ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একটি সূত্র বলছে, সে দেশের উপপ্রধান মন্ত্রী ড. হামিদের নিজস্ব কোম্পানির মাধ্যমে এককভাবে কর্মী নেয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায়ই এ সিদ্ধান্ত

চুক্তির পরই পিছটান

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

চুক্তির পরই পিছটান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চুক্তির একদিন পরেই উল্টো কথা উল্টো সুর। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ কর্মী নিয়োগের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী দাঁতোশ্রী রিচার্ড রায়ট আনক জাইম। কিন্তু শুক্রবার সকালেই দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী আহমেদ জাহিদ হামিদি এক অনুষ্ঠানে বলেন, আপাতত কোন দেশ থেকেই কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে না। মালয়েশিয়ার আকস্মিক এ সিদ্ধান্তে হয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব শামছুন নাহার। তিনি বলেন, এটা মালয়েশিয়া রাজনৈতিক বক্তব্য। তবে আমরা আশাবাদী মালয়েশিয়ায় চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ করবে। বাংলাদেশের সঙ্গে কর্মী নিয়োগের জন্য মাত্র একদিন আগে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। শুক্রবার দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলো খবর দিয়েছে, বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ থেকে কর্মী নিযোগ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। খবরে বলা হয়, শুক্রবার কোতাকিনাবরুতে দেশটির সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প পরিদর্শনকালে বক্তব্য রাখার সময় মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাহিদ হামিদি বলেন, মালিকদের প্রতি স্থানীয় কর্মীদের নিয়োগ দেয়ার অনুরোধ করছি। বিশ্বের কোন দেশ থেকে আপাতত মালয়েশিয়া কোন কর্মী নিয়োগ করবে না। বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর এমন একটি বক্তব্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় হতবাক হয়েছে। অথচ একদিন আগে ঢাকায় প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি ও মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী রিচার্ড রিয়ট আনক জাইম বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার বিষয়ে চুক্তি সই করেছিলেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার কর্মী নিয়োগে সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার পর মালয়েশিয়া সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদও জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে গণভবনে গেলে তাকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। এ সময় মালয়েশিয়ার মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে জানান, নতুন এ সমঝোতা স্মারক দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মোচন করবে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বলেন, আজ থেকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হলো। বহু দেন দরবারের পর অবশেষে কাক্সিক্ষত ফল এল। জিটুজিতে (সরকার থেকে সরকার) ৫ বছরে যেখানে ৫ লাখ কর্মী যাওয়ার কথা ছিল, সেখানে জিটুজি প্লাসে ৩ বছরে যাবে ১৫ লাখ বাংলাদেশী। পুরো প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হচ্ছে বিশ্বমানের তথ্য প্রযুক্তি। বৃহস্পতিবার চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব বেগম শামসুন নাহার, কুয়ালালামপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলামসহ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারা এবং মালয়েশিয়ার পক্ষে সে দেশের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল (পলিসি এ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল) মোহাম্মদ সাহার দারুসমান, শ্রম বিভাগের মহাপরিচালক মোহাম্মদ জেফরি বিন জোয়াকিম, আন্ডার সেক্রেটারি (লেবার পলিসি ডিভিশন) বেটি হাসান, মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ কর্মকর্তা রবার্ট দাপান, এ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি (লেবার অব পলিসি ডিভিশন) সতিশ শ্রীনিভাসান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি (ফরেন ওয়ার্কার্স ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন) মোহাম্মদ জামরি বিন মাত জাইন এবং ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়ান রাষ্ট্রদূত নূর আশিকান বিনতি মোহাম্মদ তিয়াব উপস্থিত ছিলেন। এত জন উর্ধতন কর্মকর্তার উপস্থিতিতে চুক্তি হলেও ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রীর এক বক্তব্যে সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে। কি কারণে এমন সিদ্ধান্তের কথা তিনি জানিয়েছেন তা নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হযেছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, তার নিজের একটি কোম্পানি রয়েছে। সেই কোম্পানির মাধ্যমে এককভাবে বাংলাদেশ কর্মী নিয়োগ করার পরিকল্পনা ছিল। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় কি তিনি কর্মী নিয়োগের বিষয়টি স্থগিত করে দিয়েছে। এমন একটি কথা দেশটিতে অবস্থিত বাংলাদেশীরা বলাবলি করছেন। মালয়েশিয়া প্রবাসী একজন প্রবাসী টেলিফোন জানান, দেশটির পার্লামেন্ট আলোচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। হঠাৎ করে কেন উপ-প্রধানমন্ত্রী কর্মী নিয়োগের বিষয়ে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। তার এই সিদ্ধান্তে আমরাও হতবাক হয়েছি। শুধু তাই নয়, দেশটিতে অবস্থানরত অবৈধ কর্মীদের আটক করে স্বদেশে ফেরত পাঠানোর কথাও জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র ও উপ-প্রধানমন্ত্রী ড. আহমেদ জাহিদ হামিদি। শুক্রবার কেম মুয়ারা তুয়াংয়ে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি বৈঠকের পর ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। শিল্প মালিকদের স্থানীয় কর্মী নিয়োগ দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে হামিদি বলেন, বিদেশী কর্মী নেয়া বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালয়েশিয়া। এই স্থগিতাদেশের পাশাপাশি বিদেশী কর্মী নিয়োগের বিষয়ে দ্বি-স্তরবিশিষ্ট লেভি প্রোগ্রামের প্রস্তাবটিও সরকার পর্যালোচনা করবে। মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছে, দেশটিতে নিবন্ধিত বিদেশী কর্মী রয়েছেন ২১ লাখ। এর মধ্যে বাংলাদেশী কর্মী ২ লাখ ৮৭ হাজার ২৮৭ জন। মালয়েশিয়ান সরকার মনে করে, এই সংখ্যার বাইরে আরও ১৭ লাখ অনিবন্ধিত বিদেশী কর্মী দেশটিতে অবস্থান করছে। এদিকে আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, দেশটির বিভিন্ন মহলের চাপে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের একদিন যেতে না যেতেই কর্মী নিয়োগ স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে মালয়েশিয়ার সরকার। তবে সমঝোতা চুক্তির বিষয়টি নিয়েও তৈরি হয়েছে কিছু ধোঁয়াশা। চুক্তির পর বাংলাদেশের ও মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যমগুলোয় ১৫ লাখ কর্মী নেয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। শুক্রবার মালয়েশিয়ার প্রভাবশালী সংবাদপত্র দ্য স্টার বলছে, বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ কর্মী নেয়ার কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। বাংলাদেশে মোট ১৫ লাখ নিবন্ধিত কর্মী রয়েছে, যাদের বিভিন্ন দেশে নেয়া হবে। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বারনামা জানিয়েছে, শুক্রবার সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্পে এক বৈঠকের পর দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী আহমেদ জাহিদ হামিদি সব ‘সোর্স কান্ট্রি’ থেকে (জনশক্তি নেয়ার জন্য মালয়েশিয়া সরকারের তালিকাভুক্ত দেশ) কর্মী নেয়া স্থগিত রাখার এই ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০১৩ সালে জি টু জি পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নিতে শুরু করে মালয়েশিয়া। সে অনুযায়ী শুধু সরকারীভাবে মালয়েশিয়ার প্ল্যান্টেশন খাতে কর্মী পাঠানো হচ্ছিল। কিন্তু ‘প্ল্যান্টেশন’ খাতে কাজ করতে আগ্রহীর সংখ্যা কম হওয়ায় ওই উদ্যোগে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। পরে মালয়েশিয়ার জনশক্তির জন্য বাংলাদেশ ‘সোর্স কান্ট্রির’ তালিকায় এলে সেবা, উৎপাদন, নির্মাণসহ অন্যান্য খাতে বাংলাদেশী কর্মী নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। পরে মালয়েশিয়া সরকার তাদের পাঁচটি খাতে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের সমন্বয়ে ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ কর্মী নিতে রাজি হওয়ার পর ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল।
×