ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একুশ আসে, একুশ যায়, বগুড়াবাসীর সেই প্রাণের মিনার হয় না

প্রকাশিত: ০৫:০১, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

একুশ আসে, একুশ যায়, বগুড়াবাসীর সেই প্রাণের  মিনার হয় না

সমুদ্র হক ॥ একুশ আসে, একুশ চলে যায়... ফের অনেক আশা নিয়ে আসে। এবার বুঝি বিএনপি-জামায়াতের গুঁড়িয়ে দেয়া সেই শহীদ মিনার পুনর্নিমিত হয়েছে। দিন মাস বছর চলে যায়... এভাবে এক যুগ পেরিয়ে গেল... বগুড়ার সাধারণ মানুষের হৃদয়ে লালন করে রাখা সেই শহীদ মিনার আর পুনর্নিমিত হয় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাধারণ মানুষ বিএনপি জামায়াতী তারেক মডেলের শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য দিতে যায় না। প্রতিবার শোলা, কাঠ, ইট দিয়ে প্রতীকী শহীদ মিনার বানিয়ে ভাষা শহীদদের স্মরণে পুষ্পার্ঘ্য দেয়। এবারও এমনটি হবে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পরের বছর (১৯৫৩) আন্দোলনকারীরা প্রথম শহীদ মিনার বানায় শহরের আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠে। শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথা ও এ্যাডওয়ার্ড পার্কেও শহীদ মিনার বানানো হয়। পাকিস্তানী শাসকরা তা গুঁড়িয়ে দেয়ার পর দীর্ঘদিন শহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ছিল না। ষাটের দশকের শেষে সরকারী আজিজুল হক (বর্তমানে নামের বানান অন্তস্থ য-এর স্থলে বর্গীয় জ দিয়ে বানান লিখা হয়। যার নামে এই কলেজ তিনি কলকতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। তিনি বর্গীয় জ তেই বানান লিখতেন। পাকিস্তানী শাসকরা তার নাম আরবীকরণ করে অন্তস্থ য ব্যবহার করে। বছর কয়েক আগে তার নামের প্রকৃত বানান উদঘাটিত হয়) কলেজের পুরাতন ভবনে শহীদ মিনার নির্মিত হয়। বগুড়ার মানুষ একুশের প্রথম প্রহরে কলেজের শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করত। ১৯৮২ সাল বগুড়ার সৃষ্টিশীল শিল্পী খন্দকার আমিনুল করিম দুলাল (প্রয়াত) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের তাগিদে নিজেই নক্সা বানিয়ে তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলামের (প্রয়াত) কাছে উপস্থাপন করলে তিনি পাস করে দেন। দুলালের নক্সায় ছিল ভাষা আন্দোলন থেকে ৬ দফার আন্দোলন, পর্যায়ক্রমে ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের পর মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ বিজয়ের ম্যুরাল। যা ছিল সিমেন্টের ভাস্কর্যের ধারায়। চারদিকে এই ম্যুরালের মধ্যে ছিল বেদী ও বর্ণমালা অ আ ক খ লেখা মূল মিনার। যে কেউ এই শহীদ মিনার দেখলে একটি জাতির ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বুঝতে পারত। বেদীর ওপরে সকল ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার পূর্ণ ব্যবস্থা রাখা হয়। শহরের কেন্দ্রস্থলের কাছে শহীদ খোকন পার্কের ভেতরে এই শহীদ মিনারে ব্যয় হয় এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। শিল্পী নিজেই এই শহীদ মিনার নির্মাণে সার্বিক তত্ত্বাবধান করেন। ভাস্কর্যের আদলে ম্যুরালগুলো তিনি নিজ হাতে বানান। পৌরসভার অর্থায়নে নির্মিত এই স্থাপনাটি ছিল বগুড়ার মানুষের হৃদয়ের শহীদ মিনার। জামায়াত সমর্থিত বিএনপি সরকার ২ হাজার ১ সালে ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন ক্ষমতাধর তারেক রহমানের (যিনি ছিলেন জামায়াতের পৃষ্ঠপোষক) এক নির্দেশে রাতারাতি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধ লালন করা শিল্পীর গড়া শহীদ মিনার। বগুড়ার মানুষ প্রতিবাদে উত্তাল করে রাজপথ। বিএনপি জামায়াত সরকারের পুলিশ লাঠিপেটা করে আহত করে প্রতিবাদকারীদের। তারপর উল্টো প্রান্তে (পশ্চিমে) তারেকের পছন্দের বিদঘুটে এক নক্সায় (যেখানে স্টিল পাইপ ব্যবহৃত হয়েছে) যে কথিত শহীদ মিনার নির্মিত হয় তা প্রত্যাখ্যান করে বগুড়ার মানুষ। অপেক্ষায় থাকে কখন সুদিন আসবে। ২ হাজার ৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বগুড়ার মানুষ আশা করেছিল এবার তারা পূর্বের শহীদ মিনার ফিরে পাবে! শহীদ মিনার পুনরুদ্ধার কমিটি করে তারা নিয়ম মেনে আন্দোলন শুরু করে। সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করে। স্মারকলিপি দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। মাস যায় বছর যায়...। সেই শহীদ মিনার আর ফিরে আসে না। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা রহিম চৌধুরী কিছুদিন আগে মারা যান। আশা ছিল জীবদ্দশায় সেই শহীদ মিনার দেখে যাবেন। তা হয়নি। বগুড়ার প্রগতিশীল ধারার সকল মানুষ আশা করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি-জামায়াতী আদলের শহীদ মিনার অপসারিত করে প্রয়াত শিল্পীর গড়া শহীদ মিনার নির্মাণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান দেখাবে। নিজেরাই নিজেদের প্রশ্ন করে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ কী আসবে! যখন হৃদয় নিঙরানো শ্রদ্ধার পুষ্পার্ঘ্য পড়বে প্রাণের শহীদ মিনারে...।
×