ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোজাম্মেল হক নিয়োগী

মতিন এবং ফুল

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

মতিন এবং ফুল

আদনানের সঙ্গে মতিন ফিসফিস করে কথা বলছে। কী বলছে তাও বোঝা যায় না। আদনানের বাবার মনে খটকা লাগে। মায়েরও সন্দেহ হয়। মতিন এ বাসার কাজের ছেলে। কয়েক বছর হয়েছে গ্রাম থেকে এসেছে। বারো বছর বয়স হতে পারে। গরিব শিশুদের বয়স বোঝা বেশ কঠিন। আদনান পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। মতিন খুব চালু। মাঝে মাঝে আদনানের বই নিয়েও নাড়াচাড়া করে। পড়তে পারে কি-না কে জানে? আদনানের মা-বাবা কোনদিন খোঁজ-খবর নেয়নি। মতিনের কাজ হলো আদনানকে স্কুলে নিয়ে যাবে। ছুটির পর নিয়ে আসবে। আর তার ব্যাগটা বহন করবে। খাওয়া-দাওয়ার পর থালাবাসন ধুইবে। এরপর যতটুকু সময় পায় সে টিভি দেখে। ফিসফিস করে কী কথা বলে মতিন? মায়ের সন্দেহ শুধু বাড়তে থাকে। একদিন রাতে মা কান পেতে শুনে। মতিন বলল, একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে যাবে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। একা একা যাবে। আদনান বলছে সে যাবে না। সে স্কুলে সবার সঙ্গে নিজেদের শহীদ মিনারে যাবে। তাদের কথাবার্তা শুনে আদনানের মায়ের চোখ বড় হয়ে যায়। এই পুচকে ছেলেটা বলে কী! মিরপুর থেকে যাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে? মাথাটা ঝিমঝিম করে। তাড়াতাড়ি আদনানের বাবার কাছে গিয়ে বলল, শুনেছো ঘটনা? কী ঘটনা? মতিন নাকি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাবে। কত বড় সাহস দেখেছো? Ñদেখেছি। তার মানে কী? তুমি গুরুত্ব দিচ্ছ না, তাই না? Ñতাই। -আরে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? যদি সে হারিয়ে যায়? জেলহাজতে তো আমাদেরই যেতে হবে? মায়ের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মা ডাকে, এই মতিন তুই আমার রুমে আয়। মতিন আসার পর মা বলল, তুই একুশে ফেব্রুয়ারিতে কোথায় যেতে চাস? মতিন চিন্তায় পড়ে যায়। খালাম্মা কী করে জানল? ভয়ে ভয়ে বলল, শহীদ মিনারে। -কেন? তুই শহীদ মিনারের কী বুঝোস? -মতিন কোন কথা বলে না। তাই তো, সে তো গরিব মানুষ সে শহীদ মিনারের কী বোঝে? -এই ছেলে বল, তুই শহীদ মিনারের কী বুঝোস? মতিন ভয়ে কাঠ। মা মতিনের হাত ধরে আদনানের বাবার কাছে নিয়ে গেল। রাগে থর থর করে কাঁপছে। দেখো ছেলের সাহস। আমার কথার কোন জবাবই দিচ্ছে না। আদনানের বাবা মতিনকে খুব ভাল করে দেখলেন। ছেলেটি ভেতরে ভেতরে একটা জেদ পুষছে। সে হয়ত কথাই বলবে না। এত দূর একা একা যাওয়ার চিন্তাটা বিরাট সাহসের ব্যাপার। আদনানের বাবা বলল, তুই শহীদ মিনারে গিয়ে কী করবি? মতিন মনে মনে বলে, শহীদ মিনার শুধু আপনাদের? আমরা গরিব হয়েছি বলে যেতে পারব না? এই দেশ কি শুধু আপনাদের? শহীদ মিনার কি শুধু ধনিদের? মতিন মুখ শক্ত করে থাকে। মতিনকে এতটা বোকা ভাবাও ঠিক না। সে আদনানের সঙ্গে থেকে অনেক কিছু শিখেছে। শুধু স্কুলে যেতে পারে না এই যা। মতিনের জেদ দেখে আদনানের মা রাগে কটমট করতে থাকে। তুই বল, সেখানে গিয়ে কী করবি? এই সময় আদনান একটা ফুলের তোড়া নিয়ে আসে। সে মাকে দেখায়। মতিন এগুলো গাছের নিচ থেকে কুড়িয়ে তোড়া বানিয়েছে। ফুলের তোড়া দেখে আদনানের মায়ের জেদ আরও বেড়ে যায়। তুই যদি হারিয়ে যাস, তাহলে তোর জন্য আমরা জেলে যাব? তোর আবার কীসের শহীদ মিনার? মতিন মনে মনে বলে, শহীদ মিনার কি শুধু আপনের? তুই কাজের ছেলে। তুই সেখানে গিয়ে কী করবি? মতিন মনে মনে বলে, আপনারা যা করেন আমিও তাই করব। তুই না গেলে কি মাতৃভাষা থাকবে না? ধ্বংস হয়ে যাবে? মতিন মনে মনে বলে, মাতৃভাষা কি আপনার একার? মতিনের কোনো কথার জবাব না পেয়ে আদনানের মা ক্ষেপে যায়। এই ছ্যামড়া, কথা বলছিস না কেন? আমার সঙ্গে জেদ দেখাস, না? যা আমার সামনে থেকে। না হয় গাল পাথারে একটা গোল থাপ্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দেব। মতিন তবু কথা বলে না। আস্তে আস্তে চলে যায়। দুই. দশবারো জনের একটি দলের নেতৃত্ব দিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় মতিন। রাজনৈতিক নেতাদের ভিড়েই পুলিশে দম যায় যায়। হাজার হাজার মানুষ চতুর্দিক থেকে ধেয়ে আসছে। এর মধ্যে এই টোকাইয়ের দলটি দেখে কয়েকজন নিরাপত্তা পুলিশ ক্ষেপে যায়। এই তোরা কই যাস? -মতিন বলল, শহীদ মিনারে? হায়, কপাল। এই ভিড়ে মানুষের পায়ের ডলা খাবি। মরবি। যা এখান থেকে। -না, যাব না। আমরাও ফুল দিমু। মতিনের কথা শুনে পুলিশ হকচকিয়ে যায়। এবার একটা জোরে ধমক দিয়ে বলল, তোদের শহীদ মিনারে তোদের যাওয়ার দরকার কী? যা, ভাগ। দরকার আছে। শহীদ মিনার শুধু বড়লোকের না। আমাদেরও। এটি ভাষা শহীদদের। মতিনের কথা শুনে পুলিশ হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মতিন দলের ছেলেদের বলে, যা সামনের দিকে যা। তিন. ভোরে মতিনকে বাসায় না পেয়ে আদনানের মা-বাবার মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। ও যদি সত্যি হারিয়ে যায়! যদি থানা পুলিশ হয়। হায় কপাল! মা মাথা থাপড়াতে শুরু করে। আর এই ভয়েই বাবা ছুটে চলে শহীদ মিনারের দিকে। ভিড়ে ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে মতিন তার বন্ধুদের নিয়ে গান গাইছে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো/একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/। এমন চমৎকার সুরে সে গাইছে যে আদনানের বাবা অভিভূত হয়ে যায়। মতিনের ভাষাপ্রেম আর দেশপ্রেম দেখে আদনানের বাবা হতবাক হয়ে একটা আইল্যান্ডের পাশে দাঁড়ায়। মতিন শিশুদের দল নিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে। ওদের হাতে কিছু বাসিপচা ফুলের কয়েকটি তোড়া। হয়ত ফুলগুলো কোথাও থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে ওরা। এক সময় তার চোখ থেকে দরদরিয়ে পানি পড়ে। অলঙ্করণ : নাসিফ আহমেদ
×