ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদ রহমান

শিলা-মাবিয়ার স্বর্ণজয়ে ইজ্জত রক্ষা

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

শিলা-মাবিয়ার স্বর্ণজয়ে ইজ্জত রক্ষা

ক্রীড়াভুবনের নতুন সৌন্দর্য হয়ে এসেছেন সাঁতারু মাহফুজা আক্তার শিলা। যশোরের এই মেয়ে এবারের এসএ গেমসে ১০০ ও ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোক সাঁতারে পর পর দুটি স্বর্ণজয় করে গোটা দেশকে অন্যরকম এক মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। এসএ গেমসে শিলার সাফল্য আলোয় ভীষণ রকম আলোকিত হয়েছে বাংলাদেশ। গেমসের তৃতীয় দিনে ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে প্রথম স্বর্ণ জয় করেন তিনি। এর পর মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে রেকর্ড গড়ে স্বর্ণ জয় করলে শিলার নাম ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে ৯৭ সালে শ্রীলঙ্কার রহিমা মাইউমির গড় রেকর্ড চূর্ণ করেন মাহফুজা শিলা। টানা দশ বছর ধরে সাঁতারে পদক প্রাপ্তির যে বন্ধ্যত্ব চলছিল সেটাও তিনি ঘুচিয়ে দেন। সাঁতারে শিলা যে সাফল্য দেখিয়েছেন এর আগে এভাবে তা কেউ করতে পারেননি। এবারের এসএ গেমসে বাংলাদেশের যতটুকু সাফল্য সেখানে অবশ্যই বড় বেশি দীপ্যমান শিলার সাফল্য। যে সাফল্য সাঁতারকে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে বললে ভুল হবে না। সাঁতারে আত্মবিশ্বাসটাও ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। এসএ গেমস থেকে একজোড়া স্বর্ণপদক আনা শিলাকে নিয়ে এখন চারদিকে হইচইয়ের শেষ নেই। এই তরুণী এখন রীতিমতো সেলিব্রিটি হয়ে উঠেছেন। গণমাধ্যমেও যেন শিলাই এখন সবচেয়ে জনপ্রিয়। এসএ গেমসের আগে সাঁতারু মাহফুজা আক্তার শিলার নাম সাধারণ্যে সেই অর্থে কেউ জানত না। অনেকটাই অজ্ঞাত বা অজানা ছিলেন তিনি। তাঁকে নিয়ে তেমন কোন শোরগোলও ছিল না। তবে তাঁকে নিয়ে স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সেই স্বপ্নের বিস্তৃতি ছিল নীরবে-নিভৃতে। অবশ্য শিলা এসএ গেমসে নীরবে অংশ নিলেও পরিস্ফুটিত হয়েছেন সুরভি ছড়িয়ে। সত্যি কথা কি, আমাদের জন্য বিষাদময় এসএ গেমসে ক্রীড়ামোদীরা যতুটুকু আনন্দে অবগাহন করেছেন তার বেশিটুকুর উৎসই মাহফুজা আক্তার শিলা। এসএ গেমসের দ্বিতীয় দিনে দেশের পক্ষে ভারোত্তলনে প্রথম স্বর্ণ লাভ করেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। মাবিয়ার আনন্দ অশ্রু মিইয়ে যেতে না যেতেই পরের দিন পুলের জলে জ্বলে ওঠেন শিলা। সাফল্যের রঙ ছড়িয়ে তিনি কোটি কোটি ক্রীড়ামোদীকে আনন্দে ভাসিয়ে দেন। সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায় দুই নারীর তিন স্বর্ণপদকে এসএ গেমসে ইজ্জত রক্ষা হয়েছে বাংলাদেশের। শিলার যে সাফল্য যেখানে ছিল স্বপ্ন, দীর্ঘ সংগ্রাম আর একদল মানুষের পরিশ্রম। সেই ছোট্ট বয়সেই এমন একটি ঘটনার স্বপ্ন দেখেছিলেন শিলা। কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণের ক্ষেত্রে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয় তাঁকে। যশোরের নওয়াপাড়ার এই মেয়েটির জন্ম হয়েছিল একটি সাধারণ পরিবারেই। যে পরিবারে অভাব-অনটন ছিল। পরিবারের অনেক চাহিদাই যেখানে অপূর্ণ থাকত। কিন্তু সব বাধার দেয়াল পেরিয়েই বেরিয়ে আসেন শিলা। প্রতিভা থাকলে যা হয়। সবার সহযোগিতায় একেক করে বাধার দেয়াল পেরোন শিলা। ছোট্টবেলা থেকেই শিলা ছিল উচ্ছল এবং ভীষণ প্রাণবন্ত। খেলাধুলার প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল বরাবরই। তবে ’৯৯ সালে সে সবাইকে খানিকটা চমকে দেয়। ছোট্ট শিলা নওয়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী হিসেবে যশোরে আসেন শিশু একাডেমি আয়োজিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। কিন্তু এসে দেখেন এ্যাথলেটিক্সের ইভেন্ট শেষ হয়ে গেছে। অতঃপর সাঁতারেই অংশ নেয় সে এবং যথারীতি প্রথম হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। এরপর শিলা গ্রামে ফিরে যায়। স্বল্প সময়ে প্রতিভার সাক্ষর রেখে যাওয়ায় যশোরের ক্রীড়াসংগঠকদের কেউ কেউ বিষয়টি আলোচনায় তোলেন। অবশেষে তাঁকে খুঁজে নিয়ে আসেন সাঁতারের কোচ-সংগঠক আব্দুল মান্নান। যার হাতে এর আগে অনেক মেয়ে সাঁতার শিখে জাতীয় পর্যায়ে আলো ছড়িয়েছেন। শিলাও যেন ঠিক সেই হাতে পড়েন। আব্দুল মান্নান নিজ বাড়িতে রেখে তাঁকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এক সময় তাঁকে সরকারী শিশু সদনেও রেখে আসেন। ওখানে থেকেই অনুশীলন চালিয়ে যেতে থাকেন। এর মধ্যে বয়সভিত্তিক সাঁতারে শিলা একের পর এক চমক দেখাতে শুরু করেন। তবে ২০০২ সালটা তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে আসে। ওই বছর বাংলাদেশ গেমসে ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে শিলা ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। ডলি আক্তার প্রথম হন। শিলার এই ফল দেখে বিকেএসপি তাঁকে ভর্তি করতে আগ্রহী হয়। ওই বছরই বিকেএসপিতে ভর্তি হন তিনি। তাও সরাসরি ক্লাস এইটে। বিকেএসপির প্রথা অনুযায়ী ক্লাস সেভেনে ভর্তি হওয়ার কথা থাকলেও ইয়ার ড্রপে সায় না দেয়ায় তাঁকে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি করে নেয় বিকেএসপি। এরপর আর শিলার পেছনে তাকাতে হয়নি। জাতীয় পর্যায়ের লড়াইয়ে একের পর এক সাফল্য পেয়েছেন। শুধু বাকি ছিল এসএ গেমসে স্বর্ণ পাওয়া। অবশেষে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শিলা মুগ্ধময় সাফল্য এনে পুরো দেশটাকেই গৌরাবান্বিত করেছেন। শিলা বলেন, আসলে ২০১৪ সালে গোপালগঞ্জে অনুষ্ঠিত জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় আমি নৌবাহিনীর পক্ষে রেকর্ড করি। তখনই আমার মনে হয়েছে এসএ গেমসে আমার পক্ষে ভাল কিছু করা সম্ভব। এর পর তো নানা ধরনের বঞ্চনা-বৈষম্যের শিকার হলাম। উপেক্ষাও কপালে জুটল। কিন্তু কোরিয়ান কোচ পার্ক সবকিছুই যেন নতুন করে শুরু করে দিল। আমিও নতুন উদ্যোমে এবং নেশায় মত্ত হলাম। এরই ফল দু’দুটো স্বর্ণ অর্জন। এই অর্জন আমার জীবনের সেরা সাফল্য। দেশের জন্য এমন সাফল্য আনতে পেরে আমি অবশ্যই গর্বিত। একই সঙ্গে এও বলব, সাঁতারে এর আগে এ ধরনের সাফল্য কেউই দেখাতে পারেনি। অল্প বয়সে জীবনে অনেক সংগ্রাম করেছেন শিলা। সেই সংগ্রামের কথা তিনি অকপটে বলেন। কোন তথ্যই মনে হয় তিনি আড়াল করতে চান না। আর তাই হেসে বলেন, দেখুন বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম এক সময়, কেবল কিছু টাকা পাব এই আশায়। পরিবারে আর্থিক অনটন থাকায় ভাবতাম প্রতিযোগিতায় ভাল করলে কিছু টাকা পাব যা দিয়ে আমার প্রয়োজনগুলো মিটবে। এ কারণে সব প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম। ২০০৩ সালে সাঁতারে ভাল ফল করার কারণে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা পেলাম বিকেএসপি থেকে। ওই টাকা দিয়ে সে বছর আমি গ্রামের বাড়িতে একখ- জমি বন্দোবস্ত নিই। সেই জমিটি এখনও আমার কাছে আছে। এ রকম অনেক ঘটনা আছে। নিজেকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আমি সব সময় স্বচেষ্ট থেকেছি। খেলাধূলা আর লেখাপড়ার বাইরে কিছুই ভাবিনি। পড়ালেখা শেষ করে খেলতে গিয়েছি আবার খেলা শেষ হলে পড়তে গিয়েছি। এসএ গেমসের সাফল্য সম্পর্কে শিলা বলেন, এসএ গেমসে কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকভাবে বেশ চাপে ছিলাম। পুলে নেমেই আল্লাহকে স্মরণ করেছি এই বলে যে, আমি যেন গোল্ড পেতে পারি। সেই সাফল্য আমি পেয়েছি। এবার অলিম্পিকে অংশ নিয়ে দেশের জন্য কিছু করতে চাই। শিলা বলেন, অলিম্পিকে কিন্তু পদকপ্রাপ্তির কোন চাপ থাকবে না। অনেকটা মুক্তভাবেই লড়াইয়ে অংশ নিতে পারব। এখন তাই অলিম্পিকে অংশ নেয়ার স্বপ্নটাই বড় বেশি বিস্তৃত হয়েছে। অন্যান্য দেশের এ্যাথলেটরা অলিম্পিকের জন্য কয়েক বছর আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করেছে। আমাদের জন্য সে সুযোগ একেবারেই নেই। তবে যতটুকু সময় আছে সেটাকেই কাজে লাগাতে হবে। সবাই সহযোগিতা করলে আমি এগিয়ে যেতে পারব ইনশাল্লাহ এবং সেখানে ভালও করব। শিলা যে সাফল্য পেয়েছেন সেখানে অনেকেরই ভীষণ রকম অবদান রয়েছে। সেই অবদানের কথা মুক্তচিত্তে তিনি স্মরণ করেন। শিলার মতে, এলাকার অনেকেরই সাহায্য-সহযোগিতা- অনুপ্রেরণার কথা কখনই ভুলব না। রেজাউল হাসান ও আমিনুর রহমান ভাই আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। আর কোচ মান্নান স্যারের ঋণ তো কখনই শোধ করতে পারব না। এখন যে সাফল্য সেখানে নৌবাহিনীর অনেক সাপোর্ট রয়েছে। এই বাহিনীই আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এখনও এই বাহিনীর সমস্ত ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। শিলার সাফল্যের অন্যতম কারিগর কোচ আব্দুল মান্নান। যার হাত ধরেই শিলার প্রাতিযোগিতামূলক লড়াইয়ে আগমন। সেই কোচ আব্দুল মান্নান এবার এসএ গেমসে সাঁতার দলের ম্যানেজার ছিলেন। বললেন, মাহফুজা শিলা তো জাতীয় পর্যায়ে অনেক পদক জিতছে। এবার তাই ওকে বলেছিলাম বিদেশের মাটি থেকে পদক তুলে দিতে পারলেই আমাদের স্বপ্ন সফল হবে। মাহফুজা এবার সেটি পেরেছে। শিলা সম্পর্কে মূল্যায়নে তিনি বলেন, এর আগ যশোরের রেশমা পারভীন দীপু, জোবেদা খানম ইতি, রুবিনা জেসমিন পল্লবী ব্রেস্টস্ট্রোকে দ্যুতি ছড়ালেও মাহফুজা ব্যতিক্রম। ও বরাবরই ওভার টেলেন্টেড। যখন দেখলাম ওর মধ্যে প্রতিভা লুকিয়ে আছে তখন ওকে খুঁজে বের করে নিয়ে এলাম। ও আমার বাসায় আমার মেয়েদের সঙ্গে থেকেছে। রেফারি বাচ্চু ভাইয়ের বাসায় থেকেছে। আবার সরকারী শিশু সদনেও থেকেছে। আজ শিলার সাফল্য আমাদের সব প্রত্যাশা পূরণ করেছে। এসএ গেমস থেকে ফিরে এসেই শিলার ব্যস্ত সময় কাটছে। বেশিরভাগ সময়ই মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত নিজ জেলা যশোর যাওয়া হয়নি তাঁর। যশোরে মা-বাবাসহ ক্রীড়ানুরাগীরা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। যশোর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তাঁর বিশাল গণসংবর্ধনা দেয়ার উদ্যোগও গ্রহণ করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়েছে। উৎফুল্ল-প্রাণবন্ত এই সাঁতারু কদিন পরেই যশোর যাবেন। যশোরবাসী তাঁর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। সাকিব, মাশরাফির সঙ্গে বৃহত্তর এই যশোরের মেয়েটিও যে এখন অন্যরকম এক মুগ্ধময় নাম।
×