ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

সব জিনিসের দাম বেশি, চালের দাম কম

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সব জিনিসের দাম বেশি, চালের দাম কম

কলা বললে ভুল হবে, সঠিকভাবে বলতে গেলে এটা এখন পরিচিত বাংলা কলা বলে। বাজারে প্রচুর আমদানি। কোন কোন বাংলা কলায় কখনও কখনও বিচি পাওয়া যায়, কখনও পাওয়া যায় না। এর দাম কত? এই মুহূর্তে এর দামও বেশ উঁচুতে। শান্তিনগর বাজার থেকে বুধবার সন্ধ্যায় এক হালি (৪টা) প্রমাণ সাইজ বাংলা কলা কিনলাম ২৫ টাকা দিয়ে। ভুল বললাম? না, ভুল নয়। পঁচিশ টাকা হালিই। অন্য বাজারে কী কম? মনে হয় না। কলা কিনতে কিনতে মনে হলো, ‘কলারে কলা’- এই কলা প্রাক- স্বাধীনতা আমলে খুব কম লোকই খেত। দাম? দামের কথা না বলাই ভাল। যদি বিক্রি হতো তাহলে এক আনা (ষোলো আনায় এক টাকা মানে একশত পয়সা) হালি পাওয়া ছিল দোকানির নিতান্ত ভাগ্য। গ্রামাঞ্চলে কলা মানে হচ্ছে সবরি কলা। এই কলার দাম বেশি, কদরও বেশি। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ঐ কলার দরকার ছিল বেশি। কারণ সবরি কলা ছাড়া অন্য কলা পূজায় লাগত না। অতএব তার দামও বেশি, কদরও বেশি। আর পূজা হলে তো কথাই নেই। দুধের সেরও (কেজি) বেশি, কলার দামও বেশি। সাগর কলা ছিল, তবে তা গ্রামাঞ্চলে জনপ্রিয় ছিল না। বিক্রমপুর, পরে নরসিংদীর সাগরকলা ছিল বড়ই স্বাদের। ঐসব কলার দাম পাকিস্তান আমলে কত ছিল, এখন কত। সব ধরনের কলার দামে না গিয়ে বাংলা কলার কথাই বলি। দেখা যাচ্ছে পাকিস্তান আমলের শেষের দিকের তুলনায় এই ধরনের কলার দাম বেড়েছে এখনকার বাজারের হিসাবে প্রায় চারশত গুণ। শুধু কলা নয়, অনেক শাক-সবজির দামও বেড়েছে বেশ অনেক গুণ। চালের দাম কত বেড়েছে? শাক-সবজি, ফলমূলের দাম যেভাবে বেড়েছে সেই তুলনায় চালের দাম কিন্তু বাড়েনি। এক টাকা, এক টাকা ২৫ পয়সা সেরের চাল বড় জোর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ টাকা কেজি হয়েছে। তাই নয় কী? সেই তুলনায় শিল্পপণ্য, ভোগ্যপণ্য, জামা-কাপড়ের দাম, জুতো-মোজার দাম কত বেড়েছে, সয়াবিন তেল, ডাল, মরিচ, মসলা-পাতি, আদা-রসুন ইত্যাদির দাম কত বেড়েছে? এসব হিসাব কী আমরা রাখি? আমরা রাখি না, কেউ রাখে বলে মনে হয় না। কৃষিপণ্যের দাম, চাল-ডালের দাম, শাক-সবজির দাম, মাছ মাংসের দাম, দুধের দামের সঙ্গে শিল্পপণ্য, ভোগ্যপণ্যের দাম, শিল্পজাত দ্রব্যের দামের তুলনা দরকার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যাদের এই হিসাব করা দরকার সেই সরকার, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, নীতি-নির্ধারক, আমলা-কামলা, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিকরা ব্যস্ত অন্য আলোচনায়। শেষোক্তরা ব্যস্ত ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নিয়ে, পূর্বোক্তরা ব্যস্ত ‘জিডিপি’ শিল্পায়ন, বিনিয়োগ. অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুত, গ্যাস ও জমি নিয়ে। আমি ব্যবসায়ীদের খবর খুব গুরুত্বসহকারে পড়ি। তারা কী চায়, তাদের সমস্যা কী, কী সরকারের করণীয়- এ সম্পর্কিত খবর আমি গোগ্রাসে পড়ি। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে কৃষির চাহিদা, কৃষির সমস্যা, গ্রামের সমস্যা, কৃষিপণ্যের দাম-দরের সমস্যা ইত্যাদি সম্পর্কে বড় বেশি কিছু পাই না। তারা কী ধরে নিয়েছেন ‘জিডিপি’ শুধু শিল্পায়ন দ্বারাই হবে? কৃষিকে ঠকিয়ে, কৃষককে ঠকিয়ে দেশের টেকসই উন্নয়ন হবে? যেখানেই কোন আলোচনার সূত্রপাত সেখানেই এসে যায় ইদানীং সুদের হারের সমস্যা। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা মনে করেন ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার খুবই বেশি। এটা কমানো উচিত। এখানে দুটো জিনিস অবহেলিত তাদের বক্তব্যে। প্রথম বিদ্যমান উচ্চ সুদের হারের পরও দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার প্রায় সাত শতাংশ। এটা কী করে সম্ভব হলো? এই প্রশ্নের জবাব তারা দেন না। দ্বিতীয়ত মোট উৎপাদন খরচায় ‘সুদ খরচা’ কত শতাংশ? এর উত্তর তারা দেন না। সর্বোপরি তারা কখনও বলেন না যে, কৃষক ভাইদের অসুবিধা হচ্ছে। তাদের কৃষি ঋণ, পল্লী ঋণের ওপর সুদের হার কমানো হোক। শত হোক কৃষকরা ত্রিশ-চল্লিশ শতাংশ হারেও ঋণ নিচ্ছেন। তাদের অন্যান্য সমস্যার কথা বলব না। বললে ‘মহাভারতের’ মতো মহাকাব্য লিখতে হবে। সেদিকে যাচ্ছি না। আমার বক্তব্য হচ্ছে কৃষিতে উচ্চ সুদ থাকবে, আর শিল্প ঋণের সুদ থাকবে কম, ব্যবসায়ীরা কোন কথা বলবেন না- এ কেমন কথা। কৃষকের আয় যদি না বাড়ে, কৃষকের ক্রয়ক্ষমতা যদি না বাড়ে, কৃষিপণ্যের দাম যদি তারা না পায় তাহলে কী আমাদের প্রত্যাশিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হবে। আর হলে কী তা টেকসই হবে? নিশ্চয়ই না। ব্যবসায়ী ভাইদের বড় একটা অংশ যেভাবে তাদের সমস্যার কথা বলেন, সেইভাবে কৃষকের সমস্যার কথা ‘মিডিয়ায়’ আসে না। ব্যবসায়ীরা বলেনও না। এই যেমন কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য। বাজারে গত বুধবার দেখলাম এক কেজি চিচিঙ্গার দাম ৬০ টাকা, এক কেজি ঝিঙ্গার দামও ৬০ টাকা। এটা ঢাকার বাজারের কথা। প্রশ্ন- এই চিচিঙ্গা বা ঝিঙ্গার মূল্য ঢাকা জেলার মনোহরদি অথবা শিবপুরের কৃষকদের কত পাওয়া উচিত। পঞ্চাশ টাকা, চল্লিশ টাকা, ত্রিশ টাকা। না, তা হবার নয়। ঢাকা থেকে নরসিংদী, অথবা ঢাকা থেকে বিক্রমপুর অথবা ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ অথবা গফরগাঁও-এর দূরত্ব কত? এই দূরত্বের জন্য ট্রাক ভাড়া কত হবে? দালালের অথবা মধ্যস্বত্বভোগীর মুনাফা কত হবে? কোন হিসাব দিয়েই মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফার বিষয়টি যৌক্তিক করা সম্ভব নয়। নরসিংদী, মনোহরদি, শিবপুর, বিক্রমপুর, মানিকগঞ্জ বা গফরগাঁওয়ের কথা বাদ দিলাম ধরা যাক কাওরান বাজারের কথা। কাওরান বাজার থেকে এলিফ্যান্ট রোডের কাঁচাবাজারের দূরত্ব কত? এই দূরত্বের জন্য খুচরা দোকানদার কত টাকা বেশি মূল্য দিতে পারে? কোন হিসাবই এক্ষেত্রে মেলানো যাবে না। গ্রাম-গ্রামান্তরের মধ্যস্বত্বভোগী (মিডলম্যান) ব্যবসায়ীরা যুগ যুগ ধরে উৎপাদক কৃষককে ঠকাচ্ছে। ঠকাচ্ছে পাটের দামে, ঠকাচ্ছে টমেটো, বেগুন, মুলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সবজির মূল্যে। ঠক ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা তো কখনও কৃষকের এই বঞ্চনার কথা বলেন না। ব্যাপারটা শুধু বঞ্চনার নয়। বিষয়টা বাজারের। কৃষক যদি মৌসুমের সময় ধানের দাম না পায়, ওরা যদি মৌসুমের সময় পাটের দাম না পায় তাহলে তার ক্রয়ক্ষমতা কোত্থেকে আসবে। কৃষককে তার ফসল বিক্রি করে ধার-দেনা পরিশোধ করতে হবে। জামা-কাপড় কিনতে হবে, নুন, তেল, পিঁয়াজ, রসুন, মসলাপাতি, ডাল, চিনি ইত্যাদি ভোগ্যপণ্য কিনতে হবে। এতে জড়িত কৃষিপণ্য এবং শিল্পপণ্যের মূল্যের অনুপাত (টার্মস অব ট্রেড)। এই টার্মস অব ট্রেডটা স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বিগত ৪০-৪২ বছরে কার অনুকূলে গেছে? এ ব্যাপারে কী ব্যবসায়ীরা কথা বলতে পারতেন না? কৃষকদের তার পণ্য বিক্রি করে ছেলেমেয়ের শিক্ষা খরচ মেটাতে হয়, আজকাল তো টিউশনের খরচ দিতে হয়। চিকিৎসার খরচ আছে। ছেলেমেয়ের বিয়ে-শাদির খরচ আছে। ঋণের ওপর সুদের টাকা আছে। মূল্য তো দূরের কথা ক্রেতার অভাবে যদি টমেটো বা মুলা বা অন্য কোন পচনশীল পণ্য গ্রামের বাজারেই রেখে আসতে হয়, তাহলে শিল্পপণ্য কে কিনবে? ঢেউটিন কে কিনবে? শাড়ি, লুঙ্গি কে কিনবে? এভাবে দেখা যাচ্ছে কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্যের সঙ্গে সম্পর্কিত শিল্পপণ্যের বাজার। দুটোরই সমন্বয় দরকার। অথচ এ ব্যাপারে কোন আলোচনা সচরাচর দেখি না। কৃষকের সমস্যাটা, কৃষির সমস্যাটা যেন ‘মার্জিনাল’ একটা বিষয়, অথচ তা হতে পারে না। সরকারের নানা ক্ষেত্রে পারফরম্যান্স ঈর্ষণীয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা নয়। যে ক্ষেত্রে নয় তার আলোচনাও করতে হবে- তাই নয় কী? এই যে দিনের পর দিন কৃষি খাতে শতকরা হিসাবে বরাদ্দ হ্রাস পাচ্ছে- কী উন্নয়ন খাতে, কী রাজস্ব খাতে তার ব্যাপারে কী আমাদের চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির লোকেরা কোনদিন সোচ্চার ভূমিকা নিয়েছে? আমার তা মনে পড়ে না। কৃষিতে বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে, বেসরকারী বিনিয়োগ এই খাতে হ্রাস পাচ্ছে। এ ব্যাপারে কত সুপারিশ থাকতে পারত। চেম্বারের কত সুপারিশ দেখি, কই কৃষির ওপর জোরালো সুপারিশ কোথায়? এসব কেন হচ্ছে? শিল্পপতি, ব্যবসায়ীরা কী মনে করেন কৃষিতে বিনিয়োগ হ্রাস পেলে, কৃষিতে সরকারী বিনিয়োগ বা ব্যয় হ্রাস পেলে পরিণামে তা অর্থনীতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে? নিশ্চয় নয়। কৃষিখাত যদিও এখন মোট জিডিপিতে অবদান রাখে কম, এখন বোধ হয় বিশ শতাংশেরও কম, তবু এই খাতই কর্মসংস্থানের বড় বোঝা বহন করছে। দেশের লোকসংখ্যা ধরে নিই ১৬ কোটি। দেড় শতাংশ যদি লোকবৃদ্ধির পরিমাণ হয় তাহলে প্রতিবছর নতুন শিশু আসছে ২৪ লাখ। দিন দিন খাদ্য চাহিদা বাড়ছে। অথচ কৃষির উৎপাদনশীলতা স্থবির হয়ে পড়ছে। বোরোর ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা মাত্রাতিরিক্ত। এতে সেচের জল এবং সারের খরচ ও বিদ্যুত খরচ বাড়ছে। আমন ফসলটা অহেতুক ছোট হয়ে পড়েছে। অথচ বোরোর জন্য এখন সেচের জলের অভাব হচ্ছে। জমির অভাব দেখা দিয়েছে। অথচ শিল্পপতি শিল্প করার জন্য জমি চাইছেন। তাদের অনেকেই শত শত একর জমি কিনে ফেলে রেখেছেন। আবার সরকারের কাছে জমি বরাদ্দ চাইছেন। এদিকে কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে যেতে চাইছে নানাবিধ ক্যাশক্রপে যাতে লাভ বেশি পাওয়া যায়। অথচ এটা বেশি করা যাবে না। কারণ ধান আমাদের দরকার। কিন্তু ধানের বেশি মূল্য সঙ্গত কারণেই দিতে পারা যাবে না। কারণ চালের ওপর নির্ভরশীল ১৬ কোটি লোক। চালের দাম ৪০ টাকা কেজি, তাতেই হৈচৈ। ৫০ টাকা বা ৬০ টাকা বা ৭০ টাকা কেজি চালের দাম হলে সরকার পতনের আন্দোলন হবে। অথচ সমস্ত জিনিসের মূল্য স্তর বিবেচনায় নিলে চালের দাম তাই হওয়া উচিত। দুনিয়ার সব জিনিস যদি আমরা উচ্চমূল্যে ভোগ করতে পারি তাহলে চালের মূল্য কম হবে কেন? হবে, তার কারণ সবার জানা। কিন্তু কৃষকের তাহলে বাঁচার পথ কী? তার ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর ব্যবস্থা কী? তার দুঃখ লাঘবের পথ কী? এসব ব্যাপারে কী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা আরেকটু সোচ্চার হবেন? একটা দুইটা আলোচনা সভা করুন না তারা। লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×