রটি এখন প্রয়োগ করতে চাই। অদ্য আমার মাস্টার্সের রেজাল্ট বের হয়েছে। ফিলোসফিতে প্রথম হয়েছি। শীঘ্রই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করব। মা বিশ্বাস কর, তোমার মতো মমতাময়ী কাউকে পাইনি। বাবা-মার দিকে চিঠি এগিয়ে দিয়ে হু-হু করে কেঁদে ওঠে।
×