ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

নতুন যখন পুরনো হয়ে যায়

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

নতুন যখন পুরনো হয়ে যায়

১৯৬৮ সালে লন্ডনের কনটেম্পোনারি আর্টস ইনস্টিটিউট এক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল যার নাম ‘সাইবারনেটিক সেরেনডিপিটি’। ব্রিটেনের এই প্রথম এ ধরনের এক প্রদর্শনীতে শিল্পকলা ও নতুন প্রযুক্তির মধ্যে যোগসূত্র প্রদর্শনের চেষ্টা করা হয়। প্রদর্শনীটি দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং অতীত পর্যালোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে হয় বেশ সময়োচিত হয়েছিল। প্রদর্শনীটি চলার সময় শিল্পকলা ও প্রযুক্তির মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। একটা হলো পপ-আর্ট আন্দোলন যা উচ্চমার্গের শিল্পকলা ও দৈনন্দিন জীবনের মধ্যকার সীমারেখা ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছিল। অন্যটা হলো কম্পিউটার-টু-কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ‘আরপানেট’ যা পরবর্তীকালে ইন্টারনেটের রূপ ধারণ করে। শিল্পকলা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার জন্য কী কী গুণ বা ধর্ম থাকা দরকার এবং শিল্পী হিসেবে দাবিদার হওয়ার যোগ্যতা কার আছে সে সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত ধ্যান-ধারণাগুলো ইন্টারনেট ক্রমাগত ক্ষয় করে চলেছে। নতুন এক শ্রেণীর শিল্পকলার বিকাশ ঘটছে। যেমন নেট আর্ট, নিউ মিডিয়া আর্ট, নিউ এসথেটিক, ইন্টারনেট আর্ট, পোস্ট-ইন্টারনেট আর্ট। অনলাইনে বিক্রয় ও প্রদর্শনী উত্তরোত্তর অতি প্রচলিত হয়ে উঠছে। ঠিক তেমনি শুধুমাত্র ডিজিটাল রূপে অস্তিত্বমান শিল্পকলা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কেনাবেচা হচ্ছে। ইমেজ ও ভিডিও শেয়ারিং এ্যাপ ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে সফল ক্যারিয়ার এবং ব্যয়বহুল সংগ্রহের ভা-ার গড়ে তোলা হচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীরা দিনে ৮ কোটি ফটোগ্রাফ পোস্ট করছে। লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত ‘ইলেকট্রনিক সুপারহাইওয়ে (২০১৬-১৯৬৬)’ নামে এক নতুন প্রদর্শনীতে দেখানো হয়েছে কিভাবে শিল্পীরা নতুন নতুন প্রযুক্তি ও পরিবর্তনে সাড়া দিচ্ছে কিংবা সে অনুযায়ী নিজেদের ধাতস্থ করে নিচ্ছে। প্রযুক্তিগুলো কত দ্রুত সেকেলে হয়ে যাচ্ছে এবং এসব প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত শিল্পকলাও কিভাবে এর সঙ্গে বুড়িয়ে যাচ্ছে সেটার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণই এই প্রদর্শনীর লক্ষ্য। প্রদর্শনীটি বিন্যস্ত করা হয়েছে সময়ের বিপরীত ক্রম অনুসারে। প্রথম কক্ষে দেখানো হয়েছে ২০০০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ের শিল্পকলা ও প্রযুক্তি। এটি শিল্পকলা ও প্রযুক্তির এক বেসুরো সমাহার যেখানে সামাজিক মাধ্যম, গেমিং, থ্রিডি প্রিন্টিং, কম্পিউটার নির্মিত ছবি, ব্রাউজার, ইন্টারফেস ও স্মার্টফোনের মতো প্রযুক্তি ও ভিজ্যুয়াল ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্পকলাগুলো নির্মিত। পরবর্তী কক্ষগুলোতে প্রযুক্তি এনালগ টিভি মনিটরের মতো বেঢপ দেয়ালের রূপ ধারণ করেছে যা অপেক্ষাকৃত বয়স্ক দর্শনার্থীদের স্মৃতিকাতর করে তোলে এবং তরুণদের কাছে নেহায়েত ইতিহাসগত কৌতূহলের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আজকের যেসব শিল্পী প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন তারা দারুণভাবে সচেতন যে, তাদের কাজের বয়স বাড়ছে। কাজটা বুড়িয়ে যাচ্ছে। নিজেদের শিল্পকর্মের বিষয়বস্তুর অনিবার্যরূপে সেকেলে হয়ে যাওয়াটা প্রতিফলিত কার জন্য যেমন কোরি আরকানজেল কিংবা পেট্রা কোর্টরাইটের মতো কেউ কেউ লো-টেক গ্রাফিক্স, সেকেলে সফটওয়্যার ও রেট্রো হার্ডওয়্যারকে বিদ্রƒপাত্মক নান্দনিকতা হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। অন্যরা ইন্টারনেটের ভিজ্যুয়াল ভোকাজুলারিকে চরমতম রূপে নিয়ে যান। এদের মধ্যে আছেন রায়ান ট্রিকারটিন ও কামিল হেনরট, যার ‘গ্রস ফ্যাটিগ’ ছবিটিতে একটার পর একটা স্তরে আছে ভিডিও ক্লিপ, ফটোগ্রাফ এবং ইন্টারনেট স্ক্রিনগ্র্যাব। জার্মান চলচ্চিত্র নির্মাতা হারুন ফারুকী ২০১৪ সালে মারা যাওয়ার ঠিক আগে নির্মাণ করেছিলেন ‘প্যারালাল ১-৪’ নামক ছায়াছবি। অনলাইন সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ছিল এই যে, কোন ছবির অসম্পূর্ণতা বা ত্রুটি-বিচ্যুতি করার জন্য অচিরেই বাস্তবতা আর মানদ- হিসেবে থাকবে না। তার পরিবর্তে ভার্চ্যুয়াল ইমেজ বাস্তবতার গলদ বা অসম্পূর্ণতা পরিমাপ করার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়াবে। জোনাস লুন্ড নামে এক শিল্পী বলেন, প্রতিটি বড় অনলাইন কর্পোরেশন যেমন ফেসবুক, টুইটার, এ্যামাজন ইবে আপনাকে যথাসাধ্য ব্যবহার করছে। আপনার কাছ থেকে যতটা পারে আদায় করে নিচ্ছে। কাজেই একজন শিল্পী একই কৌশল কাজে লাগাবে না কেন? তার শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে দর্শকের খোদ আচরণের বিশ্লেষণ। যেমন একটি হলো ‘ভিআইপি (ভিউয়ার ইমপ্রুভড পেইন্টিং) ২০১৪’-এর মধ্যে রয়েছে এমন এক এলগোরিদম যা দর্শক কোন দিকে তাকায় তার ভিত্তিতে এক তরঙ্গায়িত। বিমূর্ত রচনা ইনস্টাগ্রাম যে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করে শিল্পী লুন্ড ব্যঙ্গাত্মকরূপে সেই ধারণাই দেয়ার প্রয়াস পান। সেই ধারণাটি হলো : প্রত্যেকেই একজন শিল্পী। বস্তুতপক্ষে এটা এমন এক সমস্যা যা হোয়াইচ্যাপেলের প্রদর্শনীতে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সমস্যাটা হলো অনেক সময় ব্যক্তিগত সত্তাবোধ এমনকি সত্যিকারের মানব অনুভূতি খুঁজে পাওয়াও বেশ কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। প্রযুক্তি ও শিল্পকলার মধ্যকার প্রতিবন্ধকতাগুলো ভেঙ্গে দেয়া হলে শিল্পকলা প্রযুক্তিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। তবে এতে একটা ঝুঁকিও রয়েছে এবং তা হলো এতে করে শিল্পকলা এলগোরিদমের মতো একটা অন্তঃসারশূন্য মামুলি জিনিসে পর্যবসিত হতে পারে। সূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট
×