ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কর্মী নিয়োগের চুক্তি বৈধতা হারাবে না ॥ মালয়েশীয় মন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

কর্মী নিয়োগের চুক্তি বৈধতা হারাবে না ॥ মালয়েশীয় মন্ত্রী

ফিরোজ মান্না ॥ মালয়েশিয়ার সিদ্ধান্তে চুক্তির বৈধতা হারাবে না। চুক্তি স্থগিতের একদিন পর মালয়েশিয়ার মানব সম্পদমন্ত্রী রিচার্ড রায়ত জাইম এমন বক্তব্য দিয়েছেন। ঢাকায় ওই চুক্তি সইয়ের পরদিন মালয়েশিয়ার কর্মী নিয়োগ স্থগিতের ঘোষণা দেয়ার পর শনিবার দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এমন একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে। তবে কর্মী নিয়োগ স্থগিত করার বিষয়টি শনিবার পর্যন্ত প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়নি। এমন কথা জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব। তিনি বলেন, মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ অফিসিয়ালভাবে কোন কিছুই জানায়নি। চুক্তি উপেক্ষা করে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ বন্ধ করেছে বলে মন্ত্রণালয় মনে করছে। এটা চুক্তির নিয়মনীতির বাইরে করা হয়েছে। এদিকে মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর দেশটি জহুর বাকুতে ব্যাপক হারে বিভিন্ন দেশের কর্র্মীদের ধরপাকড় শুরু হয়। এক রাতেই ২ হাজার ১৮২ জনের কাগজপত্র পরীক্ষা করে ৯৭১ জনকে পুলিশ আটক করেছে। শনিবার মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় বলেছে, তাদের সরকার বিদেশী কর্মী নেয়া স্থগিতের ঘোষণা দিলেও তাতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার চুক্তিতে কোন প্রভাব পড়বে না। চুক্তি অনুযায়ী মালয়েশিয়া সরকার তাদের পাঁচটি খাতে এখনই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেবে কি নাÑ তা মালয়েশিয়ার মানব সম্পদমন্ত্রী বলেননি। মানব সম্পদমন্ত্রী রিচার্ড রায়ত জাইম তার বিবৃতিতে বলেন, দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী আহমেদ জাহিদ হামিদি সব ‘সোর্স কান্ট্রি’ থেকে জনশক্তি আমদানি স্থগিতের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাকে তিনি স্বাগত জানান, কেননা এর মধ্য দিয়ে স্থানীয় কর্মীদের কর্মসংস্থানের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে ওই ঘোষণা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির বৈধতায় কোন প্রভাব ফেলবে না। বিদেশী কর্মী নেয়া স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তের বিষয়ে সরকার শীঘ্রই বিস্তারিত জানাবে। মালয়েশিয়ার মন্ত্রী রিচার্ড রায়ত এবং বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় ওই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এদিকে বৃহস্পতিবার চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে মালয়েশিয়ার মন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, বাংলাদেশের যারা ফেয়ার (স্বচ্ছ) রিক্রুটিং এজেন্সি, তারাই লোক পাঠাতে পারবেন। আর এদের সহায়তা দেবে বিআরএ। আর যে সব কর্মী পাঠানো হবে, তাদেরও ক্লিন ইমেজের হতে হবে। কোন ক্রিমিনাল রেকর্ডধারীকে মালয়েশিয়া প্রশ্রয় দেয়া হবে না। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই লোক পাঠানোর কার্যক্রম শুরু করা হবে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রিচার্ড রায়ত বলেন, সবেমাত্র চুক্তি সই হলো। এরপর কাজ করতে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুুরা অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন। কর্মীর ন্যূনতম মজুরির বিষয়ে তিনি বলেন, এর আগে জিটুজি চুক্তিতে কর্মীর ন্যূনতম মজুরি ছিল ৮শ’ থেকে ৯শ’ রিঙ্গিত। নতুন চুক্তিতেও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী বেতন নির্ধারণ করা হবে। এক্ষেত্রে কোন বৈষম্য করা হবে না। দুই মন্ত্রীর মধ্যে চুক্তি সই হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা স্থগিত হয়ে যায়। মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ থেকে কর্মী নিযোগ আপাতত বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। শুক্রবার কোতাকিনাবরুতে দেশটির সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প পরিদর্শনকালে বক্তব্য রাখার সময় মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাহিদ হামিদি বলেন, মালিকদের প্রতি স্থানীয় কর্মীদের নিয়োগ দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। বিশ্বের কোন দেশ থেকে আপাতত মালয়েশিয়া কোন কর্মী নিয়োগ করবে না। মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাহিদ হামিদি কেন কর্মী নিয়োগ স্থগিত ঘোষণা করলেন বিষয়টি জানার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নূরুল ইসলাম বিএসসির সঙ্গে টেলিফোনে কয়েক দফা যোগাযোগা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব বেগম শামছুন নাহার জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য পাইনি। আমাদের কাছে অফিসিয়াল কোন চিঠি আসেনি। ফলে আমরা বলতেও পারছি না কেন কি কারণে কর্মী নিয়োগ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে সোর্স কান্ট্রি হিসেবে দুই দেশের মধ্যে গঠিত ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে বিষয়টি জানা যাবে। এখন এ বিষয়ে কোন কিছুই আমরা জানি না। তবে এখন আমরা মনে করছি, চুক্তি ঠিক আছে। মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্য রাজনৈতিক চাপ হতে পারে। দেশটির বর্তমান সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে আগ্রহী। আমরা যত বার বর্তমান সরকারের সঙ্গে বৈঠক করেছি তাতে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকাই লক্ষ্য করেছি। এদিকে মালয়েশিয়া প্রবাসী একজন জনশক্তি ব্যবসায়ী টেলিফোনে জানান, মালয়েশিয়া প্রবাসী কর্মীরা বর্তমান সরকারের পক্ষে নির্বাচনের আগে মিছিল মিটিংসহ ভোটও দিয়েছেন। এ কারণে সেখানে ভারতীয় ও চীনারা বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগে বাধা হিসেবে কাজ করছেন। তারা চায় না কোনভাবেই বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ কর্মী মালয়েশিয়া যাক। দেশটিতে মালয়দের পরেই ভারতীয়দের স্থান। এরপর রয়েছে চায়নিজরা। তারা দেশটির পার্লামেন্টেও বড় ধরনের বিরোধিতা করেছিল। এর পরও মালয়েশিয়ার পার্লামেন্ট বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত স্থগিত হওয়ার পেছনে ভারতীয় ও চীনাদের বড় ভূমিকা রয়েছে। ঢাকায় চুক্তি স্বাক্ষরের দিন মালয়েশিয়া বিরোধী দল চুক্তির বিরুদ্ধে মিছিল সমাবেশও করেছে। সূত্র জানিয়েছে, মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারটি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০১৩ সালে জি টু জি পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নিতে শুরু করে মালয়েশিয়া। সে অনুযায়ী শুধু সরকারীভাবে মালয়েশিয়ার প্লান্টেশন খাতে কর্মী পাঠানো হচ্ছিল। কিন্তু ‘প্লান্টেশন’ খাতে কাজ করতে আগ্রহীর সংখ্যা কম হওয়ায় ওই উদ্যোগে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। পরে মালয়েশিয়ার জনশক্তির জন্য বাংলাদেশ ‘সোর্স কান্ট্রির’ তালিকায় এলে সেবা, উৎপাদন, নির্মাণসহ অন্যান্য খাতে বাংলাদেশী কর্মী নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। পরে মালয়েশিয়া সরকার তাদের পাঁচটি খাতে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের সমন্বয়ে ‘জি টু জি প্লাস’ পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ কর্মী নিতে রাজি হওয়ার পর ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়। কিন্তু চুক্তিটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্থগিত হয়ে যাওয়ায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় হতবাক হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে যে কর্মীরা আশার আলো দেখেছিল তাদের ওপর আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। দীর্ঘ ৪ থেকে ৫ বছর আগে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য নিবন্ধন করে তারা বসে আছেন। মালয়েশিয়া যাবেন বলে, অন্য কোন কাজও তারা করছেন না। অনেকের আবার বয়সও শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় চুক্তির বিষয়টি শোনার পর তাদের স্বপ্ন আবার জেগে ওঠে। তবে এই স্বপ্নের স্থায়িত্বকাল ছিল মাত্র ২৪ ঘণ্টা। ২৪ ঘণ্টা পরেই আবার তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি মালয়েশিয়া সরকার অবৈধ কর্মীদের বৈধ হওয়ার জন্য নিবন্ধনের সুযোগ দিয়েছিল। বিভিন্ন দেশের ২০ লাখ অনিবন্ধিত কর্মী এই প্রক্রিয়ায় বৈধতা পাবেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের ২ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি অবৈধ কর্মী রয়েছেন। এ দফায় কোন কর্মী নিবন্ধন না করলে- তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। অনিবন্ধিত কর্মীদের বৈধ করণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৫ ফেব্রুয়ারি। এই প্রক্রিয়া টানা তিন মাস চলার কথা ছিল। অনলাইনে কর্মীদের নিবন্ধন করতে হবে। কোন প্রকার দালাল এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে না। গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানী পুত্রজায়ায় মন্ত্রণালয়ের বৈঠক শেষে দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাহিদ হামিদি এই ঘোষণা দেন। কিন্তু তিনিই আবার অবৈধ কর্মীদের স্ব স্ব দেশে ফেরত পাঠানোরও ঘোষণা দিয়েছেন। এক মুখে দুই রকমের বক্তব্যে আমরা হতাশ হয়ে পড়েছি।
×