ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যশোরে পুলিশী উচ্ছেদ ও মামলা

৪০ পরিবারের জীবন দুর্বিষহ

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

৪০ পরিবারের জীবন দুর্বিষহ

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ যশোরে পুলিশী উচ্ছেদের শিকার ৪০টি পরিবার এখন চরম অনিশ্চিত জীবনযাপন করছে। শহরের গাড়িখানা রোডের ‘বিরোধপূর্ণ’ জমিতে বসবাসকারীদের জোরপূর্বক উচ্ছেদের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও তাদের মেলেনি নিজস্ব কোন ঠিকানা। শত বছরের আবাস থেকে ‘গায়ের জোরে’ পুলিশের উচ্ছেদ করে দেয়া এই পরিবারগুলোর আপাতত ঠাঁই হয়েছে কারও বাড়ির বারান্দায় নয়তো গুদাম ঘরে। ফলে লেখাপড়ায় ব্যাপক বিঘœ ঘটছে ওই পরিবারগুলোর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের। আর উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোয় পরিবারেও রয়েছে আতঙ্ক। সূত্র জানায়, ১৯১০ সালে শহরের গাড়িখানা রোড এলাকার সরকারী জমি বরাদ্দ নিয়ে এই পরিবারগুলো বংশানুক্রমে এই সম্পত্তি ভোগ দখল করে আসছেন। আর জেলা প্রশাসন থেকে বরাদ্দ দেয়া জমিটি নিজেদের দাবি করছে পুলিশ। এ নিয়ে আদালতে মামলাও বিচারাধীন। কিন্তু এরইমধ্যে রাতের অন্ধকারে হঠাৎ করে পুলিশ ‘গায়ের জোরে’ দখলে নেয় এই এলাকার দোকানপাট। এখন সেখানে ঝোলানো হয়েছে পুলিশ ক্লাবের সাইনবোর্ড। এরপর আবাসিক ভবন থেকে বাসিন্দাদের গায়ের জোরে নামিয়ে দিতে শুরু হয় হুমকি-ধামকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন। গত বৃহস্পতিবার এসব ঘটনা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সংবাদ সম্মেলনও করে। কিন্তু কোথাও কোন আশ্রয় না পেয়ে পরদিন তারা বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়। ‘গায়ের জোরে’ পুলিশের উচ্ছেদ করে দেয়া এই পরিবারগুলোর আপাতত ঠাঁই হয়েছে কারও বাড়ির বারান্দায় নয়তো গুদাম ঘরে। অর্ধাহার-অনাহারে আর পুলিশী আতঙ্কে দিন কাটছে শতবছরের দখলী জমি থেকে উচ্ছেদের শিকার মানুষগুলোর। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঘিঞ্জি ও কোলাহলমুখর গাড়িখানা রোড পল্লীতে এখন সুনসান নীরবতা। সেখানকার বাড়িঘরগুলো ভেঙ্গে মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। ভাঙ্গনের হাত থেকে রেহাই মেলেনি উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত নোটিস ঝোলানো স্থাপনাগুলোও। কেটে ফেলা হয়েছে বড় বড় গাছগুলোও। পুলিশী প্রহারায় পুরো এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে পাকা প্রাচীর। শহরের বেজপাড়ায় আত্মীয়ের বাড়িতে ঠাঁই হয়েছে উচ্ছেদের শিকার গৃহবধূ আয়েশা আক্তারের। তিনি জানান, ‘৬ সদস্যের পরিবারের আপাতত ঠাঁই মিলেছে এক আত্মীয়ের ছোট্ট একটি গুদাম ঘরে। পরিবারের ছোট ছেলেটি এর ওর বাড়িতে থেকে চলতি এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। কোনমতে ওই লেখাপড়া হচ্ছে। আর উপার্জনক্ষম বড় ছেলে পুলিশের দায়ের করা বোমা বিস্ফোরণ মামলা ঘাড়ে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মামলায় জড়িয়ে দেয়ায় ছেলের সামান্য বেতনের চাকরিটিও হারাতে বসেছে। এতে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।’ উচ্ছেদ হওয়া পল্লীর বাসিন্দা এসএসসি পরীক্ষার্থী ইলিয়াস মেহেদী আফ্রিদি বলেন ‘এক সপ্তাহ ধরে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে থেকে পরীক্ষা দিচ্ছি। ভাইয়ের নামে মিথ্যা মামলা, বাড়িঘর নেই। দুশ্চিন্তায় পরীক্ষা ভাল হচ্ছে না। ঠিকমত পড়তেও পারছি না।’ এইচএসসি পরীক্ষার্থী আবু হুরাইরা সায়মন বলেন ‘আমাদের উচ্ছেদে এক মাসের সময় দেয়ার কথা বলে পরিবারের সদস্যদের নাম ঠিকানা নিয়েছে পুলিশ। পরে সেই নাম ঠিকানায় মিথ্যা বোমা বিস্ফোরণ মামলা দেয়া হয়েছে। পরিবারের উপাজর্নক্ষম ব্যক্তি মিথ্যা মামলা ফাঁসানোয় আমাদের সংসার অনিশ্চয়তায় পড়েছে।’ তিনি আরও বলেন ‘থাকার জায়গা নেই। চাচার বন্ধুর বাড়িতে আমরা আশ্রয় নিয়েছি। এক সপ্তাহ আমাদের রান্না বন্ধ। আত্মীয় স্বজন রান্না করে দিলে খাওয়া হচ্ছে। না দিলে আমাদের খাওয়া হচ্ছে না।’ আরেকজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী মনীষা রায় চৌধুরী বলেন ‘বাবার দোকানের মালামাল সব নিয়ে গেছে পুলিশ। এরপর দোকান দখল করেছে। পরবর্তীতে বাবার নামে মিথ্যা বিস্ফোরক আইনে মামলা করা হয়েছে। বাবাকে হয়রানি করার জন্য মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। আমাদের পরিবারের সদস্যরা দুশ্চিন্তা রয়েছে। আমার সামনে পরীক্ষা। পড়াশোনা করতে পারছি না বাবার চিন্তায়।’ উচ্ছেদের শিকার হয়ে আদালতে আইনী সহায়তা চাওয়ায় বোমা বিস্ফোরণ মামলায় আসামি হয়েছেন আইনজীবীও। এ্যাডভোকেট গোপীনাথ রায় চৌধুরী বলেন ‘ওই জমিতে বংশপরম্পরায় আমরা প্রায় একশ বছর ধরে ব্যবসা করছি। পুলিশ আমার দোকান ভেঙ্গে ৩ লাখ টাকার মালামাল লুট করেছে। এরপর আমার নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আমাকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে।’ উচ্ছেদের ঘটনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে ই-মেইল এ পাঠানো প্যাড ও স্বাক্ষরবিহীন একটি প্রেস বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, পুলিশ কাউকে উচ্ছেদ করেনি। বরং অবৈধভাবে বসবাসকারীরা স্বেচ্ছায় পুলিশের স্থাপনা ছেড়ে চলে গেছে। জেলা প্রশাসক ড. হুমায়ুন কবীর জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে আইনী ব্যাখ্যার জন্য ওই সম্পত্তির কাগজপত্র সরকারী কৌঁসুলির কাছে পাঠানো হয়েছে। তার মতামত পেলেই প্রয়োজনীয় পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। সরকারী কৌঁসুলি এ্যাডভোকেট সোহেল শামীম জানিয়েছেন, দলিলপত্র যাচাই-বাছাই চলছে। তবে দলিল যার অনুকূলেই থাকুক না কেন যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া ছাড়া উচ্ছেদ চালানো উচিত নয়।
×