ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রোকসানা বেগম

ক্যারিবীয় ক্রিকেটে নতুন সূর্য

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ক্যারিবীয় ক্রিকেটে নতুন সূর্য

অনুর্ধ ১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ যেন শুধু জিতল না ওয়েস্ট ইন্ডিজ যুব ক্রিকেট দল, দেশটির ক্রিকেটেই যেন নতুন সূর্য উদয় হলো। এ শিরোপা দিয়েই যেন আবার নতুনভাবে পথচলা শুরু হয়ে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের। সেই ১৯৭৯ সালে, ৩৭ বছর আগে ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় ক্রিকেট দল। এরপর বিশ্বকাপে আর কোন শিরোপা জিততে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জাতীয় দলও না, যুব দলও না। এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ যুব দলের মাধ্যমে আবারও ওয়ানডে বিশ্বকাপের একটি শিরোপা ঘরে তুলল ক্যারিবীয়রা। এটাকে নতুন সূর্য উদয় না বলে আর কীই বা বলা যায়। বহুদিন পর একটা বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট জিতল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। চার বছর আগে ২০১২ সালে দলটি টি২০ বিশ্বকাপ জিতেছিল। কিন্তু সেটি ওয়ানডের আসর ছিল না। ২০০৪ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও জিতেছিল। কিন্তু সেখানে আইসিসির সব দলের অংশগ্রহণ (বাছাই কিংবা মূলপর্বে অংশ নেয়া) থাকে না। শুধু ওয়ানডের সেরা আটদল খেলার সুযোগ পায়। ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে বাছাই হোক কিংবা মূল পর্বে সবার অংশগ্রহণ থাকে। সেটি জাতীয় দল হোক কিংবা যুব দল। সেই ১৯৭৯ সালের পর আবারও শিরোপা জিতল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অর্থ সঙ্কট, ক্রিকেটারদের সঙ্গে বোর্ড কর্মকর্তাদের আর্থিক সঙ্কট, সম্পর্ক বিচ্ছেদ; এতসব সমস্যা লেগেই আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে। এর মাঝে যে শিরোপা এনে দিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যুব দল তা নতুনভাবে পথ চলার প্রেরণাই পেয়ে গেল ক্যারিবীয় ক্রিকেট। সেই ফল মিলেছেও। সিনিয়র ক্রিকেটাররা যে আর্থিক নিশ্চয়তার বিষয়টি সামনে এনে টি২০ বিশ্বকাপ খেলতে চাচ্ছিলেন না, সেই সমস্যা মিটে গেছে। সেই সমস্যা মিটেছে আবার ১৪ ফেব্রুয়ারি। যেদিন যুব বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে ৫ উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০১২ সালের টি২০ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নরা পুরো শক্তির দল নিয়েই আসছে এবারের আসরে। অথচ ক্রিকেটাররা খেলতেই চাচ্ছিলেন না। বিশ্বকাপের দলে যোগ দেয়ার জন্য ক্রিকেটারদের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চূড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড। এর মধ্যে নতুন চুক্তিতে সই না করলে টি২০ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সারির দল পাঠানো হবে বলেও বোর্ড প্রচ্ছন্ন একটা হুমকি দিয়ে রেখেছিল। সেই দলটি হতে পারত যুব দলই। কিন্তু বিবাদ আপাতত মিটে গেছে। বিশ্বকাপের দলে থাকা ১৫ জনের মধ্যে ১২ জনই চুক্তিতে সই করেছেন। তার মানে টি২০ বিশ্বকাপে পূর্ণশক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলই দেখা যাবে। বেতন ভাতা নিয়ে বোর্ডের সঙ্গে ক্যারিবীয় ক্রিকেটারদের ঝামেলা নতুন নয়। নতুন নয় বিদ্রোহও। সিরিজ বয়কটের ইতিহাসও আছে। ২০১২ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজ মাটিতে পূর্ণশক্তির দল গড়তে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০১৪ সালে ভারত সফর অসমাপ্ত রেখেই চলে এসেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। এবারও নতুন সঙ্কট দেখা দেয় বিশ্বকাপের আগ মুহূর্তে খেলোয়াড়েরা কিছু দাবি দাওয়া তুলে ধরে তা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানালে। দলের ক্রিকেটারদের দাবি ছিল, বোর্ডের প্রস্তাবিত চুক্তিতে টাকার অঙ্ক আগের বিশ্বকাপের চেয়েও কম। কিন্তু বোর্ড দাবি করেছিল, তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেশাদার ক্রিকেটারদের সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেই চুক্তিটা ঠিক করেছে। আর সামি-গেইলদের মতো শীর্ষ ক্রিকেটারদের দাবি, প্রস্তাবে সব ক্রিকেটারদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়নি। আপাতত এই সঙ্কট কেটেছে। কোন দিন কাটল? যেদিন যুব ক্রিকেটাররা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বিশ্বকাপের শিরোপা উপহার দিল। মনে করা হচ্ছে, যুবাদের শিরোপা প্রাপ্তি সিনিয়রদের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে প্রভাব ফেলেছে। এমনিতে ক্যারিবীয় ক্রিকেটে এখন দুঃসংবাদের অন্ত নেই। মাঠের পারফর্মেন্সও ভাল নয়। মাঠের বাইরেও কিছুই ঠিক চলছে না। সেখানে শিমরন হেটমায়াররা উপমহাদেশের মতো কন্ডিশনে এসে জিতলেন অনুর্ধ ১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ শিরোপা। বাংলাদেশের মাটিতে এর আগে দুটি ফাইনাল হারের যন্ত্রণা নিয়ে ফিরতে হয়েছিল ক্যারিবীয়দের। একবার জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা ১৯৯৮ সালের মিনি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। ফাইনালে হেরে যায়। আরেকবার যুবারা, ২০০৪ সালের যুব বিশ্বকাপে ফাইনালে উঠেও শিরোপা জিততে পারেনি। সেই দুটি দলের উত্তরসূরিরা এবার চ্যাম্পিয়ন হয়েই ঘরে ফিরছেন। ক্যারিবীয় যুব দলের অধিনায়ক শিমরন হেটমায়ার যেমন বললেন, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের বদল চাই। এখান থেকে হয়ত বদলে যাবে। কিছু তরুণ খেলোয়াড় আছে যারা পরের বিশ্বকাপ (যুব) খেলবে। আমাদের এই দলে স্প্রিঙ্গার-কার্টির মতো যারা ভাল খেলেছে, তাদের খেলাগুলো হয়ত তারা দেখবে। স্প্রিঙ্গার-কার্টি হয়ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলেও সুযোগ করে নেবে। তারা দলকে আরও ওপরে নিয়ে যাবে।’ ওয়েস্ট ইন্ডিজের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্য দিয়ে এবার যুব বিশ্বকাপের ১৬ দলের অবস্থানও নিশ্চিত হয়েছে। আগেই তিন থেকে ১৬ নম্বর দল পাওয়া হয়ে গিয়েছিল। বাকি ছিল ১ আর ২ নম্বর দল পাওয়া। ওয়েস্ট ইন্ডিজ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় এক নম্বর আর ভারত রানার্সআপ হওয়ায় দুই নম্বর দল হয়েছে। শ্রীলঙ্কাকে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে হারিয়ে বাংলাদেশ হয়েছে তৃতীয়। শ্রীলঙ্কা হয়েছে চতুর্থ। পাকিস্তান পঞ্চম, ইংল্যান্ড ষষ্ঠ, নামিবিয়া সপ্তম, নেপাল অষ্টম, আফগানিস্তান নবম, জিম্বাবুইয়ে দশম, দক্ষিণ আফ্রিকা ১১তম, নিউজিল্যান্ড ১২তম, আয়ারল্যান্ড ১৩তম, স্কটল্যান্ড ১৪তম, কানাডা ১৫তম ও ফিজি ১৬তম দল হয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ চমক জাগিয়েছে। যে দলটি গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়ার মতো অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেই দলটিই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। প্রথমবারের মতো যুব বিশ্বকাপ জিতে বাংলাদেশ থেকে দেশে গৌরব বয়ে নিয়ে গেছে। নকআউট পর্বে এক এক করে পাকিস্তান, বাংলাদেশের পর ভারতকে হারিয়ে শিরোপা নিজেদের করে নিয়েছে। যুব বিশ্বকাপের ফাইনাল মানেই ছিল তিনবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতের দাপট। তাদের দাপটকে চুরমার করে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেই সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাইনাল ‘কাটা’ও এবার দূর হয়েছে। এবার আর শিরোপা হাতছাড়া করল না ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০০৪ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো যুব বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়। সেই বিশ্বকাপেই প্রথমবার ফাইনালে খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে হেরে প্রথমবারের মতো শিরোপা জয়ের স্বপ্ন ধূলিস্মাত হয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের। আবার যখন দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশে যুব বিশ্বকাপ হয়, এবারও ফাইনালে খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এবার ভারতকে হারিয়ে শিরোপা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেই ফেলল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এগারোবারই বিশ্বকাপ খেলে। এর আগে ২০০৪ সালে যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দলের ক্রিকেটার দিনেশ রামদিনের নেতৃত্বে রানার্সআপ হয়, সেটিই সর্বোচ্চ অর্জন ছিল। এর বাইরে ১৯৮৮ ও ২০১০ সালে সেমিফাইনাল খেলে, তৃতীয় হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০০২ সালেও সেমিফাইনাল খেলে, চতুর্থ হয়। ২০০০ সালে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে পঞ্চম, ২০১২ ও ২০১৪ সালে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে ষষ্ঠ হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০০৬ সালেও কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে। ২০০৮ সালে নবম ও ১৯৯৮ সালে দশম হয় দলটি। এবার শিমরন হেটমায়ারের নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্যারিবীয় যুব ক্রিকেট দলের ক্রিকেটাররা দেশবাসীকে আনন্দ করার উপলক্ষ্য এনে দিল। শিরোপা জয়ের উৎসব করল যুব ক্রিকেটাররাও। তিনবারের চ্যাম্পিয়ন ভারত (২০০০, ২০০৮, ২০১২ সাল) ও অস্ট্রেলিয়া (১৯৮৮, ২০০২, ২০১০ সাল), দুইবারের চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান (২০০৪, ২০০৬ সাল), একবারের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড (১৯৯৮ সাল) ও একবারের চ্যাম্পিয়ন দক্ষিণ আফ্রিকার (২০১৪ সাল) সঙ্গে নিজেদের নাম যুক্ত করল এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজও। এ শিরোপা জয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে যেন নতুন সূর্য উদয়ও করল।
×