ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দিনভর গান কবিতা ও চিত্রপটে অমর একুশে

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

দিনভর গান কবিতা ও চিত্রপটে অমর একুশে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সকাল থেকেই সচল ছিল শিল্পীর রং-তুলি। ক্যানভাসে চিত্রিত হয়েছে বায়ান্নর প্রেক্ষাপট। আপন আপন প্রকাশে চিত্রশিল্পীদের চিত্রপটগুলো বলেছে বাঙালির গৌরব ভাষা আন্দোলনের কথা। আঁকা হয়েছে ভাষাশহীদদের বুকের রক্ত দিয়ে আদায় করা বাংলা বর্ণমালার নানা রূপ। এভাবেই কেটেছে সকাল থেকে বিকেল। আর বসন্ত বিকেল থেকে রাত অবধি অনুষ্ঠিত হয়েছে ভাষা আন্দোলনভিত্তিক গান ও কবিতার পরিবেশনা। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আয়োজনে এভাবেই শনিবার দিনভর গান, কবিতা ও চিত্রপটে ভাস্বর হয়েছে অমর একুশে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা প্লাজায় সকাল থেকে শুরু হয় দিনব্যাপী আর্টিস্ট ক্যাম্প। ভাষা আন্দোলন ও ভাষাশহীদদের আশ্রয় করে সৃজিত হয় একঝাঁক শিল্পীর ক্যানভাস। সাদা জমিনের ওপর ছবি ভাষা আন্দোলনের এঁকেছেন সামিনা নাফিজ। লাল রঙের হাতপাখার মাঝে কালো রঙের উদ্ভাসিত হয়েছে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ শব্দযুগল। বিশাল এই চিত্রপটেই ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রঙের ওপর রং চাপিয়ে লেখা হয়েছে ‘মিছিলে যেদিন আমার ভাইয়ের বুকে বিঁধেছিল বুলেট’। নাসিমা খানম কুইনির ছবিতে ওপর ও নিচে কালো বর্ণের মাঝে লাল রঙের ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে একগুচ্ছ বাংলা বর্ণমালা। ছেলেহারা এক দুঃখিনী মায়ের মুখাবয়বের চারপাশে বাংলা হরফের দেখা মোঃ মাইনুদ্দীনের চিত্রকর্মে। এভাবেই শিল্পীরা সবাই নিজ নিজ চিত্রপটে উপস্থাপন করেছেন আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানোর অমর ফেব্রুয়ারির দৃশ্যকল্প। ছবি দেখতে দেখতে কথা হয় চিত্রশিল্পী নাসিম আহমেদ নাদভির সঙ্গে। এই শিল্পী বলেন, আমাদের শিল্পে বিভিন্ন আঙ্গিকে বারবার ফুটিয়ে তুলতে হবে বাংলা বর্ণমালাকে। মাতৃভূমিকে ভালবাসতে হলে শিল্পের আশ্রয়ে ফিরতে হবে বর্ণমালার কাছে। দ্বিতীয় দিনের এই আর্ট ক্যাম্পে অংশ নেন শিল্পী হামিদুর রহমান, আব্দুল মান্নান, রেজাউন নবী, মাকসুদা ইকবাল নিপা, চন্দ্র শেখর দে, মাকসুদুল আহসান, সৈয়দ হাসান মাহমুদ, আতিয়া ইসলাম এ্যানি, দেবাশীষ পাল, মলয় বালা, নাসরিন বেগম, আজহারুল ইসলাম চঞ্চল, আলপ্তগীন তুষার, রাশেদুল হুদা, সমীরণ চৌধুরী, লায়লা শার্মিন, নাসিম আহমেদ নাদভী প্রমুখ ৬০ জন চিত্রকর। বিকেলে জলাধারবেষ্টিত নন্দন মঞ্চে শুরু হয় গান ও কবিতায় সাজানো সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। শুরুতেই পরিবেশিত হয় জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ ও ভাষার গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। এরপর একক কণ্ঠে গান নিয়ে মঞ্চে আসেন বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী। গেয়ে শোনান- ও আমার বাংলা মা তোর আকুল করা রূপের সুধায়/হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে...। সৈয়দ শামসুল হকের আমার পরিচয় কবিতাটি পাঠ করেন নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলী। বর্ণমালা নামের স্বরচিত কবিতাপাঠ করেন কবি মনজুরুর রহমান। বায়ান্নর দ্রোহের উচ্চারণে শহীদ কবির পলাশের কণ্ঠে গীত হয়- অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালা। সার্থক জন্ম আমার মাগো তোমায় ভালবেসে শিরোনামের গানটি পরিবেশন করেন শামা রহমান। মোদের গরব মোদের আশা শীর্ষক সঙ্গীত পরিবেশন করেন নার্গিস চৌধুরী। সৈয়দ শামসুল হকের ‘নান্দী’ কবিতাটি পাঠ করেন ফয়জুল আলম পাপ্পু। মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ পাঠ করেন শাহাদাত হোসেন নীপু। ও আমার এই বাংলা ভাষা গানটি শোনান শিপ্রা চৌধুরী। স্বরচিত কবিতপাঠ করেন কবি কামাল চৌধুরী। সৈয়দ শামসুর রাহমানের ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতাটি পড়ে শোনান লায়লা আফরোজ। আলম দেওয়ানের গাওয়া গানের শিরোনাম ছিল- বাংলাতে কথা বলি ফুরায় মনের আশা ...। এছাড়া এদিন একক কণ্ঠে গান শোনান নবীন বুলবুল মহলানবীশ, মনোরঞ্জন ঘোষাল, কিশোর গৌতম, স্মরণ বড়ুয়া প্রমুখ। কবিতার দোলায়িত ছন্দে আবৃত্তি পরিবেশন করেন সাবেক সংস্কৃতি সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাসসহ কয়েকজন আবৃত্তিশিল্পী। শহীদ মিনার অভিমুখে ভাষাসংগ্রামীদের পদযাত্রা ॥ শনিবার দুপুরের ভাষা আন্দোলন স্মৃতি রক্ষা পরিষদের আয়োজনে বের করা হয় পদযাত্রা। ভাষাসংগ্রামীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত পদযাত্রাটি বের হয় বায়ান্নর স্মৃতিবিজড়িত পুণ্যভূমি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সেই আমতলার সামনে থেকে, যেখান থেকে ভাঙা হয়েছিল ১৪৪ ধারা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শেষ হয় প্রতীকী এই পদযাত্রা। এ আয়োজনে ভাষাসৈনিক মোঃ মুস্তাফিজুর রহমান রচিত ‘জাতিসংঘে দাফতরিক কাজে বাংলা তারিখ ব্যবহার করা হোক’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। পদযাত্রায় অংশ নেন ভাষাসংগ্রামী রওশন আরা বাচ্চু, অধ্যাপক ফুলে হোসেন, রেজাউল করিম, শাহজাহান ইউসুফ, মুস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ। এই পদযাত্রায় শামিল হন বরুণ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ভারতে বাংলার ভাষার জন্য কাজ করছে এমন ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। পদযাত্রায় অংশ নেয়া ভাষাসংগ্রামীদের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের নাগরিকরাও সেøাগানে সেøাগানে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের দাবি জানান। তাঁরা বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে শুধু স্বীকৃতি নয় বরং সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলনের মধ্য দিয়ে মাতৃভাষা রক্ষা ও মর্যাদা দিতে হবে। জাদুঘরে যাত্রাশিল্প বিষয়ক সেমিনার ॥ বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের আয়োজনে শনিবার বিকেলে কবি সুফিয়া কামাল মিলনাতয়নে বাংলার যাত্রাশিল্প বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পশ্চিমবঙ্গের গবেষক, ‘বহুরূপী নাট্যপত্র’ ও যাত্রা আকাদেমী পত্রিকার সম্পাদক ড. প্রভাত কুমার দাস। আলোচনায় অংশ নেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আফসার আহমদ এবং ফোকলোর গবেষক সাইমন জাকারিয়া। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি এম. আজিজুর রহমান। স্বাগত ভাষণ দেন জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। ড. প্রভাত কুমার দাস বলেন, ইতিমধ্যে নতুন শতকের প্রথম দেড় দশককাল অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এমন কোন সম্ভাবনা দেখা দেয়নি যার হাত ধরে যাত্রার অধোগতি রোধ করা সম্ভব হবে। আজ সে সত্যিকার সংকটে দীর্ণ যাত্রা জগৎ- ব্যবসায়িক অসাফল্যে মুখ থুবড়ে পড়েছে, এটা একটা অচিকিৎসা ব্যাধির প্রকোপ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু পরিত্রাণের প্রকৃত উপায়ই বা কী হতে পারে সে বিষয়ে কোন সুচিন্তিত পদক্ষেপ বা দিশা দেখা গিয়েছে এমন আশাও আমাদের সামনে নেই। তবু যাত্রা শিল্পের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যাত্রা শিল্পের বিকাশে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা করা যায়। ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, যাত্রাশিল্প বাঙালীর সংস্কৃতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাঙালীর জীবণাচরণ, প্রেম-বিরহ-সংগ্রাম, বীর ও বীরত্বের গৌরব গাঁথা যাত্রাশিল্পীরা কুশলতায় দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করেন। যাত্রাশিল্পের অতীত-বর্তমান ভবিষ্যতের বহুমাত্রিক দিক সম্পর্কিত গবেষণা এ শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতায় উৎসাহিত করবে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ইতিহাস, ঐতিহ্যের স্মারক সংগ্রহ ও প্রদর্শনের পাশাপাশি ‘যাত্রাশিল্পে’র ইতিহাস বিষয়ে সেমিনার আয়োজন করেছে। রচনা ও চিত্রঙ্কন প্রতিযোগিতা ॥ স্টাফ রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ থেকে জানান, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে মুন্সীগঞ্জ চিত্রাঙ্কান ও রচনা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার সকালে প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে কয়েকশ’ শিক্ষার্থী এতে অংশ নেয়। সকালে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মেজর গাজী মোঃ তাওহিদুজ্জামানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির কো-অর্ডিনেটর ফারহানা মির্জা, শিক্ষক সাইফুর রহমান, আহাদউদ্দিন ফরাজী প্রমুখ। পরে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
×