ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মোঃ হুমায়ুন কবীর

সর্বস্তরে প্রয়োগই হলো মাতৃভাষা দিবসের বড় চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সর্বস্তরে প্রয়োগই হলো মাতৃভাষা দিবসের বড় চ্যালেঞ্জ

মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম করে সে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছেন এমন জাতি বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। কিন্তু আমরা সৌভাগ্যবান কিংবা দুর্ভাগ্যবান যাই হই না কেন, পৃথিবীর বুকে আমাদের বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। জীবন দিতে হয়েছে কতশত মানুষকে। যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হয়েছিল, তখনই এর বীজ রোপিত হয়েছিল। কারণ তখন একটি অপপ্রচার চালানো হতো বিকৃত ও সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যক্তিবর্গের দ্বারা। তখন তাদের তরফ থেকে এভাবে অপপ্রচার করা হতো যে, যেহেতু হিন্দু ও মুসলমান- এই দুই ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাগ হয়েছে, সেজন্য বাংলা হলো হিন্দুদের ভাষা এবং উর্দু হলো মুসলমানদের ভাষা। কাজেই মুসলমানিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই সেদেশের ভাষা বাংলা হওয়া বাঞ্ছনীয়। সেখান থেকেই শুরু। ১৯৪৮ সাল থেকেই বাংলাভাষা রক্ষার আন্দোলন শুরু হতে লাগল। পশ্চিম পাকিস্তানীরা তখন ভেবেছিল যে, যদি পূর্ব বাংলাকে তাদের নিজস্ব বাংলা ভাষায় কথা বলা, লেখাপড়া, জ্ঞানচর্চা প্রয়োগ, ব্যবহার ইত্যাদি করতে দেয়া হয় তাহলে বাঙালীরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেক বেশি এগিয়ে যেতে পারে। তাহলে আর তাদের শাসন-শোষণ করা যাবে না। সেজন্যই উর্দু ভাষাকে জোরপূর্বক পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল বার বার। সেখানে আরও একটি দুরভিসন্ধি ছিল এ রকম যে, যদি কোনভাবে পূর্ব বাংলার ওপর উর্দুভাষাকে চাপিয়ে দেয়া যায় তাহলে বাঙালী জাতি তাদের মুখের ভাষা হারিয়ে, তাদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অন্যায়-অত্যাচর মুখ বুজে সহ্য করবে। কোন প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পাবে না তারা। কিন্তু রাখে আল্লাহ, মারে কে? দেখা গেল ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে পূর্ব বাংলার মানুষের ভেতর বাংলা ভাষা হারানোর চক্রান্ত ক্রমশই পরিষ্কার হতে থাকে দিনদিন। তারপরে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সে মাতৃভাষার আন্দোলন চরম পরিণতির দিকে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ব্যক্তিবর্গসহ সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় আরও অনেক শহীদের তাজা প্রাণ ও রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানী স্বৈরাচারেরা পিছু হটে বাঙালীর দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এতে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়াই পরবর্তী সময় লক্ষণীয়। প্রথমত, বাঙালী জাতি তাদের আগামীর দাবি আদায়ের একটি পথ পেয়ে যায়। রচিত হয় একটি সুগম পথের; যা ধরে আমাদের পরবর্তী স্বাধীনতার আন্দেলনের সুদূরপ্রসারী রাস্তা-ঘাট আস্তে আস্তে নির্ভয়ে এগোনোর প্রেরণা যুগিয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানীরা ভবিষ্যতের জন্য আরও সতর্ক হয়ে গিয়ে বাঙালীকে আর কোন ধরনের ছাড় না দেয়ার বিষয়ে অনড় ও ফন্দি-ফিকিরে আবৃত হতে থাকে। তাদের ভেতরে অদম্য স্পৃহা সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙালীর ওপর শোষণ, অত্যাচার ও নির্যাতন আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিতে লাগল। কারণ এর মাধ্যমে তারা বাঙালীর ভেতর যে চেতনাবোধ ও দেশপ্রেম উপলব্ধি করতে পেরেছিল, তাতে তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল মনে মনে। আর এও তাদের মনে ছিল যে, সহস্রাধিক মাইল দূরের একটি ভূখ-ে সম্পূর্ণ আলাদা একটি জাতি-রাষ্ট্রের ওপর খুব বেশিদিন জুলুম, কর্তৃত্ব, অত্যাচার করা যাবে না। সেজন্যই তারা ‘যা পারো নিয়ে নাও’-এর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল তখন। তারপর ১৯৪৮ সালের পর থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলনের সাফল্য অর্জনের পর ১৯৫৮ তে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টিতে শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সর্বোপরি ১৯৭১ সালে ৯ মাসের স্বাধীনতা সংগ্রাম আসলে একইসূত্রে গাথা। সবই স্বৈরাচারী, নিপীড়ক, শোষক পাকস্তানীদের হটানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাষা পুনরুদ্ধার ও দেশের স্বাধীনতার জন্য করা হয়েছিল। ভাষা সংগ্রামে সে সময় যেমন ছিলেন শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবার ছিলেন প্রবীণ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিক মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়র্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ নেতার সঙ্গে সে সময়ের তরুণ ও উদীয়মান নেতা পরবতীকালে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানও ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তারপর যখন বাংলা পূর্ব বাংলার মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো, সেই পথ ধরে একই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তখন ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দুই লক্ষাধিক মা-বোনের ইজ্জত এবং ত্রিশ লক্ষাধিক শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। ১৯৫২ সালের আগ থেকেই দাবি উঠেছিল যে পূর্ব বাংলায় সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু বাংলাভাষা রক্ষার জন্য একমাত্র আমাদেরই রক্ত ও জীবন দিতে হয়েছে, সেজন্য সেই ভাষা বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ১৯ বছর বাংলা ভাষা সে কাজটি খুবই ধীরগতিতে হয়েছে। কারণ ভাষা স্বাধীন হলেও দেশ ছিল পরাধীন। তখন একুশে ফেব্রুয়ারিতে মাতৃভাষা দিবসকে শ্রদ্ধা জানাতে দেয়া হতো না। তৈরি করতে দেয়া হতো না কোন শহীদ মিনার। তখন লুকিয়ে লুকিয়ে অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে ও সংক্ষিপ্ত কলেবরে পালন করা হতো ভাষা শহীদ দিবস। তবে পরবতী সময় আস্তে আস্তে বীর বাঙালীকে আর কেউই রুখতে পারেনি। ঠিকই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠিত হলো সবচেয়ে বড় শহীদ মিনার। তার পর থেকেই পালিত হচ্ছে ভাষা দিবস যা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে অনেক আগেই। তারই ধারাবাহিকতায় মাতৃভাষা দিবস প্রতিষ্ঠিত হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এর পেছনেও রয়েছে একটি ইতিহাস। ১৯৯৯ সালে কানাডা প্রবাসী কয়েকজন বাংলাভাষা প্রেমীদের মধ্যে সেখানে আব্দুস সালাম ও রফিকুল ইসলাম নামের ব্যক্তিবর্গ উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাদের উদ্যোগেই জাতিসংঘের ইউনেস্কোর আহ্বানে তৎকালীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারে নেতৃত্বে শিক্ষামন্ত্রী এএইচএসকে সাদেকের সহযোগিতায় তা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সেই ১৯৯৯ সাল থেকেই জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিবছরের একুশে ফেব্রুয়ারিতে এ দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। এরই উদাহরণ হিসেবে এবারেও যুক্তরাষ্ট্রের জাতিসংঘের সদর দফতরের সামনে বিরাট এক শহীদ মিনার গড়ে সেখানে বাংলাদেশ মিশন কর্তৃক আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালিত করার প্রস্তুতি নিয়েছে। এ বছর বাংলাদেশে এবং বিদেশের সব মিশন এবং জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ সেই গৌরবময় অমর একুশে পালন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। ভাষা স্বাধীন হয়েছে সেইসঙ্গে দেশও। কিন্তু দঃখের বিষয় হলো এখনও সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু যখন সঙ্গত কারণেই পরাধীন পূর্ব বাংলায় ইচ্ছা করলেই সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত করার অনেক বাধা-বিপত্তি ছিল। কিন্তু দেখা গেছে, ১৯৭১ সালের পর যখন দেশ ও ভাষা দুটোই স্বাধীন তখনও সর্বস্তরে বাংলাভাষা ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়নি। এখনও অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় বিদেশী ভাষার ব্যবহার। আমরা জাতি হিসেবে আবেগতাড়িত হয়ে সবই আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জন করতে পারি, কিন্তু এর সুফল পুরোপুরি ভোগ করতে যেন এতটা আগ্রহ বোধ করি না। যেখানে রাশিয়া, চীন, জাপানের মতো দেশ তাদের মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শিল্প-সাহিত্য চর্চাসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমরা আমাদের দেশে সর্বস্তরে বাংলাভাষা ব্যবহার করতে পারছি না। এখনও নিজের বাচ্চাদের ইংরেজী স্কুলে পড়িয়ে গর্ব করে পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করি না। অথচ আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক সর্বস্তরে মাতৃভাষা ব্যবহারের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। তারপরও আমরা তা ব্যবহারে সর্বজনীন হতে পারছি না। বাংলাভাষা চর্চা যেন এখন শুধু ফেব্রুয়ারি মাসকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা বাংলাভাষাকে নিয়ে মাতামাতি করে থাকি। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস শেষে সারাবছর যেন তা বেমালুম ভুলে যাই। ভাষা সত্তাকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য, এর চর্চা বাড়ানোর জন্য, শুদ্ধভাবে ভাষা চর্চার জন্য, ভাষা বিষয়ে গবেষণা করার জন্য দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা একাডেমি নামের প্রতিষ্ঠান। সেই বাংলা একাডেমি প্রতিবছর মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করে থাকে যা এখন চলমান রয়েছে। কাজেই বাংলা একাডেমি, সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর কর্তৃক সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের একাধিক নির্দেশনা বিভিন্ন সময়ে জারি করা হয়েছে। কিন্তু তা সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে না কোনখানেই। কাজেই সঠিকভাবে পালন করতে হলে এটি একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে অবশ্যই সকলের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। তা না হলে আমাদের সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত ভাষা এবং সংগ্রাম দুটোই বিফলে যেতে পারে। লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ [email protected]
×