ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হালকা উপস্থিতি বইয়ের সঙ্গে সুন্দর সময়

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

হালকা উপস্থিতি বইয়ের সঙ্গে সুন্দর সময়

মোরসালিন মিজান ॥ একটু শীতল দিন গেছে বলতে হবে। অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৭তম দিনে পাঠকের উপস্থিতি ছিল অপেক্ষাকৃত কম। বিকেল তিনটায় মেলার প্রবেশদ্বার খুলে দেয়া হলে প্রথম ভিড় দেখা যায় বাংলা একাডেমি অংশে। প্রবেশ পথে অনেকেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশের অনেকগুলো পথ। তাই লাইন অত দীর্ঘ হতে পারেনি। তার আগেই মেলায় প্রবেশ করা গেছে। লোক সমাগম কম হওয়ায় অনেকেই মন দিয়ে বই দেখেছেন। দেখতে পেরেছেন। ক্রেতার সংখ্যাও বাড়ছে। পরিচিত স্টলগুলোতে ভিড় ছিল দৃশ্যমান। অন্য স্টলগুলোর সামনে সাজানো বই থেকে পছন্দেরটি খুঁজে নিয়েছেন পাঠক। নারায়ণগঞ্জ থেকে মেলায় এসেছিলেন আসাদুজ্জামান। বয়সে প্রবীণ। বললেন, প্রথম দিকে একবার এসেছিলাম। তখন খুব বেশি বই আসেনি। আগে প্রকাশিত বই দিয়ে সাজানো ছিল অধিকাংশ স্টল। তাই বইয়ের তালিকা নিয়ে গিয়েছিলাম। আজ এসে দেখলাম, অনেক বই চলে এসেছে। খুব পছন্দের যেক’টা, কিনেছি। মেলা এখন শেষ পর্বে জানিয়ে তিনি বলেন, কিনতে হলে আর আসলে দেরি করা যাবে না। শুভ নামের এক তরুণের কথায় অভিযোগের সুর। বললেন, অনেক খুঁজলাম। বইয়ের মান অত ভাল না। অনেক অনুবাদ গ্রন্থ এসেছে। দু’ এক পাতা পড়ে ভাল লাগেনি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন কোন কাজ বা গবেষণা চোখে পরেনি। কাব্যগ্রন্থ যা দেখেছি, সব বিখ্যাতদের পুরনো রচনার এদিক ওদিক। অবশ্য অভিযোগ করলেও, বেশ কয়েকটি নতুন বই কিনতে দেখা যায় তাঁকে। বলেন, বই যাদের প্রিয় তারা শূন্য হাতে যেতে পারেন না। এমন কথা আশা জাগানিয়া বৈকি। বই জব্দ করা ও স্টল বন্ধের কিছু প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়েছে বুধবারের মেলায়। এদিনও পুলিশের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সিলগালা করে দেয়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘ব-দীপ’র সামনে যথারীতি বসেছিলেন দুই পুলিশ সদস্য। সাধারণ পাঠকের মতো পোশাক বা ভাব ভাষা নয়- এমন ব্যক্তিদের সন্দেহজনক উপস্থিতি বিশেষভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। এরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লান্তহীনভাবে মেলার প্রতিটি স্টল ঘুরে বেড়িয়েছেন। এদের কয়েকজনকে অনুসরণ করে দেখা গেছে, কী এক খোঁজাখুঁজিতে তারা ব্যস্ত। বই নয়, বিতর্ক খোঁজাই উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছেন একাধিক প্রকাশক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রকাশক বলেন, আমি প্রথমে সহজভাবে নিয়েছিলাম। কিন্তু ক্রমশ যা দেখছি, কিছুটা আতঙ্কিত। এদের যতটা সম্ভব নজরদারিতে আনা জরুরী বলে মন্তব্য করেন তিনি। নতুন বই ॥ বুধবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৬তম দিনে এসেছে অনেক নতুন বই। বাংলা একাডেমির তথ্য কেন্দ্রে জমা পরেছে ১৪০টি বই। নির্বাচিত বই - বাংলাদেশের লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান জন্ম ও বিবাহ ॥ লেখক ড. মোমেন চৌধুরী। গ্রন্থে লৌকিক আচার অনুষ্ঠানের সংজ্ঞা, উৎস, কারণ ও বিকাশ নির্ণয় করা হয়েছে। এসেছে প্রসূতি ও শিশু সম্পর্কিত লৌকিক আচারের মূল উদ্দেশ্যসহ বিভিন্ন দিকের বিবরণ। বিবাহের উদ্ভব, উদ্দেশ্য, সামাজিক গুরুত্বসহ তাৎপর্যপূর্ণ লৌকিক আচারের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বইটি প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য। কমরেড আলাউদ্দিন সমগ্র ॥ কমরেড আলাউদ্দিন আহমেদের নিজের এবং তার সম্পর্কিত লেখা নিয়ে এ বই। আছে মূল্যায়ন ও স্মৃতিচারণ। গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছেন আফরোজা অদিতি। প্রকাশ করেছে অ্যাডর্ন প্রকাশনা। ফাউন্টেন এ্যান্ড টোম্ব ॥ আরবী সাহিত্যের খ্যাতিমান কথাশিল্পী নাগিব মাহফুজের মূল রচনা। ১৯৮৮ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী প্রথম আরবী গল্পকার ও ঔপন্যাসিকের রচনা থেকে অনুবাদ করেছেন রাফিক হারিরি। নরসিংদীর স্থাননাম উৎস ও বৈশিষ্ট্য সন্ধান ॥ লিখেছেন মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান। বইটিতে স্থানীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, বৃক্ষলতা, দেবদেবী, কাহিনী, কিংবদন্তিসহ বহু বিচিত্র বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য। মাশরাফি ॥ মাশরাফিকে নিয়ে আলাদা কৌতূহল আছে ভক্তদের। বাংলাদেশ ক্রিকেটের উজ্জ্বল এই তারকা সাধারণ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়। তাঁর ব্যক্তিজীবনের গল্প একটু আধটু প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়। তাতে কৌতূহল বেড়ে কয়েকগুণ হয়েছে। আর সে কৌতূহল যথেষ্টই মিটিয়েছে দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের লেখা বইটি। লেখকের মতে, মাশরাফি হলেন গ্রিক ট্র্যাজেডি আর ভারতীয় রোমান্টিকতার মিশেলে এক মহাকাব্য। প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য। মেলার শুরু থেকেই বইটি বিক্রি হচ্ছে প্রচুর। ভাঙা কাঠের সেতু ॥ কাজী আলিম-উজ-জামানের কাব্যগ্রন্থ। বেশ কিছু কবিতা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। আছেন নতুন রচনাও। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে অ্যাডর্ন। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘শওকত ওসমান জন্মশতবর্ষিকী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক শান্তনু কায়সার। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কথাশিল্পী মঈনুল আহসান সাবের, কথাশিল্পী জাকির তালুকদার, লেখক নুরুল করিম নাসিম এবং জয়দুল হোসেন। সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন। লিখিত প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক বলেন, শওকত ওসমানের জন্মশতবর্ষের সূচনা হলো এ বছর, পূর্ণ হবে ২০১৭ সালে। জন্মশতবর্ষের সূচনা-স্মরণে আমরা ফিরে তাকাতে চাই এ অসামান্য কথাশিল্পীর জীবন ও কৃতির দিকে। ‘ক্রীতদাসের হাসি’, ‘জননী’-এর মতো উপন্যাস, অসাধারণ সব গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধ নিবন্ধে তিনি এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও সংগ্রাম ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুণ ও দরদী শিল্পীর দক্ষতায়। জন্মশতবর্ষউত্তর বাস্তবতায় উত্তরপ্রজন্ম তাঁর সাহিত্য ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে শওকত ওসমানকে খুঁজে পাবে। তাঁর লেখা পড়তে পড়তে নবীন পাঠকদের তাঁকেও পড়তে ইচ্ছে হবে। এই উভয় পাঠ ও যুগলবন্দী থেকে তারা আবিষ্কার করেন নতুন এক শওকত ওসমানকে। আলোচকরা বলেন, শওকত ওসমানকে পাঠের মধ্য দিয়ে বস্তুত তাঁর সময়কেই পাঠ করা হয়। কারণ তাঁর সাহিত্যকর্মে দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উদ্বাস্তু সমস্যা, দারিদ্র্য, শোষণ ইত্যাদির রেখাচিত্র ফুটে উঠেছে। মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ শওকত ওসমানের জন্য এক চিরপ্রেরণার বিষয় ছিল। তাই আমরা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি বাহান্ন ও একাত্তরের পটভূমিতে বেশ কিছু শিল্পঋদ্ধ গল্প ও উপন্যাস। তারা বলেন, জীবনকে তিনি বর্ণিল উচ্ছলতায় উদ্যাপন করেছেন এবং জীবনের মর্মকে রূপ দিয়েছেন সাহিত্যে। মানুষের গভীর বেদনালোকে তিনি আলো ফেলেছেন ব্যঙ্গের তীক্ষè কলমে। এই স্পষ্টবাক, সাহসী, মানবনিষ্ঠ এবং শক্তিমান কথাশিল্পীর জন্মশতবর্ষের সূচনায় তাঁকে স্মরণের মধ্য দিয়ে আমরা মূলত আমাদের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের বার্তা আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে চাইছি। সভাপতির বক্তব্যে সেলিনা হোসেন বলেন, শওকত ওসমান দেশভাগের শিকার হয়েছেন কিন্তু কখনো উদ্বাস্তু মানসিকতায় নয়, বরং সবসময় স্বাধীন মানুষের সত্তায় ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে উঠেছেন, সাহিত্যিক হিসেবে স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি বলেন, শওকত ওসমানের সাহিত্যকর্মকে বুঝতে হলে ব্যক্তি শওকত ওসমানকেও আমাদের অনুধাবনে রাখতে হবে। যে সময় ও সমাজের প্রেক্ষাপটে বাঙালী মুসলমানের মাঝে তিনি ও তাঁর লেখক-প্রজন্ম আধুনিকতার সূত্রপাত করেছেন তাই আমাদের পরবর্তী অগ্রগমনে পালন করেছে দিকনির্দেশকের ভূমিকা। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন আরশিনগর বাউল সংঘ। নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্য সংগঠন পরম্পরা নৃত্যালয়। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী সাইদুর রহমান বয়াতী, হাসান মাহমুদ, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, অনিমা মুক্তি গোমেজ, টুটুল বাউল, সেলিনা আলম, আবুল কালাম আজাদ, আফরোজা খান মিতা, সাজেদা ইসলাম ফাতেমী, শান্তা সরকার, মোঃ মুরাদ হোসেন এবং মোহাম্মদ মারুফ হোসেন।
×