ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোরসালিন মিজান

বিপুল উপস্থিতির দিনে দীপনের আবেগঘন ফিরে আসা

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বিপুল উপস্থিতির দিনে দীপনের আবেগঘন ফিরে আসা

আশ্চর্য এক নীরবতা! যেন কিছুই ঘটেনি। কোন লেখক খুন হননি। অভিজিত রায়ের রক্তে ভেসে যায়নি টিএসসির ফুটপাথ। প্রকাশক খুন হননি। নিজ অফিসে হত্যা করা হয়নি ফয়সল আরেফিন দীপনকে। আহত করে দেশছাড়া করা হয়নি আরেক প্রকাশক টুটুলকে। সবই বাজে কথা। যেন বাজে কথা। তাই ওসবে কান দেয়নি বাংলা একাডেমি। জাতীয় যে দায়, যে দায়িত্ব, প্রতিষ্ঠানটি অস্বীকার করেছে। তার চেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা হচ্ছে, এসব স্মৃতি যেন সবাই ভুলে যান সে লক্ষ্যে সদাতৎপর ছিল বিদ্রোহ বিপ্লবের তীর্থভূমি বাংলা একাডেমি। আর তার পর অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৯তম দিবস। এই দিন মেলায় প্রবেশ করতে গিয়ে বার বার থামতে হলো। এখানে দীপন। ওখানেও। কখনও বিশাল ব্যানারে। কখনও ফেস্টুনে দীপনের প্রতিকৃতি। দীপনের আত্মত্যাগের তুলনায় এই উদ্যোগ খুব সামান্য। এর পরও বর্তমান বাস্তবতায় বিষয়টি অনেক বড় প্রতিবাদ হয়ে সামনে এসেছে। অনেকেই কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে দেখেন প্রিয় মানুষটিকে। দেখতে দেখতে গেছেন অসংখ্য সুহৃদ। একটি দীপন পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতেই আরেকটি। আরেকটি শেষ করলে আরও একটি দীপন! এভাবে দীপটি চমৎকার জ্বলছে। আবেগঘন এই ফিরে আসা প্রগতিশীল চিন্তার লেখক পাঠক প্রকাশদের অভিভূত করেছে। কিছুটা হলেও ঘুচেছে অপরাধবোধ। শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় জনস্রোত ছিল উপচেপড়া। সব পথ ধরেই আসছিলেন পাঠক। এদিন টিএসসি এলাকা দিয়ে মেলায় প্রবেশের সময় দীপনের ছবিসংবলিত একটি ব্যানার প্রথম চোখে পড়ে। মূল রাস্তার ওপর এই মাথা থেকে ওই মাথা পর্যন্ত দুলছিল কালো ব্যানার। এক প্রান্তে দীপনের ছবি। বাকিটাজুড়ে বিচারের দাবি। ৪০ ফুট বাই ৪ ফুটের ব্যানার সবাই দেখেছেন। একই মাপের ব্যানার এখন দোয়েল চত্বর প্রান্তে। মেলার অভ্যন্তরে ১০০টি ৪ ফুট বাই ৬ ফুটের ফেস্টুন। ৩০০টি ২ ফুট বাই ৩ ফুটের ফেস্টুন। বাংলা একাডেমির মূল ফটকের পাশে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও বিভিন্ন মাপের ব্যানার। প্ল্যাকার্ড। সব মিলিয়ে দীপন ফিরেছেন। ভাবতে ভাল লাগে, দীপন ফিরেছেন প্রাণের মেলায়! উদ্যোগটি দীপন স্মৃতি সংসদের। মূলত বন্ধুরা মিলে বাস্তবায়ন করেছেন। সকালে শিশু প্রহর, উপচেপড়া ভিড় বিকেলে ॥ শুক্রবার হওয়ায় মেলা শুরু হয়ে যায় সকালেই। সকাল ১০টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে শিশু-কিশোর সঙ্গীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্তপর্ব অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দী। বিচারকম-লীর সদস্য ছিলেনÑ শিল্পী কল্যাণী ঘোষ, সুজিত মোস্তফা ও আবু বকর সিদ্দিক। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। প্রতিযোগিতায় ক-শাখায় প্রথম হয়েছেন তাহসিন রহমান, দ্বিতীয় হয়েছেন সুদীপ দত্ত অহন এবং তৃতীয় হয়েছেন ফাবিহা লামিছা তাহা। খ-শাখায় প্রথম হয়েছেন নিপা আক্তার মীম, দ্বিতীয় হয়েছেন অগ্নিতা শিকদার মুগ্ধ এবং তৃতীয় হয়েছেন নামিরা মুশকান। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন শিশু-কিশোর সঙ্গীত প্রতিযোগিতা কমিটির আহ্বায়ক রহিমা আখতার কল্পনা। প্রায় একই সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বই কেনায় মন দেয় অন্য শিশুরা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কিচির-মিচিরে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রাঙ্গণ। বিকেল পর্যন্ত রেশ ছিল শিশু প্রহরের। বিকেল ও সন্ধ্যায় সবার হয়ে ওঠে মেলা। বিপুল আয়তনের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানও খুব ছোট জায়গা বলে মনে হয়। নতুন বই ॥ শুক্রবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৯তম দিনে এসেছে অনেক নতুন বই। বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমা পড়েছে ২৩৬টি। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘রাধারমণ দত্ত : মৃত্যুশতবার্ষিকী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শুভেন্দু ইমাম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেনÑ মাহফুজুর রহমান, বিশ্বজিৎ রায় এবং নৃপেন্দ্রলাল দাশ। সভাপতিত্ব করেন কবি মোহাম্মদ সাদিক। প্রাবন্ধিক বলেন, প্রথম জীবন থেকে রাধারমণ তত্ত্বজিজ্ঞাসু ছিলেন। সহজিয়া মতের প্রতি অনুরাগ পিতার সূত্রে বাল্যকালেই লাভ করেছিলেন। সহজিয়ারা মনে করেন তাঁদের সম্প্রদায়ের আদিগুরু রূপ গোস্বামী। কৃষ্ণ বৃন্দাবনে যে রকম মধুর লীলা প্রকাশ করেন তার অনুকরণ করে মুক্তিলাভ করা এই সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্য। তিনি আরও জানান, রাধারমণ সহস্রাধিক বাউলসঙ্গীত রচনা করেছেন। এর কিছু মুদ্রিত আছে। তাঁর বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, যখন তিনি ভাবাবিষ্ট হতেন, তখন তিনি সঙ্গীত রচনা করতে পারতেন। তাঁর শিষ্যরা সঙ্গীতগুলো মুখস্থ করে নিতেন। আলোচকরা বলেন, ক’জন রাধারমণ ছিলেন এ নিয়েও আজকাল প্রশ্ন ওঠে। সঙ্গত কারণে এ বিষয়টিরও সুরাহা হওয়া দরকার এবং এ দায়িত্ব নিতে হবে রাধারমণ গবেষকদেরই। রাধারমণের গানের কথা ও স্বরলিপি নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। যারা রাধারমণের গান সঠিক বাণী ও সুরে গেয়েছেন বা শুনেছেন তাদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে। তাই এখনই সময় রাধারমণের গানের একটি প্রামাণ্য সংগ্রহ প্রকাশ করা। সভাপতির বক্তব্যে মোহাম্মদ সাদিক বলেন, রাধারমণের জন্মস্থানের কবি-গবেষকদের এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলা একাডেমি একটি জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছে। তিনি বলেন, রাধারমণের গান ও জীবন নিয়ে অনুপুঙ্খ গবেষণা প্রয়োজন। চমৎকার মঞ্জরি ছিলেন রাধারমণের সাধনসঙ্গিনী। রাধারমণের মতো সাধকদের জীবনালোচনায় তাদের সাধনসঙ্গিনীদের প্রসঙ্গ বিশেষভাবে তুলে আনা দরকার। কারণ এসব মহীয়সী নারীদের প্রেম-ভালবাসা তাদের সৃষ্টিকর্মে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেন ‘মুক্তধারা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’ এবং ‘শ্রুতিঘর’র শিল্পীরা।
×