ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বসন্তে রঙিন তারুণ্যের গ্রন্থমেলা

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বসন্তে রঙিন তারুণ্যের গ্রন্থমেলা

যতদিন যাচ্ছে তত জমে উঠছে বাঙালীর প্রাণের বইমেলা। মানুষজনের ভিড়ে মুখরিত বাংলা একাডেমি প্রান্তর। এ যেন লেখক-পাঠকের এক মহাসমাবেশ। তরুণ-তরুণীদের আড্ডায় জমে উঠছে বইমেলা। বাচ্চারা তাদের বাবা-মা’র হাত ধরে বিভিন্ন স্টল ঘুরে বই দেখছে। বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সকলেই ভিড় জমাচ্ছে বইমেলায়। প্রতিদিন মেলায় মোড়ক উন্মোচিত হচ্ছে অনেক নতুন বইয়ের। মেলায় প্রবীণ লেখকদের পাশাপাশি তরুণ লেখকদেরও বই আছে। মেলা ঘুরে দেখা গেছে, তরুণ লেখকদের বই-ই বেশি। লেখক-পাঠকের সেতুবন্ধ তৈরির আয়োজন অমর একুশে বইমেলা নতুন লেখকদের জন্য ভিন্নমাত্রা যোগ করে প্রতিবছর। কেউ হাসেন বইয়ের কাটতি দেখে, কেউ নজর কাড়েন লেখনীর ধারে। বাংলা একাডেমির মেলায় কী ধরনের বই প্রকাশিত হয়, কোন্ ধরনের বই বেশি চলে, এসব বইয়ের ক্রেতাই বা কারা- এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া ভার। সাধারণত কবিতা, গল্প ও উপন্যাসের বই-ই মেলায় বেশি আসে। এছাড়া প্রবন্ধ, অনুবাদ, জীবনী, রচনাবলীও মেলায় আসে। ছোটদের জন্য ফিকশনধর্মী লেখা ছাড়া গল্প, ছড়া, উপন্যাস, রূপকথা ইত্যাদি বইও প্রকাশিত হয়। জনপ্রিয় ও পাঠকনন্দিত লেখকের বই ছাড়া অবসরপ্রাপ্ত আমলা, প্রবাসী বাঙালী কিংবা নবীন লেখকের কাঁপা হাতের প্রথম লেখাটিও ফেব্রুয়ারির বইমেলায় প্রকাশের অপেক্ষায় থাকে। মেলার রমনা অর্থাৎ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবারের বইমেলার ভিড় চোখে পড়ার মতো। কালীমন্দিরের প্রবেশদ্বারের বইয়ের স্টলগুলোতেই বেশিরভাগ দেখা মিলবে একঝাঁক তরুণ লেখকের, গাঁটের পয়সা খরচ করে যাঁরা নিজেরাই বিভিন্ন নামে ও আকারে বই প্রকাশ করেন। এসব তরুণ লেখক-লেখিকা, প্রকাশক সবাই সৃষ্টিশীল। তাঁদের চিন্তা-চেতনায়ও আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্কতার বিষয়টি ক্রিয়াশীল। বলতে গেলে এসব তরুণ লেখক আর প্রকাশক মেলার অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ে। এই চত্বরে তারুণ্যের সমারোহ, উচ্ছ্বাস আগামী দিনের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উজ্জ্বল দিকটিকেই যেন আরও বেশি করে উদ্ভাসিত করে। বরাবরের মতো এবারের মেলাতেও শতাধিক তরুণ লেখকের নতুন বই এসেছে। এসব বইয়ের মধ্যে কিছু বই ইতোমধ্যেই ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এবারের মেলায় তরুণ লেখকদের আসা শতাধিক বইয়ের মধ্যে কবিতার বই বেশি। তারুণ্যনির্ভর প্রকাশনী ‘ঘাসফুল’ থেকে কবিতা, গল্পনির্ভর বই বেরিয়েছে। ‘আমিও ঈশ্বরের মতো একা’ যা তরুণ কবি কবির কল্লোলের এক অনবদ্য সংস্করণ। ঘাসফুল প্রকাশনী থেকে কবিতাপ্রেমী পাঠক-পাঠিকারা বেছে নিতে পারেন কবি সোয়েব মাহমুদের ‘আড়াইতলা সিঁড়িঘরে ব্যক্তিগত নিঃশ্বাস’, তপু মজুমদারের ‘তোমাদের গল্প’, তারুণ্যের জনপ্রিয় কবি রাকিবুল হায়দারের ‘আবার কোনো সমুদ্রজন্মে দেখা হবে’, কবি চৌধুরী ফাহাদের ‘কবি তার কবিতার সংশয়’ এবং কবি কালপুরুষের কবিতার বই ‘রোহিণীর জন্য একটি রাষ্ট্র’ নামক চমৎকার বই। সবগুলো বই-ই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বইগুলো পাওয়া যাবে ১৩৭নং স্টলে। তরুণ লেখকদের জন্য গ্রন্থমেলার গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে ‘ঘাসফুল’ প্রকাশনীর কর্ণধার ও তরুণ লেখক মাহাদী আনাম বলেন, ‘তরুণ লেখকদের বই প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে বইমেলা। কারণ আমার কাছে মনে হয় এখনকার যুগের মানুষের বই পড়ার প্রবণতা কিছুটা কম। তাই প্রকাশকরা বইমেলা ছাড়া বই প্রকাশে আগ্রহ দেখান না। কিন্তু বইমেলায় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সমাগম ঘটে, যারা বই পড়তে আগ্রহী। বিশেষ করে তরুণ পাঠক-পাঠিকারা। তাই প্রকাশকরাও মেলায় প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি তরুণ লেখকদের বই প্রকাশ করেন। তবে আমি তারুণ্যের কবিদের নিয়েই কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।’ ধ্রবপদ প্রকাশনীর থেকে প্রকাশিত তারুণ্যের কবি মনিরুজ্জামান মিন্টুর ‘পাখির চোখে শীতঘড়ি’ বইটি পাঠক ও সম্মানিতজনের নিকট ভ’য়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে।রাজবাড়ি জেলার প্রিয়মুখ এই কবির পূর্বের বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘পৌষের পত্রে মুখরিত গান’,জলমেঘ’ ও ‘নীল বিবর্ণ তুলি’। অমর একুশে বইমেলায় এসেছে সাহিত্যিক ও মডেল অরণ্য পাশা’র আত্ম-স্মৃতিমূলক ছোট গল্পের বই ‘আনন্দ আশ্রম’। ইতোমধ্যে পাঠকদের কাছে বেশ কৌতুহল জাগিয়েছে এ বইটি।আনন্দ আশ্রম প্রসঙ্গে অরণ্য পাশা বলেন, ‘এ শহরে পালিয়ে আসার আগে আমার একটা জীবন ছিলো। আমার সৃমদ্ধ শৈশব, কৈশোর,টুকরো টুকরো স্মৃতি। এ শহরে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার গল্প। এই সব দোলাচলের গল্প নিয়েই আননন্দ আশ্রম। আশা করি বইটি পড়ে পাঠকেরা নস্টালজিয়ায় ভুগবেন। স্মৃতি এসে উঁকি দিবে মনের কোণে।’আনন্দ আশ্রম এর প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। পাওয়া যাচ্ছে দেশ পাবলিকেশন্সের ৪০৭-৪০৮ নং স্টলে। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় চৈতন্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে শিমুল সালাহ্উদ্দিনের চতুর্থ কবিতার বই ‘সংশয়সুর’। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ১৫৬ নম্বর এবং লিটলম্যাগ চত্বরের ৫২ নম্বর স্টলে বইটি পাওয়া যাবে। প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী রাজীব দত্ত। বইটি সম্পর্কে জানতে চাইলে শিমুল সালাহ্উদ্দিন বলেন, সংশয়সুরের কবিতাগুলো একটা বড় টাইমস্প্যানে লেখা। এই বই মূলত মানব মন, সমাজ, শরীর ও এসবের দ্বিধা বা ডুয়ালিটি নিয়ে ডিল করেছে। ডিল করেছে যৌনতা, নৈতিকতা এমন সব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে। লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী মাইদুর রহমান রুবেলের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘টেলিভিশন সংবাদ ও সাংবাদিকতা’ প্রকাশিত হয়েছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৬ উপলক্ষে বইটি প্রকাশ করেছে প্রতিভা প্রকাশ। মেলার প্রথম দিন থেকেই পাওয়া যাচ্ছে প্রতিভা প্রকাশের স্টলে। আর অনলাইনে বইটি বাজারজাত করবে রকমারি ডটকম। বইটি সর্বমহলে সমাদৃত হবে বলে আশা করছেন প্রকাশনা সংস্থা প্রতিভা প্রকাশের কর্ণধার কবি মঈন মুরসালিন। টেলিভিশন সংবাদ ও সাংবাদিকতা পাওয়া যাবে একুশে বইমেলার ৪৭১-৪৭২ নম্বর স্টলে। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী রাজিব রায়। অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে লেখক, সাংবাদিক রণক ইকরামের উপন্যাস ‘অতিমানব’। অদ্ভুত রহস্যে ভরা ইতিহাস আশ্রয়ী এই উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে প্রিয়মুখ প্রকাশনী। একুশে বইমেলায় অতিমানবের দেখা মিলবে প্রিয়মুখ প্রকাশনীর ১০৯ নম্বর স্টলে। এছাড়াও চৈতন্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত তরুণ লেখক শামীম আহমেদ জিতুর ‘নিমিষেই নিষিদ্ধ তুমি’, আদি প্রকাশনী থেকে রাসয়াত রহমানের ‘যে প্রহরে নেই আমি’, দেশ পাবলিকেশন্স থেকে কাসাফাদ্দৌজা নোমানের ‘জীবন বৃত্তান্তে নেই’ এবং অনিন্দ্য প্রকাশনী থেকে মাহবুব ময়ূখ রিশাদের ‘দিকশূন্যপুর’ বইগুলো পাঠক মহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।তবে কয়েকজন তরুণ লেখক জানালেন, তাদের বই প্রকাশের উচ্ছ্বাসের পেছনের অনেক গল্প অনুচ্চারিতই থেকে যায়; পাঠকরাও জানেন না কী বিসর্জন দিতে হয় একটি বইয়ের জন্য। অধিকাংশ প্রকাশক তরুণদের বই বের করার পেছনে অনীহা প্রকাশ করেন- বিশেষ করে প্রথম বই। প্রকাশকরা মনে করেন, ঝুঁকি নিতে হয় তরুণ লেখকদের বই প্রকাশে। স্বভাবতই প্রথম বই প্রকাশে অনেক ঝক্কি-ঝামেলার মধ্য দিয়ে এগোতে হয় একজন তরুণ লেখককে। তারপরও কিছু কিছু প্রকাশক তরুণদের সুযোগ করে দিতে মহতী উদ্যোগ নিয়ে থাকেন। তরুণদের প্রথম বই বের করেন। বসন্তের প্রথম দিন বন্ধুরা মিলে মেলায় এসেছিলেন ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা। এদের একজন আফরিন প্রিমা বলেন, ‘এবার মেলায় অনেক জায়গা। ঘুরেফিরে বই দেখা যাচ্ছে। ভাল লাগছে।’ পাশ থেকে প্রিমার বন্ধু রুপা বলে ওঠে, ‘চারটি বই কিনেছি। আরও কিনব।’ বসন্তের প্রথম দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তরুণ-তরুণীদের ভিড় থাকে যথেষ্ট। তারা প্রায় সবাই একবারের জন্য হলেও ঢুঁ মারেন বইমেলায়। কেনেন প্রিয় লেখকদের বই। আর এজন্য বসন্তের আগেই প্রকাশকরা তাদের প্রকাশিত বেশিরভাগ বই মেলায় এনেছেন। এদিকে পাঠকরা অভিযোগ করেছেন, এবারের মেলা গোছানো নয়। ভেতরে প্রচুর জায়গা থাকলেও মেলার স্টলক্রমে ঝামেলা রয়েছে। নির্ধারিত স্টল খুঁজে পেতে তাদের ঘুরতে হচ্ছে, অতিরিক্ত সময় নষ্ট হচ্ছে। এছাড়াও একমাত্র খাবারের স্টল রয়েছে বাংলা একাডেমির মূল প্রাঙ্গণে, যার আগুন লাগা দামে মেলায় ঘুরতে আসা বই ক্রেতারা না খেয়েই সারা বইমেলা ঘুরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। বাংলা একাডেমির বটতলা চত্বরে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৩২টি বই দিয়ে চিত্তরঞ্জন সাহা বই প্রদর্শনী ও বিক্রি শুরু করছিলেন। সময়ের বিবর্তনে সেটিই আজ লাখো মানুষের প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে। বিস্তৃত হয়েছে মেলার পরিধি। বইমেলার ব্যাপ্তি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে তৎসংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তারলাভ করেছে। ফেব্রুয়ারিজুড়ে লাখো মানুষের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বই কিনতে যেমন মানুষের ভিড় থাকে, তেমনি মেলা দেখতে, প্রিয় লেখকদের সঙ্গে ছবি তুলতে, কথা বলতেও অনেকেই চলে আসেন বইমেলায়। আমাদের দেশে বইয়ের একটি বড় অংশ বইমেলা উপলক্ষ করে প্রকাশ পায়। সেখানে বর্ষীয়ান এবং জনপ্রিয় লেখকদের বই যেমন বের হয়, তেমনি নতুন লেখকদের বইও প্রচুর পরিমাণে প্রকাশিত হয়। লেখক-প্রকাশকরা ফেসবুক আর ব্লগে তাদের প্রকাশিত বইয়ের প্রচার চালান। লেখকদের শুভাকাক্সক্ষীরাও পিছিয়ে থাকেন না। ট্যাগ-শেয়ারের প্রতিযোগিতা চলে অনলাইনে। কয়েক বছর ধরেই প্রায় সবকটি টেলিভিশন চ্যানেল বইমেলাকে নিয়ে লাইভ অনুষ্ঠান করছে, যা সাহিত্যানুরাগীদের আগ্রহে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। অমর একুশে গ্রন্থমেলা লেখক-পাঠকের মেলবন্ধ হলেও তরুণদের জন্য এটি রীতিমতো উৎসবের নাম। বই কেনার পাশাপাশি প্রিয় লেখকের সঙ্গে সাক্ষাত করা, অটোগ্রাফ নিতে তাদের উৎসাহের সীমা থাকে না। বই বিক্রি, প্রদর্শনী, নজরুল মঞ্চে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে থাকে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বইমেলাভিত্তিক সম্প্রচার। বইমেলার নিত্যদিনের খবর নিয়ে বিশেষ বুলেটিন প্রকাশিত হয়। বাংলা একাডেমি চত্বরে বসে কবি-লেখকদের হাট, যেখানে প্রতিষ্ঠিত কবি-লেখকদের পাশাপাশি নব্য-তরুণ লেখকদেরও আড্ডা জমে। ভ্যালেন্টাইনস ডে বা বিশ্ব ভালবাসা দিবস এবং বসন্তের প্রথম দিবসটি বইমেলার সময়েই আসে। এ সময় বইমেলায় আনন্দের ঢেউ নামে অন্য ধারায়। তরুণ-তরুণীরা বসন্ত উদযাপনে বইমেলার সঙ্গে একাত্ম হয়ে মেতে ওঠে। মেলা হয়ে ওঠে আরও প্রাণবন্ত, সজীব ও অর্থবহ। সত্যিই এই ঝলমলে তারুণ্যই তো পাল্টে দিতে পারে সবকিছু। ইন্টারনেট, ফেসবুক আর মুঠোফোনের মায়াজালের মধ্যেও নানা রঙের আনকোরা প্রচ্ছদে ছাপা নতুন বইয়ের ম ম গন্ধে কি মাতাল হবে না তারুণ্য?
×