ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বায়নের নামে শিক্ষাঙ্গন থেকে উধাও হচ্ছে মাতৃভাষা

সর্বস্তরে বাংলা চালু ৬৪ বছরেও কাগুজে স্লোগান

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সর্বস্তরে বাংলা চালু ৬৪ বছরেও কাগুজে স্লোগান

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ভাষা আন্দোলনের ৬৪ বছর এমনকি স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও নিছক বুলিতে পরিণত হয়েছে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার। একুশে ফেব্রুয়ারি ঘিরে কয়েকটা দিন আবেগ-উচ্ছ্বাসের বহির্প্রকাশ ঘটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে অকারণেই চলছে ইংরেজীর ছড়াছড়ি। সংবিধান, আইন, সরকারী নির্দেশনার পরও সর্বত্রই মাতৃভাষা হচ্ছে অবহেলিত। গাড়ির নম্বরফলক, বাড়ির নাম, বিপণিবিতানের নামও লেখা হচ্ছে ইংরেজীতে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও আদালতের রায় লেখায় চলছে ইংরেজীরই দাপট। আধুনিকতার নামে চলা বাণিজ্যনির্ভর শিক্ষার দাপটে শিক্ষাঙ্গন থেকে যেন বিদায় নিচ্ছে বাংলা। শিক্ষার মাধ্যমেও ইংরেজী, আরবী, উর্দুর দাপট কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। বাংলা নাম তো বটেই; বিষয়ও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রবীণ ভাষাসৈনিক ও ভাষা বিজ্ঞানীরা পরিস্থিতিকে অভিহিত করেছেন বাংলা ভাষার ‘দুঃসময়’ হিসেবে। কারণ একদিকে বাংলা অবহেলিত, অন্যদিকে যেখানে বাংলা লেখা হচ্ছে সেখানেও আশঙ্কাজনকভাবে ব্যবহার হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ বিকৃত বাংলা। ভাষার পরিশীলিত কথ্যরূপকে বিকৃত করার যে প্রবণতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে তা অত্যন্ত আপত্তিকর। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে।’ ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা দেন, ‘বাংলা হবে দেশের রাষ্ট্রীয় ও সরকারী ভাষা। বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এরই আলোকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা বিশেষ করে সরকারী কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য ১৯৮১ সালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯৯ সালের নবেম্বর মাসে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতিলাভের পর ২০০০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো মহাসচিব কোইচিরো মাতসুয়ারা বিশ্বের ১৮৮ দেশের কাছে চিঠি দিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি পালনের আহ্বান জানান। তারপর থেকে বাংলা দেশের মতো সারাবিশ্বে নিজ নিজ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও নিজ দেশে নিজ ভাষাভাষী মানুষের কাছে এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণ মর্যাদা পায়নি বাংলা ভাষা। কিছুদিন আগে রাজধানীর কাঁটাবন থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার ৫০০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর একটি নমুনা জরিপ চালিয়েছিল জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের (নিমকো) প্রশিক্ষণার্থীরা। এর আগেও এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এ ধরনের জরিপ করেছিল। জারিপে দেখা যায়, মাত্র ৫১ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামফলক বা সাইনবোর্ড লেখা হয়েছে বাংলা হরফে। ইংরেজী ভাষায় লেখা নামফলকের সংখ্যা ২৮০। বাংলা ও ইংরেজীমিশ্রিত খিচুড়ি টাইপের নামফলক রয়েছে ১৬৯টির। জরিপে আরও দেখা যায়, কাঁটাবন থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার ৪২টি জুতার দোকানের মধ্যে মাত্র একটির নামফলক লেখা হয়েছে বাংলা ভাষায়। ভাষাসৈনিক ও শিক্ষাবিদসজহ সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ষাটের দশকে দেশের প্রায় সব সাইনবোর্ড লেখা হতো বাংলায়। আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই ধারা বজায় ছিল। এখন ইংরেজীতে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড লেখার হিড়িক চলছে। কেউ কেউ ইংরেজী শব্দ ব্যবহার না করেও বাংলা বানানে লিখছে ইংরেজী, যেটিকে ব্যঙ্গ করে করে বলা হয় বাংলিশ। এখন বাঙালীর প্রাত্যহিক জীবনে ভাষাচর্চার বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে। বাড়ির নাম কবরের এপিটাফ থেকে শুরু করে কোথায় নেই ইংরেজী শব্দের বাহুল্য। ‘বাড়ি ভাড়া’ কথাটি না লিখে বিজ্ঞাপন দেয়া হয় ‘টু লেট’ বলে। বিশ্ববিদ্যালয় না বলে শিক্ষার্থী এমনকি সাধারণ মানুষ পর্যন্ত বলে ‘ভার্সিটি। দেশে নামী-দামী অধিকাংশ বিপণিবিতান আর দোকানে লক্ষ্য করা গেছে ইংরেজীতে লেখা সাইনবোর্ড। কয়েকটার নাম বংলা ভাষায় রাখা হলেও তাও লেখা আছে ইংরেজী হরফে। উত্তরার মাসকাট প্লাজা থেকে শুরু বরে ফ্যামিলি নিডস, বিএনএস সব বাণিজিক ভবনের নাম রাখা হয়েছে ইংরেজীতে। ওয়েস্টটেক্স, সেঞ্চুরি, টপ ফ্যাশন, ক্যাটস আই, মনসুন, প্রিটেক্সসহ সবগুলো তৈরি পোশাক শোরুমের সাইনবোর্ডেই ইংরেজীর একতরফা দাপট। খিলক্ষেতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্মিত বাণিজ্যিক ভবনের নামটিও রাখা হয়েছে ‘রাজউক সেন্টার’। ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনের সামনে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে দুটি ফলকের একটি লেখা রয়েছে ‘হার্টিয়েস্ট ওয়েলকাম বাংলাদেশ রেলওয়ে’, অন্যটিতে লেখা ‘খোদা হাফেজ বাংলাদেশ রেলওয়ে’। দুটিই ইংরেজী হরফে লেখা। শহরজুড়ে মোবাইল ফোন কোম্পানির ডিজিটাল বিলবোর্ডগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে ইংরেজী ভাষা। হাউজিং কোম্পানির বিলবোর্ডের অবস্থাও একই। পুরোপুরি বিদেশী শব্দ বা বাংলা-বিদেশী শব্দের মিশেলে নাম রাখা হয়েছে রাজধানীর অসংখ্য দোকানপাট ও বিপণিবিতানের। ‘জাতীয় প্রেসক্লাব’-এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে ‘ক্যাফে নিউইয়র্ক’, ‘ক্যাফে বাগদাদ’, ‘লাবাম্বা’, ‘ক্যাফে ঝিল’ বা ‘মালিহা এন্টারপ্রাইজ’। একই ভাবে বড় ও নামী-দামী বিপণিবিতানের নাম রাখা হয়েছে ‘নিউমার্কেট’, ‘বসুন্ধরা গার্ডেন সিটি’, ‘কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি’, ‘গুলশান প্লাজা’, ‘আমির কমপ্লেক্স’, ‘রাজধানী সুপার মার্কেট’, ‘স্টেডিয়াম মার্কেট’, ‘মাস্কট প্লাজা’, ‘আলপনা প্লাজা’, ‘ইস্টার্ন প্লাজা’, ‘ইস্টার্ন প্লাস’, বা ‘টুইন টাওয়ার’। ডিস্টিলারি রোড, বেইলী রোড, গ্রীন রোড, এলিফ্যান্ট রোডের মতো সড়কেরও নামের অভাব নেই সারাদেশে। তবে এই ইংরেজী নাম আর বাংলা অক্ষরে ইংরেজী নামের ব্যবহার শহররেই বেশি। আর বাংলাতে প্রায় ঝেড়ে ফেলেই এই অতি ইংরেজীপ্রীতি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা আর ধানম-ি এলাকায়। একই ভাবে চিকিৎসাক্ষেত্রে চলছে বাংলার সীমিত ব্যবহার। মেডিক্যাল শিক্ষা, ব্যবস্থাপত্র, পরীক্ষার রিপোর্টে কেবলই ইংরেজী। চিকিৎসকরা বেশিরভাগ ব্যবস্থাপত্র লিখছেন ইংরেজীতে; ওষুধের নামও লেখা হয় ইংরেজীতে। ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধের নাম বুঝতে না পেরে অন্যের সহায়তা নিতে হয় অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন সাধারণ মানুষকে। না বুঝে ভুলও করেন অনেকে। এদিকে উচ্চ আদালতে বাংলার ব্যবহার মাত্র পাঁচ শতাংশের বেশি নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে নিম্ন আদালতে ব্যবহার অনেক বেশি। আদালতের রায়ে একতরফা দাপট ইংরেজীর। কয়েক ধারার শিক্ষাঙ্গন থেকে যেন বিদায় নিচ্ছে বাংলা। নাম তো বটেই; শিক্ষার মাধ্যমেও ইংরেজী, আরবী, উর্দুর দাপট কিন্ডারগার্টেন আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। বাংলা নাম ও বিষয় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়। ৯১টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৮টিতে আছে বাংলা বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এবং সাইনবোর্ড লেখা ইংরেজীতে। কয়েকটিতে ইংরেজী নাম লিখেতে ব্যবহার করা হয়েছে বাংলা হরফ। বিশ্ববিদ্যায়গুলোর নামেও নেই বাংলার ছাপমাত্রও। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হতেই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাতৃভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করছে, যা আইনগত অপরাধের শামিল। সালাম, রফিক, বরকত, শফিক ও জব্বাররা যে মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন তো দূরের কথা; এর ব্যবহারটুকুও নেই অধিকাংশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদিও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই ইংরেজীতে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটির ছাত্র রাহাত বলছিলেন, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে সব বিষয়ে পাঠদান ইংরেজীতে করানো হলেও তা বেশি একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাছাড়া পাঠ্য নির্ধারণেও বাংলাকে ধরা হয় অতিরিক্তি হিসেবে। আমরা চাই ইংরেজী থাকুক, তবে বাংলাকে বেশি জোর দেয়া হোক। তার পাশাপাশি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সংস্কৃতি বিভাগ বাধ্যতামূলক রাখা হোক। ইংরেজী নামের কিন্ডারগার্টেন আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চলছে ইংরেজী, আরবী, উর্দুর প্রভাব। অনেক প্রতিষ্ঠানের নামকরণ অদ্ভুত। রাজধানীর এমন একটি বিদ্যালয়ের নাম ‘অক্সব্রিজ স্কুল’। কথা বলে জানা গেল, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ‘অক্স’ আর ক্যাম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ব্রিজ’ শব্দ নিয়ে এই অদ্ভুত নাম বানানো হয়েছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ‘নিজস্ব ভাষা জগতের মধ্যে বাংলা একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। সেই ভাষা যদি না পড়ানো হয়, তাহলে তো আমাদের ছেলেমেয়েদের বঞ্চিত করা হবে। এজন্য আমরা চাপ দিচ্ছি, বোঝানোর চেষ্টা করছি। প্রয়োজন হলে আইন করব।’ তবে ইংরেজী হরফে বাংলা ভাষা লিখে রীতিমতো সমালোচনার জন্ম দিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির বিলবোর্ডে ইংরেজী হরফে ব্যবহার করা হয়েছে অদ্ভুত সব বাংলা শব্দ। ইংরেজীতে লেখা হয়েছে ফাটাফাটি, শুধু তুমি, উরাধুরা, এক দেশ এক রেটÑ এ রকম উদ্ভট সব শব্দ। এদিকে সর্বত্র আশঙ্কাজনকভাবে ব্যবহার হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ বাংলা। অনেকক্ষেত্রে রীতিমতো খিচুড়ি ভাষা ব্যবহার হচ্ছে, এটি না বাংলা, না ইংরেজী না আঞ্চলিক; ব্যঙ্গ করে যাকে বলা হয় ‘বাংলিশ’। আঞ্চলিকতার নাম দিয়ে বাংলা ভাষার পরিশীলিত কথ্যরূপকে বিকৃত করার যে প্রবণতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে তাও অত্যন্ত আপত্তিকর। আবার দেখা যায়, বাংলা ভাষার কিছু কিছু শব্দের পরিবর্তে জোর করে ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন আঙ্কেল বা আন্টি বলা হচ্ছে চাচা, মামা, চাচি, মামি, খালার পরিবর্তে। বাংলায় চাচা, চাচি, মামা, মামির মতো সম্পর্ককে বোঝানোর জন্য ভিন্ন ভিন্ন শব্দ রয়েছে। এই শব্দগুলোর পরিবর্তে আঙ্কেল বা আন্টি ব্যবহার করা হচ্ছে অহরহ। ভাষার স্বাভাবিক প্রবাহে চেয়ার, টেবিলের মতো কিছু ইংরেজী শব্দ বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে। এতে কোন সমস্যা হয়নি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু যে বাংলা শব্দগুলো বাংলা ভাষায় দীর্ঘদিন ধরে আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত তাকে স্থানচ্যুত করা মানা যায় না। এবার আসা যাক এবারের একুশে বইমেলায় আসা বইয়ের অবস্থার দিকে। অধিকাংশ শিশুতোষ বই এমনকি কবিতা, গল্প, উপন্যাসের পাতায় পাতায় বিকৃতি আর ভুল উদ্ধৃতিতে ভরা। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবির নিচে ‘রবীন্দ্রনাথকে’ ভেঙ্গে করা হয়েছে ‘রবীন্দ্র নাথ’। শিশুদের অধিকাংশ বইয়েই আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছে ভুল উদ্ধৃত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহার করা ‘ভালোবাসি’-কে লেখা হয়েছে ‘ভালবাসি’ করে। ‘আমি কী দেখেছি’র স্থলে কী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ‘কি’ দিয়ে। শিশুদের পাঠ্যবইয়ে সর্বত্রই ‘কি’ এবং ‘কী’র ব্যবহার করা হয়েছে ভুলভাবে। শিশুদের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছে, আমদের জাতীয় পতাকার রং কি? এখানে ‘কী’ লেখাই শুদ্ধতম রূপ। আর সাধু এবং চলিত ভাষার গুরুচ-ালিকা দোষে দুষ্ট এসব বই। মেলার বাইরে বিক্রি হওয়া বাংলাবাজারের দিগন্ত প্রকাশনী থেকে নার্সারি, কেজির শিশুদের জন্য প্রকাশিত ‘দিগন্ত বাংলা পড়া’ ও ‘শুনতে শুনতে ছড়া বলা’র মধ্যে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ভোর হল’ ছড়াটিই ছাপা হয়েছে ভুল বানানে। জুই বানানটি কবি এভাবে লিখলেও এখানে ছাপা হয়েছে ‘যুই’ এভাবে। আর বিখ্যাত সেই ছড়া ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো’র ‘খোকা’র স্থলে করা হয়েছে ‘খোকন’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম লেখা হয়েছে ‘মুজিবর রহমান’। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অসংখ বই পাঠকরা পেলেও অধিকাংশের মাধ্যমে বাংলা ভাষার কেবল ক্ষতিই হচ্ছে। ভাষাসৈনিকরা বলছেন, বিভিন্নভাবে ভাষা বিবৃতি যে পর্যায়ে গেছে তাতে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরী। কারণ আমাদের ভাষা, সাহিত্য সঙ্কটের মুখে। এখনও আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি যতœবান এবং শ্রদ্ধাশীল হওয়ার সময় আছে। ভাষার প্রতি অবজ্ঞা এবং অবহেলার এই ধারা চলতে থাকলে আমাদের ভাষার ভবিষ্যত অন্ধকার। এসব বিষয়ে বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে বলছিলেন, সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলার ভুলভাল ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এ বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে। শুধু মাতৃভাষার চর্চা থাকলেই হবে না, সঙ্গে সঙ্গে ভাষার গুণমান নিশ্চিত করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নেই। এখানেও বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরী।
×