ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেরিতে হলেও সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৪:৪৪, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

দেরিতে হলেও সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-সহ কঠোর শাস্তির বিধান আছে। আমাদের দেশেও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল থেকে মৃত্যুদ-ের দাবি অনেক দিনের। দীর্ঘ সময় পরে হলেও ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইন-২০১৬’ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। খসড়া এই আইনে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ- কিংবা শাস্তির কোন বিধান রাখা হয়নি! অপরাধও হবে জামিনযোগ্য! খসড়া আইন করার আগেই বাতিল করা হয়েছে মৃত্যুদ-ের বিধান। দুর্ঘটনার কারণে চালকদের লাইসেন্স স্থগিত কিংবা বাতিলের বিধানও নেই। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ আহত বা নিহত হলে চালক কিংবা দায়ী ব্যক্তির কী ধরনের শাস্তি হবে, সে সম্পর্কিত কোন বিধান না রেখেই সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া প্রস্তুত হয়েছে। আইনটি অনেকটা তড়িঘড়ি করেই চূড়ান্ত করার চেষ্টা চলছে। এক মাসের মধ্যে নতুন এই আইনটি মন্ত্রিপরিষদে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রশ্ন উঠতেই পারেÑ তাহলে কোন আইনে বিচার হবে দোষী চালকদের? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফৌজদারি আইনে বিচার হওয়ার কথা। কিন্তু সে আইনেও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের ক্ষেত্রে ৩০২ ধারা (মৃত্যুদ-) বাদ দেয়া হয়েছে। এতে যুক্ত করা হয়েছে ৩০৪ ধারা। এ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছরের কারাদ-! অথচ পুরনো আইনে ছিল সাত বছর। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত আপীল বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক জনকণ্ঠকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কোন চালক যদি দোষী প্রমাণিত হয় তাহলে সাজার মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া উচিত। এখন ফৌজদারি আইনে ৩০৪ ধারায় তিন বছরের সাজা খুবই অপ্রতুল। তাই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে নতুন আইনে হোক কিংবা ফৌজদারি আইনে হোক চালকদের শাস্তির মেয়াদ বাড়ানোর বিকল্প নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মালিক ও শ্রমিকদের রক্ষার জন্যই আইন থেকে ৩০২ ধারা অর্থাৎ (মৃত্যুদ-ের বিধান) বাদ দেয়া হয়েছে। তাদের ভাষায় আইনে মানুষের আশা আকাক্সক্ষার কোন প্রতিফল হয়নি। পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা হয়েছে আইনের মধ্য দিয়ে। আইনটি মন্ত্রিপরিষদে ওঠার আগে যুগোপযোগী করার দাবি জানিয়েছেন তারা। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় বলছে, ফৌজদারি দ-বিধিতে দুর্ঘটনায় জন্য দায়ী চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা থাকায় আইনে আর আলাদা করে বিষয়টি যুক্ত করা হয়নি। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারীরা খসড়া আইনটিকে দুর্বল ও একপেশে মনে করছেন। তারা আইনটি তড়িঘড়ি করে পাশ না করিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার জন্য আরও অন্তত তিন মাস সময় নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। আইনে চালকদের শাস্তির বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক সচিব এম এন সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘দুর্ঘটনায় শাস্তির বিষয়টি যেহেতু ফৌজদারি দ-বিধিতে আছে, তাই এখানে উল্লেখ করা হয়নি। তিনি বলেন, প্যানেল কোর্টে চালকদের শাস্তির বিষয়টি থাকায় এই আমরা তা রাখার খুব একটা প্রয়োজন মনে করছি না। একই জিনিস দুই আইনে থাকে না। এক আইনে থাকে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইনে মতামততের জন্য আর সময় বৃদ্ধি করা হবে না। এমনিতেই ১৫ দিন বাড়ানো হয়েছিল। প্রধান প্রধান স্টেক হোল্টারদের সবাই আইনের বিষয়ে নিজেদের মতামত দিয়েছে বলেও জানান তিনি। এছাড়াও সকলের মতামত নিতে সর্বশেষ আরেকটি ওয়ার্কশপ করা হবে। ওয়ার্কসপের পর আইনটি চূড়ান্ত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদে ওঠানোর কথা জানান তিনি। ওয়ার্কসপে আবারও সবার মতামত দেয়ার সুযোগ আছে বলে উল্লেখ করেন সচিব এম এন সিদ্দিক। জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, খসড়া আইনের বিষয়ে আমরা সমিতির পক্ষ থেকে মতামত দিয়েছিলাম। কিন্তু চালকদের দ-ের বিষয়টি খসড়া আইনে রাখা না রাখার বিষয় একান্তই মন্ত্রণালয়ের। তিনি বলেন, আইনের বিষয়ে আবারও মমতামতের জন্য আমাদের ডাকা হলে বাস্তবতার ওপর নির্ভর করে মতামত দেব। চালকদের শাস্তির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রুস্তম আলী জনকণ্ঠকে বলেন, পৃথিবীর কোথাও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চালকের মৃত্যুদ-ের বিধান নেই। তাই আমাদের দেশের আইনে এমন বিধান চাই না। এটা সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ কোন দুর্ঘটনাই পরিকল্পিত নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে চালকদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তি না থাকার বিষয়টি কাম্য নয়। যদি পরিকল্পিতভাবে কাউকে হত্যার প্রমাণ হয় তাহলে ৩০২ ধারার পরিবর্তে ৩০৪ ধারায় মামলা হবে। আইনে মতামত দিলেন যারা ॥ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইডে খসড়া আইটি সকলের মতামতের জন্য রাখা হয় ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এতে মাত্র ২১ জন মতামত দেন। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চনও মতামত তুলে ধরেন। খসড়া সড়ক পরিবহন আইন-২০১৬ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। নিসচা মনে করে যে, এই আইনটি দেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং স্পর্শকাতর আইন। আইনটি সম্পর্কে অধিকতর আলোচনা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। দেশের সচেতন নাগরিক সমাজের অবহিত হওয়া প্রয়োজন। আইনের বিভিন্ন ধারা চুলচেরা বিশ্লেষণেরও দাবি রাখে। এ মতাবস্থায় শুধুমাত্র সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে প্রচারবিহীন ও স্বল্প সময় বেঁধে দেয়া বাস্তবতা বিবর্জিত। নিসচা দাবি করছে খসড়া আইনটি অধিকতর প্রচারণার ও মতামত প্রদান ও বিশ্লেষণের জন্য ন্যূনতম ২ (দুই) মাস সময় দেয়া। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খসড়া সড়ক পরিবহন আইনটি প্রচার করে জনগণকে অবহিত করা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করছে এমন সংগঠনগুলিকে সম্পূক্ত করে তাদের মূল্যবান মতামতের ভিত্তিতে একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের দাবি রাখে। এছাড়াও এম আবদুর রব নামের একজন আইনের বিভিন্ন ত্রুটি তুলে দরে প্রয়োজনীয় মতামত দেন। বেসরকারী সংস্থা ব্রাকের সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কর্মরত জি এম সুমন তার মতামতে বলেন, সময়ের দাবি অনুসারে খসড়া সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৬ প্রকাশ করা হয়েছে যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান- স্পর্শকাতর একটি আইন। কিন্তু আমার মনে হয় এখানে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। তৃণমূল ও জেলা পযায়ে আমরা যারা সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছি তারা স্পষ্ট বুঝতে পারিছি যে সরকার খুব তাড়াহুড়ো করে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৬ বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। খসড়া সড়ক পরিবহন আইন ২০১৬-এর ৪র্থ অধ্যায়ের ২০ ধারার অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্ধারিত ফি পরিশোধ সাপেক্ষে অস্থায়ী রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ এক মাস হবে কিন্তু বাস্তবে এটা এত অল্প সময়ে সম্ভব কিনা তা যাচাই করা দরকার তাই বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন এবং সবাইকে এই আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। এছাড়াও যারা মতামত দিয়েছেন তাদের মধ্যে সাইফুল ইসলাম, পারভেজ, মামুনুর রশিদ, সোহেল, সজিবুল হক, বনজসহ অন্তত ১২ জন সবাই আইনটি যোগোপযোগী ও জনস্বার্থ বান্ধব করার পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি দ্রুত আইনটি বাস্তবায়নেও দাবি তাদের। খসড়ায় আলোচিত যা ॥ জাতিসংঘে বাংলাদেশ অঙ্গীকার করেছিল ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০১৫ সালের সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন মারা গেছে। আহত হয়েছে ২১ হাজার ৮৫৫। ২০১৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ৫ হাজার ৯২৮টি। নিহত হয়েছিল ৮ হাজার ৫৮৯ জন। আর আহত হয়েছিল ১৭ হাজার ৫২৪ জন। এমন বাস্তবতায় খসড়া আইনে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের নিচে কেউ গাড়ি চালাতে পারবে না। জেব্রা ক্রসিং বা ফুটওভারব্রিজ ছাড়া পারাপার করলে দুই হাজার টাকা অর্থদ- হবে। নীরব এলাকা অতিক্রমের সময় হর্ন বাজালে বা উচ্চমাত্রার কোন শব্দ করলে এক মাসের কারাদ- বা এক হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ- হবে। নিয়োগপত্র ছাড়া মোটরযানের চালক হলে বা রাখলে এক বছরের কারাদ- বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দ- হবে। আইনে চালকদের জন্য কর্মঘণ্টা ও বিশ্রামের কথাও বলা হয়েছে। বৈধ লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চলালালে ৬ মাস কারাদ- ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা এমনটি উভয়দ-। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর আগে সড়ক পরিবহন ও চলাচল আইন, ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৫-এর খসড়ায় মোটরযান চালিয়ে অপর ব্যক্তির মৃত্যু ঘটালে তিন থেকে সাত বছর পর্যন্ত শাস্তির বিধান ছিল। এ ছাড়া নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীকে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং চালকের দোষসূচক পয়েন্ট কাটার প্রস্তাব করা হয়েছিল। আর কেউ আহত করলে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং আহত ব্যক্তিকে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের বিধান ছিল। তবে নতুন আইনে এগুলো নেই। অভিযোগ উঠেছে, গাড়ির মালিক ও চালকদের চাপে এগুলো বাদ পড়েছে। এর আগে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গাড়িচালকদের বিরুদ্ধে দ-বিধির ৩০২ ধারায় মামলা না করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ৩০২ ধারায় সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ-। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে মামলা হবে ৩০৪(খ) ধারায়। এই ধারায় সর্বোচ্চ সাজা তিন বছরের কারাদ-। নিরাপদ সড়কের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন লেখক ও সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি বলেন, সড়ক নিরাপত্তা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাজেই আইনটি আমাকে হতাশ করছে। এ আইনে শুধু যে দুর্ঘটনায় শাস্তির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি, তা নয় বরং আরও অনেক কিছুই অস্পষ্ট। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আইনে সাধারণ মানুষের দাবি উপেক্ষিত হলে তা খুব একটা কার্যকর হবে না। তাই আইনটি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই দেশের মানুষের প্রত্যাশা যেন প্রতিফলিত হয় এ দাবি জানান তিনি। জানতে চাইলে বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহাবুব আলম তালুকদার এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠ বলেন, আইনটি নিয়ে কোন অবস্থাতেই তড়িঘড়ি করা যাবে না। তাহলে একটি উন্নত ও মান সম্মত আইন হবে না। এজন্য তিনি সময় নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে আইনটি যুগোপযোগী করার দাবি জানিয়েছেন। ২০১১ সালে ‘সড়ক পরিবহন ও ট্রাফিক আইন’ নামে খসড়ায় ২২টি অধ্যায় ও ৩৭২টি ধারা ছিল। ২০১৩ সালে গঠিত কমিটি তা কমিয়ে ১৫ অধ্যায় ও ২৪২টি ধারায় চূড়ান্ত করে। ২০১৫ সালের খসড়ায় ২২টি অধ্যায় ও ৩৭২টি ধারা ছিল। তবে সর্বশেষ খসড়ায় আইনটিকে ১৩টি অধ্যায় ও ৬৩ ধারায় নামিয়ে আনা হয়েছে। আইনের তফসিলে যে ৩০টি অপরাধ উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদ-ের বিধান রাখা হয়েছে ড্রাইভিং লাইসেন্স জালিয়াতি নিয়ে। এতে বলা হয়েছে, নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ বাদে অন্য কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রস্তুত বা সংরক্ষণ করলে পাঁচ বছরের কারাদ- বা দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ- হবে। আর ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কেউ গাড়ি চালালে ছয় মাসের কারাদ- হবে। বিভিন্ন অপরাধে সর্বনিম্ন দ- রাখা হয়েছে তিন মাস। আগের মতো এই আইনেও আছে, লাইসেন্স ছাড়া যানবাহন চালানো নিষিদ্ধ। ভারি যানবাহন চালানোর ন্যূনতম বয়স ২১ বছর। আর পেশাদার চালকের ক্ষেত্রে ৬০ এবং অপেশাদার চালকের ক্ষেত্রে ৬৫ বছরের অধিক বয়সী ব্যক্তি লাইসেন্স নিতে পারবেন না। লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বয়স নির্ধারণ করা হলেও শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। যদিও বিভিন্ন মহল থেকে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে শিক্ষিত চালক নেয়ার দাবি ছিল। এদিকে ধারা ৫৩-তে বলা হয়েছে ‘অপরাধ বিচারার্থ গ্রহণ-ফৌজদারি কার্যবিধিতে যা কিছুই থাক না কেন, কর্তৃপক্ষ বা তদকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা বা মোটরযান পরিদর্শক বা পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর কর্তৃক লিখিত প্রতিবেদন ব্যতিত কোন জুডিশিয়াল বা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এই আইন বা বিধির অধিক কোন মামলা বিচারার্থ গ্রহণ করিবেনা’। এছাড়াও গণপরিবহনে লাইসেন্স ছাড়া কন্ডাক্টর হলে বা নিয়োগ করলে তিন মাসের জেল বা তিন হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দ-। ট্রাফিক আইন বা সংকেত না মানলে অনধিক ছয় মাসের কারাদ- বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দ- হবে। কোন মোটরযান অতিরিক্ত ওজন বহন করলে অনধিক এক বছরের কারাদ- বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হবে। নির্ধারিত এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও গাড়ি পার্ক করলে অনধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা হবে। খসড়ার ৪২ ধারায় মোটরযান চলাচলের জন্য ১০টি সাধারণ নির্দেশাবলি রয়েছে। কেউ মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে গাড়ি চালাতে পারবেন না। সিটবেল্ট বাঁধা ছাড়া গাড়ি চালানো যাবে না। আইনের ৪৯ ধারায় বলা হয়েছে, সব অপরাধই জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য। সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৬-এর খসড়া প্রত্যাখ্যান করে দুর্ঘটনা প্রতিরোধসহ পরিবেশবান্ধব গণমুখী আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি। ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে জনকণ্ঠক বলেন, খসড়ায় দুর্ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি-সম্পর্কিত কোন বিধান নেই। সড়ক দুর্ঘটনাকে অপরাধ ও দ-বিধিতেও যুক্ত করা হয়নি। আবার সব ধরনের অপরাধ জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ সব মহল থেকেই দাবি ছিল দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা। তিনি বলছেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- প্রচলিত আইনে মামলা হবে তাই এই আইনে চালকদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান নেই। লাইসেন্স বাতিলেরও বিধান রাখা হয়নি। অথচ রেল ও নৌ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে চালকদের লাইসেন্স স্থগিত রাখার ব্যবস্থা আছে। প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইন-২০১৬’ এর কতিপয় বিষয়কে ‘গভীর দুর্বলতা ও অসঙ্গতি’ উল্লেখ করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছে ব্র্যাকসহ অন্যান্য বেসরকারী সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত সড়ক নিরাপত্তা সম্পর্কিত মাল্টি স্টেক হোল্ডার সামাজিক জোট। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, পুরনো আইনের উন্নতির পরিবর্তে প্রস্তাবিত আইনটি বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা ও অসঙ্গতি আরও জটিল করে তুলবে। সড়ক-সংক্রান্ত অপরাধ নির্ণয়ে ও এতদসংক্রান্ত সুবিচার নিশ্চিত করার আইনী বিধানে ব্যাপক অসঙ্গতি লক্ষ্য করা গেছে। এতে একদিকে অপরাধসমূহ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। অন্যদিকে সকল অপরাধকে জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য করা হয়েছে। একই সাথে সড়ক অপরাধ সংক্রান্ত গ্রেফতারি ও মোবাইল কোর্ট ক্ষমতার ব্যাপক সম্প্রসারণ করা হয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়, প্রস্তাবিত আইনের ভাষায় অস্পষ্টতার সুযোগে আইন প্রযোগকারীদের সাথে চালক-মালিক-যাত্রীদের একটি সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত অনুসরণ করা আইনের ভাষা, ব্যাখ্যা এবং কাঠামো অনুসরণ না করে প্রস্তাবিত আইনটি সম্পূর্ণ একটি নতুন প্রশাসনিক ভাষায় ভিন্ন কাঠামো অনুসরণে রচনা করা হয়েছে, ফলে আদালতও এ আইনের বিচারের সময় নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হবে বলে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, বর্তমান আইনের বিধানাবলী বিলুপ্ত করে শূন্য স্থান পূরণের উপযুক্ত নতুন বিধান প্রস্তাবিত আইনে যুক্ত না করার কারণে এবং আইনের মাধ্যমে প্রণীত বিধান বাস্তবায়ন উপযোগী রুলস এবং রেগুলেশন তৈরির সময় পর্যন্ত সময়ে সড়ক ব্যবস্থাপনা কিভাবে চলবে তার কোন স্পষ্ট দিক নির্দেশনা আইনে নেই। এছাড়া সংগঠনের পক্ষ থেকে আইনটির ত্রুটি এবং দুর্বলতা সার্বিকভাবে শনাক্ত করে এটির উপযুক্ত সুপারিশমালা দাখিলের জন্য আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত সময় চাওয়া হয়। এছাড়া বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে নতুন করে আরও ২৬টি ধারা যুক্ত করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ২৭টির বেশি পরামর্শ লিখিত আকারে সংগঠনের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। সমিতির মহাসচিব মোজ্জামেল হক চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, সড়ক পরিবহন আইনে ৩০২ ধারা যুক্ত করতে হবে। পেশাদার গাড়ি চালক ও কন্ডাকটরদের ইউনিফর্ম পরিধান, পরিবহনে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আইনে যুক্ত করাসহ জনস্বার্থের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি জানান তিনি।
×