ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ায় গাজীউল হকের সমাধি ঢেকে যায় না ফুলে ফুলে

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বগুড়ায় গাজীউল হকের সমাধি ঢেকে যায় না ফুলে ফুলে

সমুদ্র হক ॥ বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অন্যতম তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা গাজীউল হকের বগুড়ায় সমাধিতে সরকারীভাবে শ্রদ্ধা জানানো হয় না। ভাষা আন্দোলনের বগুড়ার নেতৃত্বের পুরোধা ব্যক্তিত্ব গ্রন্থাগারিক নুরুল হোসেন মোল্লা, রাজনীতিক মোখলেছুর রহমান, সাংবাদিক মুহম্মদ আব্দুল মতিন, শিক্ষক জালাল উদ্দিন আকবর, আব্দুল আজিজ কবিরাজের সমাধিতেও নেই কোন নামফলক। সরকারী শ্রদ্ধায় তারাও অবহেলিত। এভাবে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বের কথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে ধীরে ধীরে অজানাই হয়ে যাচ্ছে। বছর কয়েক আগে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ও বগুড়া থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক নাট্যব্যক্তিত্ব তৌফিক হাসান ময়নার উদ্যোগে উল্লিখিত ভাষাসৈনিকদের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ শুরু হয়। অতি স্বল্প আয়োজনে এ পর্যন্তই শ্রদ্ধা। বগুড়ার জেলা প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাই (যারা বদলি হয়ে আসেন এবং বদলি হয়ে চলে যান) জানেন না, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা যে মুক্ত স্বাধীন দেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছি সেই অগ্রজদের কী ভূমিকা ছিল বায়ান্নতে। প্রজন্ম জানে না বায়ান্নর আন্দোলনে কিভাবে বগুড়া গর্জে উঠে টানা ১৮ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়েছিল। বগুড়াতেও কিভাবে চলেছে পাকিস্তানী পুলিশের নির্যাতন। ভাষা আন্দোলনে বাঙালীর সেই গর্জনে নেতৃত্বে ছিলেন গাজীউল হক, নুরুল হোসেন মোল্লা (মোল্লা ভাই নামে অধিক পরিচিত), মোখলেছুর রহমান, আব্দুল আজিজ কবিরাজসহ অনেকে। ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা গাজীউল হকের পুরো নাম পীরজাদা ড. আবু নসর মুহাম্মদ গাজীউল হক। বগুড়ার নামাজগড়ে ১৯২৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নামেন সেদিনের সেই নেতৃত্বে তিনি ছিলেন অন্যতম। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহকর্মী গাজীউল হক ২০০৯ সালের ১৭ জুন ইন্তেকাল করেন। বগুড়া শহরের নামাজগড়ে তার বাসভবনের সামনেই কবর দেয়া হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি তার সমাধিতে পড়ে না সরকারী পুষ্পার্ঘ্য। ধ্বনিত হয় না বিউগলের করুণ সুর। সাংস্কৃতিক জোটের হাতেগোনা কয়েকজন একটি করে ফুল দিয়ে আসেন সমাধিতে। বগুড়ায় বীরের শ্রদ্ধা এটুকুই! আশপাশের প্রজন্ম জানে না কী ভূমিকা ছিল তার। নুরুল হোসেন মোল্লা ’৫২ সালে ছিলেন বগুড়ার প্রাচীন উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরির সহকারী গ্রন্থাগারিক (পরে গ্রন্থাগারিক)। আন্দোলনে সরাসরি তিনি মাঠে নামেন। কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন নেতা মোখলেছুর রহমান, মুহম্মদ আব্দুল মতিন, জালাল উদ্দিন আকবরকে সঙ্গে নিয়ে বগুড়ার রাজপথ কাঁপিয়ে তোলেন। ভাষাসৈনিকরা তখন সমাজসেবী আব্দুল আজিজ কবিরাজের বাসভবনকে আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। আব্দুল আজিজ কবিরাজও আন্দোলনে যোগ দেন। বছর তিনেক আগে নুরুল হোসেন মোল্লার মৃত্যুর খবরও সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায়নি। অনেকখানি অবহেলিতই কেটেছে শেষ দিনগুলো। শহরতলীর চারমাথার কাছে তার কবরটি ঠিক কোথায় তাও ঠাহর করা যায় না। নামফলক নেই। মোখলেছুর রহমানের সমাধি শহরের কাটনারপাড়ায়, মুহম্মদ আব্দুল মতিন চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন শেরপুরে, আব্দুল আজিজ কবিরাজের কবর গাবতলীতে। ভাষার জন্য যাদের ছিল এত অবদান, জীবদ্দশায় তারা সেভাবে সম্মানিত হননি। বছর কয়েক আগে বগুড়া সাংবাদিক ইউনিয়ন ও বগুড়া প্রেসক্লাব ক্রেস্ট দিয়ে তাদের সম্মানিত করেছে। এই ছিল তাদের অবদানের স্বীকৃতি। মরণের পর তাদের কবরে পড়ে না পুষ্পার্ঘ্য। কেউ সুর তোলে না ‘মরণ সাগর পাড়ে তোমরাই অমর তোমাদের স্মরি...।’
×