ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ইউরোপীয় ইউনিয়নের বোধোদয়

শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদ-ের বিরোধিতা করে বিবৃতি ঠিক হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদ-ের বিরোধিতা করে বিবৃতি ঠিক হয়নি

তৌহিদুর রহমান ॥ ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদ- নিয়ে পুনর্মূল্যায়ন শুরু করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-ের ক্ষেত্রে তাদের বিবৃতি দেয়াটাও সঠিক পদক্ষেপ ছিল না বলে মনে করছে সংস্থাটি। তবে যে কোন ব্যক্তির মৃত্যুদ-ের ক্ষেত্রেই তাদের অবস্থান আগের মতোই রয়েছে। কূটনৈতিক সূত্র এসব তথ্য জানায়। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধি দল গত ১০-১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সফর করেন। প্রতিনিধি দলের নেতা জিন ল্যাম্বার্ট এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে কোন ব্যক্তির মৃত্যুদ-ের বিরোধিতা করে। তাদের সেই অবস্থান এখনও রয়েছে। তবে শুধুমাত্র জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদ-ের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিবৃতি দেয়াটা যথাযথ পদক্ষেপ ছিল না।’ সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে যুদ্ধাপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদ-ের রায় ঘোষণার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন মৃত্যুদ-ের বিরোধিতা করে বিবৃতি দেয়। সে সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বলা হয়, যে কোন ধরনের বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিরোধিতা করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। একই সঙ্গে মৃত্যুদ-ের বিধান চিরতরে বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে সংস্থাটি। মৃত্যুদ-কে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে মনে করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার মৃত্যুদ-ের সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওই বিবৃতিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে প্রচার করে জামায়াত-শিবির। সাধারণ মানুষের মাঝে জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ মৃত্যুদ-ের বিরোধিতা করছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। মৃত্যুদ- নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সব সময় বলে আসছে, তারা যে কোন ব্যক্তির মৃত্যুদ-ের বিরুদ্ধে। বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদ- বিলোপে তারা কাজ করছে। তবে শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যৃদ- দেয়া হলেই তাদের ওই বিবৃতি দেয়াটা যথাযথ পদক্ষেপ ছিল না বলে মনে করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা এ বিষয়ে নতুন করে মূল্যায়নের চেষ্টা করছে। কেননা অন্যান্য সাধারণ ব্যক্তির মৃত্যুদ-ের ক্ষেত্রে তারা কখনই বিবৃতি দেয়নি। তাই শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদ-ের ক্ষেত্রে তাদের এ বিবৃতি জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন পুনর্মূল্যায়ন করতে চাইছে। সূত্র জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট সদস্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রতিনিধি দলের চেয়ারপার্সন জিন ল্যাম্বার্টের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ঢাকা সফর করেছেন। যুদ্ধাপরাধের বিচারে মৃত্যুদ-ের বিষয়ে জিন ল্যাম্বার্টের বক্তব্যের মধ্য দিয়েই ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রেই নয়, সকল ব্যক্তির মৃত্যুদ-ের ক্ষেত্রেই তাদের অবস্থান একই ধরনের। এ নিয়ে যাতে কোন ধরনের ভুল বোঝাবুঝি না হয়, তা নিয়েও সতর্ক এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর আগে ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদুনকেও প্রশ্ন করা হয়েছিল শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদ-ের ক্ষেত্রেই কেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিবৃতি দেয়। ফলে সাধারণ মানুষ মনে করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে। এ বিষয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, সকল ব্যক্তির মৃত্যুদ-ের ক্ষেত্রেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান অভিন্ন। তবে আলোচিত ব্যক্তির মৃত্যুদ-ের ক্ষেত্রেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন মাঝে মাঝে বিবৃতি দেয়। তবে এ বিবৃতি দেয়া মানে এই নয় যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে। সূত্র জানায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, খুন, ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম চালিয়ে আসছে বাংলাদেশ। এ বিচারের ক্ষেত্রে গঠিত ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়ে বিদেশী কূটনীতিকদের ইতোমধ্যেই অবহিত করেছে সরকার। একমাত্র পাকিস্তান ছাড়া সকল দেশই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও এ বিচারের পক্ষেই অবস্থান রয়েছে। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ জার্মানিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে রাইনহোল্ড হানিং নামের ৯৩ বছর বয়সী এক ব্যক্তির বিচার শুরু হয়েছে। ঘটনার ৭১ বছর পর গত ১১ ফেব্রুয়ারি জার্মানিতে এ বিচার শুরু হয়েছে। দুুই বছর আগে জার্মানির বাডেনভুর্টেনবুর্গ রাজ্যের লুডভিগবুর্গ শহরে অবস্থিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধবিষয়ক কেন্দ্রীয় মহাফেজখানায় পাওয়া একটি দলিলের সূত্র ধরে এ বিচার শুরু হয়। জার্মানিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে এ বিচারের প্রতি নীরবে সমর্থন জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বিশ্বের মোট ৫৮টি দেশে এখনও মৃত্যুদ-ের বিধান আছে, যার অন্যতম বাংলাদেশ। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও মৃত্যুদ-ের বিধান রয়েছে। বিশ্বে মানবাধিকারের ধারক বলে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫০টি রাজ্যের মধ্যে ৩২টিতেই এখনও মৃত্যুদ-ের বিধান আছে। আর মৃত্যুদ- নেই মাত্র ১২টি রাজ্যে। প্রতিবছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫০টির মতো মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। ১৯৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃৃত্যুদ- ফিরে আসার পর, এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার লোকের মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি নাগরিক হত্যাকা-ের মতো গুরুতর অপরাধে মৃত্যুদ-ের বিধানের পক্ষে। এদিকে জানা গেছে, গত দশ বছরে মৃত্যুদ- বিলোপ করেছে এমন দেশের সংখ্যা বেড়েছে। এ সময়ে বিশ্বের মোট ৯৮টি দেশ মৃত্যুদ- দেয়ার আইন তুলে দিয়েছে। এছাড়া কিছু দেশে আইনত মৃত্যুদ- চালু থাকলেও তা কার্যকর করা হয় না। এ ধরনের দেশের সংখ্যা ৫২। মোট ১৪০টি দেশে এখন মৃত্যদ- হয় আইনত নিষিদ্ধ অথবা নিষিদ্ধ না হলেও মৃত্যুদ- আর কার্যকর করা হয় না। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদ- বিলোপে কাজ করে চলেছে। সংস্থাটি থেকে বলা হচ্ছে- ইউরোপীয় ইউনিয়ন মৃত্যুদ-ের বিরোধিতা করলেও যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তাদের কোন প্রশ্ন নেই।
×