ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এখনও অধিগ্রহণ করেনি সরকার

বগুড়ার ঐতিহ্য নওয়াব প্যালেস বিক্রির ষড়যন্ত্র

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বগুড়ার ঐতিহ্য নওয়াব প্যালেস বিক্রির ষড়যন্ত্র

সমুদ্র হক ॥ বগুড়ার নওয়াব প্যালেসের (তদানীন্তন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া) শেষ ঠিকানাটুকু রক্ষার জন্য মোহাম্মদ আলীর ছেলে মেয়ে যখন সরকারকে অধিগ্রহণ করে প্রতœ নিদর্শন হিসাবে রক্ষার আবেদন জানিয়েছেন তখন বগুড়ার একটি প্রভাবশালী শ্রেণী তা ভ-ুল করে নিজেরা সস্তা মূল্যে কিনে নেয়ার পাঁয়তারা শুরু করেছে। এ জন্য তারা কয়েক কোটি টাকা লগ্নি করেছে। লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছে যাতে সরকার তা অধিগ্রহণ না করে। এর আগে নওয়াব বাড়ির ওয়াকফ নন ওয়াকফ করা সহায় সম্পত্তিগুলো নানাভাবে বেদখল হয়েছে এবং নওয়াবের ওয়ারিশগণ পানির দামে বেচে দিয়েছেন। কখনও ওয়াকফ করা সম্পত্তি আইনের তোয়াক্কা না করে বেচে দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ রানার গ্রুপ নামের একটি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান নওয়াব বাড়ি সড়কের ধারে প্যালেস সংলগ্ন যে জায়গাটি কারপল্লী নামের একটি সৃষ্টিশীল শিল্পকর্মের প্রতিষ্ঠানকে দলিল করে লিজ দেয়া হয়েছিল তা কৌশলে কিনে নিয়েছে। একাধিক সূত্র জানায় ৫০ শতকের এই ভূমি কেনাকাটায় অনিয়ম করা হয়েছে এবং সরকারকে বহু অঙ্কের টাকা কর ফাঁকি দেয়া হয়েছে। যার তদন্ত আজও হয়নি। বর্তমানে নওয়ার প্যালেসের ভেতরের ১৭০৮ দাগে ৩ দশমিক ১২ একর ভূমির ওপর নওয়াবের যে বাসভবন, দৃষ্টিনন্দন মিউজিয়াম, বিরল প্রজাতির জয়তুন ও কর্পূর গাছ টিকে আছে তা রক্ষার জন্য প্রয়াত মোহাম্মদ আলীর কানাডা প্রবাসী ছেলে সৈয়দ মাহমুদ আলী ও তার স্ত্রী জোডি ম্যাকডোনাল্ড বগুড়ায় এসে পৈত্রিক বাড়ি সরকারকে অধিগ্রহণের আবেদন জানিয়েছেন। সৈয়দ মাহমুদ আলী বগুড়ায় এসে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন তিনি এবং তার বোন মাহমুদা বেগম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনেক সম্পত্তি তাদের ওয়ারিশগণ নষ্ট করেছেন, অনেক ভূমি বেহাত হয়ে গেছে। বর্তমানে যে বসতভিটাটুকু টিকে আছে তা যেন নষ্ট না হয় সেজন্য সরকারের কাছে তা দ্রুত অধিগ্রহণ করার আবেদন জানিয়েছেন। তারা আশা করেন এই ভূমি প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের কাছে সরকার হস্তান্তর করলে বগুড়ার নওয়াব পরিবারের কয়েকশ’ বছরের ঐতিহ্য রক্ষা হবে। উল্লেখ করা যায় বগুড়ায় প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার যে আঞ্চলিক অফিস একটি ভাড়া বাড়িতে রয়েছে তা এতটাই স্বল্প পরিসরের ও জরাজীর্ণ যে কর্মকর্তারা ঠিকমতো স্বাচ্ছেন্দ্যে কাজ করতে পারেন না। বগুড়ার নওয়াব বাড়ির শেষ ঠিকানাটুকু যখন সরকারকে অধিগ্রহণের আবেদন জানানো হয় তখন বিষয়টি প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের কর্মকর্তরা জেনে ফাইল প্রসেস শুরু করেন। ভূমি অধিদফতর থেকে কাগজপত্র ঠিকঠাক করা হয়। এই খবরটি জানাজানি হলে বগুড়ার প্রভাবশালী একটি চক্র (যাদের অনেকে ভূমিগ্রাসী নামে পরিচিত) সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেনদরবার শুরু করেন। তারা লন্ডনে অবস্থানরত মোহাম্মদ আলীর দুই ছেলে হামদে আলী ও হাম্মাদ আলীকে বশ করার চেষ্টা করছেন। উল্লেখ্য ইতোপূর্বে হামদে আলী ও মোহাম্মদ আলীর বৈমাত্রীয় ভাই প্রয়াত ওমর আলী চৌধুরী (জ্যাকি সাহেব নামে অধিক পরিচিত) তাদের অনেক সম্পত্তি পানির দামে বেচে দিয়েছেন। তাদের বসত ভিটার ধারে যে কয়েক একর ভূমি (১৭০৭ দাগ) ওয়াকফ’ এস্টেট বেআইনীভাবে তাও বেচে দিয়েছেন দুই বিড়ি মালিত ও একজন বেসরকারী সংস্থার কাছে। ওই বেসরকারী সংস্থা বহুতল মার্কেট নির্মাণ করার সময় করতোয়া নদীভূমি বেদখল করে নিয়ে অবকাঠামো গড়েছেন। বিড়ি মালিকও বহুতল মার্কেট নির্মাণ করেছেন ওয়াকফ’ সম্পত্তির ওপর। এত সবই ঘটেছে প্রশাসনের সামনে। কোন বাঁধাই দেয়া হয়নি। এদিকে নওয়াব সোবাহান চৌধুরীর উত্তরাধিকারী মোহাম্মদ আলী বগুড়ার দুই স্ত্রীর প্রথম পক্ষের দুই ছেলে হাম্মাদ আলী ও হামদে আলী (লন্ডন প্রবাসী) এবং দ্বিতীয় পক্ষের এক ছেলে মাহমুদ আলী (কানাডা প্রবাসী) ও মেয়ে মাহমুদা (জাতিসংঘের ত্রাণ ও পুনর্বাসন সেকশনের পরিচালক) এর মধ্যে প্রথম পক্ষের ছেলে হামদে আলী বগুড়ায় নওয়াবের সম্পত্তি রক্ষা করতে এসে বিক্রি করে দেন সামনের ৫০ শতক জায়গা। যে জায়গা কিনেছে রানার গ্রুপ। তারা যখন বগুড়া এসেছেন কেউই সম্পদ রক্ষা করেননি। তাদের ভাইপোরা এসেও সম্পদ রক্ষা করেন নি। সর্বশেষ গেল জানুয়ারি মাসে এস মাহমুদ আলী বগুড়ায় এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে বসে তাদের শেষ ঠিকানাটুক সরকারকে দেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। সেই অনুযায়ী জেলা প্রশাসনকেও জানান। জেলা প্রশাসকও বিষয়টি ওপর মহলে জানিয়েছেন। বগুড়ার ভূমিগ্রাসী চক্র ও প্রভাবশালীরা এখন কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে যে ভাবেই হোক প্যালেস দখল করতেই হবে। এদিকে নওয়াব পরিবারের এস মাহমুদ আলী পূর্ণ মতামত ব্যক্ত করে সাফ বলেন, বগুড়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক এই নওয়াব বাড়ির যে অংশটুকু এখন টিকে আছে তা তিনি ও তার বোন সরকারকে দেবেন। সরকার এখনই বগুড়ার ঐতিহ্য সংস্কৃতি ইতিহাস রক্ষায় এই সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে তাহলে তার (সৈয়দ মাহমুদ আলী) ও তোর বোন মাহমুদার কোন আপত্তি থাকবে না। বগুড়া শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথা থেকে দেড়শ’ মিটার পূর্বে কয়েকশ’ বছরের অনেক ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই নওয়াব বাড়ি। যার নাম নওয়াব প্যালেস। একে একে সবই নিভে গিয়ে বর্তমানে যে বসতভিটাটুকু টিকে আছে তাও আর রইবে কি না এ নিয়ে সংশয় দানা বেঁধেছে। একদার বগুড়ার এই জমিদার পরিবার এতটাই বনেদী ছিল যে এলাকার লোকজন তাদের সম্মান করত। মোহম্মাদ আলীর পরিবারের অনেক কীর্তি আজও আছে। যেমন বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল। নারীকে প্রগতির পথে নিয়ে যেতে প্রতিষ্ঠা করেন তহুরুন্নেছা মহিলা ক্লাব। বগুড়ার বিভিন্ন গ্রামে অনেক সম্পত্তি দাতব্য চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য দান করে গেছেন। সত্তরের দশকের মধ্যভাগ থেকে এইসব সম্পত্তি নানা ভাবে বেচাকেনা শুরু হয়। তখনই একাধিক অসাধু চক্র নওয়াব পরিবারে ঢুকে পড়ে। একই সঙ্গে শুরু হয় সম্পত্তি বেহাত হওয়ার পালা। এরপরই শহরের একাধিক ধনাঢ্য ব্যক্তি মোহাম্মদ আলীর বসত ভিটা কেনার দেনদরবার শুরু করে। মোহাম্মদ আলীর তিন ছেলের মধ্যে এক ছেলের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখে। এই নওয়াব বাড়ি শুধু ঐতিহ্যই নয় বাড়ির ভিতরে বিরল জয়তুন ও কর্পূর বৃক্ষ রয়েছে। বেচা কেনা হলে ঐতিহ্য তো থাকবেই না বিরল প্রজাতির গাছ দু’টিও কুঠারের আঘাতে মারা যাবে। বগুড়ার ঐতিহ্য চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে।
×