ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কবির গ্রাম কাশতলা, গ্রামকে ভালবেসে তিনি নাম রেখেছেন কাশবন

রামসুন্দর পাঠাগার ॥ নির্মলেন্দু গুণের কাশবনে

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

রামসুন্দর পাঠাগার ॥ নির্মলেন্দু গুণের  কাশবনে

আমার একটি ছোট্ট সুন্দর গ্রাম ছিল/তার নামটিও ছিল ভারী সুন্দর- কাশতলা/হয়তো এক সময় কাশফুলের খুব প্রাচুর্য ছিল ঐ গ্রামে/আমি কবিত্ব করে তার নাম পাল্টে রেখেছিলাম কাশবন/ ভালোবেসে প্রেমিক যেমন তার প্রেমিকার নাম পাল্টে রাখে/ সে-ই আমার প্রথম কবিতা...’। নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলা সদর থেকে পাকা সড়ক ধরে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে এগোলেই স্বাগতম-স্তম্ভে চোখে পড়বে কবিতাটি। স্তম্ভের ওপরের অংশে লেখা ‘স্বাগতম কাশবন।’ কাশবনের প্রকৃত নাম ‘কাশতলা।’ আর দশটি গ্রামের মতোই শান্ত, সুনিবিড়, ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা গ্রাম। জন্মের অধিকার নিয়ে, মাতৃবৎ ভালবেসে কবি নির্মলেন্দু গুণ তার গ্রামের নামটি পাল্টে রেখেছেন ‘কাশবন।’ তাই কাশতলার পরিচিতি এখন ‘কাশবন’ নামে। শুধু কবি নন, কবির গ্রামবাসীও এখন ‘কাশবন’ এর বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। কবির এই কবিত্বকে সম্মান করে তারা। কবির মা কবিকে ‘জন্ম দিয়ে মরে গিয়েছিলেন মাকড়সার মতো।’ মাকে ছাড়াই কবি কাশবনে কাটিয়েছেন শৈশব-কৈশোরের ষোলোটি বছর। তাই কাশবনই এখন কবির মা। মাকে যেমন ভালবাসে সন্তান, তেমনি কবিও ভালবাসেন কাশবনকে। কাশবনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন কবির। আর সেই স্বপ্নের পথ ধরে তিনি কাশবনে প্রতিষ্ঠা করেছেন সমৃদ্ধ পাঠাগার, বিদ্যানিকেতন, চিত্রশালা, সংগ্রহশালা, শহীদবেদী, মঞ্চ, ভাস্কর্য, সরোবর, শানবাঁধানো ঘাট আরও কত কী! রামসুন্দর পাঠাগার ॥ মানসম্মত শিক্ষার জন্য চাই মানসম্মত পাঠাগার। ২০০৯ সালে নির্মলেন্দু গুণ কাশবনের নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন আধুনিক ও সমৃদ্ধ পাঠাগার। তার প্রয়াত ঠাকুরদাদার নামে পাঠাগারটির নাম রাখেনÑ ‘রামসুন্দর পাঠাগার।’ পাঠাগারের প্রবেশ মুখে রেখেছেন রামসুন্দর গুণের ম্যুরাল। কবি জানান, ‘জেমকন সাহিত্য পুরস্কার’ থেকে প্রাপ্ত দু’লাখ টাকার পুরোটাই ব্যয় করেন স্বপ্নের পাঠাগারের জন্য। আধাপাকা-টিনশেড ঘরের কয়েকটি আলমিরায় থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে পাঁচ হাজার বই। বই পড়ার সুবিধার্থে রাখা হয়েছে টেবিল চেয়ার। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সহযোগিতায় পাঠাগারে চালু করা হয়েছে ইন্টারনেট সংযোগসহ কম্পিউটার। পাঠাগারের এক শ’ গজের মধ্যে কাশবন বিদ্যানিকেতন। এই উচ্চ বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা কবি নিজেই। ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য রামসুন্দর পাঠাগারের বই পড়া বাধ্যতামূলক। শিক্ষার্থীরা নিয়মিত এখানে বই ও পত্র-পত্রিকা পড়ে। আসে এলাকার এবং দূরান্তের পাঠকরাও। কেউ বই পড়ে, কেউ কম্পিউটার ইন্টারনেট ব্যবহার করে। কাশবন বিদ্যানিকেতনের সহকারী গ্রন্থাগারিক শিল্পী রানী সাহা পাঠাগারটি দেখভাল করেন। কাশবন বা রামসুন্দর পাঠাগারের কার্যক্রম শুধু এ সবেই সীমাবদ্ধ নয়। ২০১১ সালে কবি পাঠাগারের পেছনে নতুন আরেকটি আধাপাকা বিল্ডিং নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বীণাপাণি-চারুবালা সংগ্রহশালা।’ কবির জন্মদাত্রী মা বীণাপাণি দেবী এবং সৎ মা চারুবালার নামে এটির নামকরণ করা হয়। জন্মের পর কবির মাতৃবিয়োগ ঘটলে দ্বিতীয় মা চারুবালার কোলেপিঠে বড় হন কবি। ভারত থেকে প্রাপ্ত গৌরকিশোর সাহিত্য পুরস্কারের টাকায় মার্বেল পাথর আর পোড়ামাটির টাইলস্ দিয়ে নির্মিত সংগ্রহশালাটির নির্মাণশৈলী নান্দনিক। বিভিন্ন সময়ে কবির পুরস্কারের ক্রেস্ট, সনদ, বিভিন্ন দেশের উপহার সামগ্রী, চিঠিপত্র, পা-ুলিপি, অতি দুর্লভ বইপত্র, ছবি, স্মারক মুদ্রা ছাড়াও সংগ্রহশালায় শোভা পাচ্ছে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের নানা নিদর্শন এবং কবির পরিবারের সদস্যদের নানা স্মৃতি-চিহ্ন। কবির এক দাদু সারদা রায় ছিলেন প্রখ্যাত তৈলচিত্র শিল্পী। অন্যদিকে তাঁর বাবা সুখেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরীও (বাসুদেব) চিত্রশিল্পী ছিলেন। কবি নিজেও ছবি এঁকে খ্যাতি অর্জন করেছেন। কবি বিশ্বাস করেন, ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে শিশুদের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ হয়। তাই ২০১১ সালে তার এলাকার শিশুদের জন্য জনতা ব্যাংকের আর্থিক অনুদানে কাশবনে প্রতিষ্ঠা করেন চিত্রশালা। নামকরণ করেন তার চিত্রশিল্পী দাদু এবং বাবার নামেÑ ‘সারদা-বাসুদেব চিত্রশালা।’ এলাকার শিশু-কিশোররা সেখানে বিনা খরচায় ছবি আঁকা শিখছে। পাশাপাশি সেখানে নিয়মিত চলছে ‘শৈলজা সঙ্গীত ভুবন।’ বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ‘শৈলজারঞ্জন মজুমদারের নামে প্রতিষ্ঠিত ওই সঙ্গীত শিক্ষায়তনটি পরিচালনা করছেন স্থানীয় শিল্পী দুলাল চৌহান। কাশবনে নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা যাতে বাঙালীর ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারেÑ সেদিকটাও গুরুত্ব দিয়েছেন কবি। তাই ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে ২০১০ সালে রামসুন্দর পাঠাগারের সামনে নির্মাণ করেছেন ‘শহীদবেদী’। মার্বেল পাথর আর সেন্ট স্টোনের তৈরি ১১ ফুট দীর্ঘ বেদীটির মূল স্তম্ভের একপাশে আছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ছবি। ছবির নিচে মোটা হরফে লেখাÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বেদীর অন্যপাশে মাতৃভাষা দিবসের কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি।’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসসহ প্রতিটি জাতীয় দিবস পালন করা হয় সেখানে। বেদীর পাশে নির্মিত ‘বীরচরণ মঞ্চে’ বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা, নাটক, আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কয়েক বছর ধরে এলাকাবাসী কবির জন্মদিনও উদযাপন করছে এ মঞ্চে। নির্মলেন্দু গুণ জানান, ‘বীরচরণ সাধু নামে কাশতলা গ্রামে লোককবি ছিলেন। হদি সম্প্রদায়ের এ শিল্পীকে স্মরণীয় করে রাখতেই মঞ্চটির নাম রাখা হয় বীরচরণ মঞ্চ।’ ইতোমধ্যে অনেক মন্ত্রী, এমপি, জনপ্রতিনিধি, আমলা, কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীর ‘চরণধুলো’ পড়েছে বীরচরণ মঞ্চে। এছাড়াও রামসুন্দর পাঠাগার চত্বরে স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল মধুসূদন ও বিজ্ঞানী নিউটনের ভাস্কর্য। শান্ত সুনিবিড় কাশবনের শোভাবর্ধন করতে পাঠাগারের সামনে ও পেছনে কবি নিজ উদ্যোগে খনন করেছেন দু’টি পুকুরÑ ‘সুখেন্দু সরোবর’ ও ‘কামিনী সরোবর’। নামকরণ কবির বাবা এবং ঠাকুরমার নামে। দু’টোতেই শানবাঁধানো ঘাট। স্বচ্ছ টলটলে পানি। মাছের লাফালাফি। বুক জুড়ে লাল শাপলার জমিন। দুই পুকুরের মাঝখানের মূল ভিটায় কবির টিনশেড বসতঘর। বাড়িতে এলে তিনি এ ঘরটিতে থাকেন। বাড়ির এখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে আছে নারকেল-সুপারিসহ বিভিন্ন ফলের গাছ। গাছের ডালে বাবুইয়ের বাসা। পাখির কলকাকলি। গাছের নিচের ছায়ায় নিমগ্ন চিত্তে বসে থাকার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে পাকা বেঞ্চ। এমন অনেক কিছুই আছে কাশবনে। অন্তিম গন্তব্য ॥ ‘কাশবন’ কবি নির্মলেন্দু গুণের শৈশবের-কৈশোরের খেলার সাথী। কাশবন তার মা। কাশবনের প্রতি তার ভালবাসা অন্তহীন। তাই ব্যস্ত শহরের নাগরিক কোলাহল ছেড়ে নাড়ির টানে প্রায়ই কাশবনে ছুটে আসেন কবি। গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের সঙ্গে মিশে কখনও কখনও হয়ে ওঠেন অতি সাধারণ। আবার একটু অবসর পেলেই গ্রামের সবুজ মাঠের বুকে রেখা টেনে যাওয়া মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যান তিনি। কবি বলেন, ‘কাশবন আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম। তাই কাশবন আমাকে বারবার কাছে টানে। আসলে কাশবন-ই যে আমার অন্তিম গন্তব্য।’ Ñসঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে
×