ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহজালালে ধরা পড়ল ৩০ কচ্ছপের চালান ;###;মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের এক কর্মকর্তাসহ গ্রেফতার ৩

সোনার চেয়েও লাভ বেশি কচ্ছপ পাচারে

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সোনার চেয়েও লাভ বেশি কচ্ছপ পাচারে

আজাদ সুলায়মান ॥ চোরাচালানে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বিরল প্রজাতির কচ্ছপ। বিলুপ্ত প্রায় এ কচ্ছপ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা কৌতূহল। কচ্ছপ কেন চোরাচালানের অন্যতম আকর্ষণীয় বস্তুতে পরিণত-সেটাই নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার শাহজালাল বিমানবন্দরে ধরা পড়ে ৩০টি কচ্ছপের একটি চালান। এ ঘটনায় মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একজন কর্মকর্তাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা এখন জেলহাজতে। উদ্ধারকৃত কচ্ছপগুলোকে সোমবার গাজীপুরের সাফারি পার্কে অবমুক্ত করা হয়। কচ্ছপের চালান এবারই নতুন নয়। বছর তিনেক আগে প্রথমবারের মতো শাহজালালে ধরা পড়ে কচ্ছপ চালান। প্রথম প্রথম সে নিয়ে তেমন হৈচৈ না হলেও এবারের চালানে একজন এয়ারলাইন্স কর্মকর্তা জড়িত হওয়ার প্রমাণ থাকায় তোলপাড় চলছে। শাহজালাল বিমানবন্দরের এই কর্মকর্তাকে জেলহাজতে প্রেরণ করার পর তাৎক্ষণিক খবর দেয়া হয়েছে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের সদর দফতরে। এ নিয়ে ওই এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষও অবাক। কচ্ছপের প্রাণীর প্রতি কেন আগ্রহ ও উদ্দীপনা সেটা এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষেরও কৌতূহলী জিজ্ঞাসা। এ সম্পর্কে জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে দেখা যায়- জব্দকৃত স্পটেড ব্ল্যাক টার্টল বা কালো চিত্রা কচ্ছপ আসলেই বিরল প্রজাতির। দুনিয়াব্যাপী রয়েছে এর-খাবারগুণ, সৌন্দর্যগুন ও ব্যবহারিকগুন। বাংলাদেশ থেকে এ প্রাণী পাচারের অন্যতম কারণ হচ্ছে এ কচ্ছপ আশপাশের ভারত পাকিস্তান ও বার্মাসহ অন্যান্য দেশে থাকলেও সেটার পরিমাণ খুবই কম। বাংলাদেশে এটি এখন বিরল প্রজাতির প্রাণী হলেও এখন তা বিলুপ্তের পথে। তারপরও এখানকার বিমানবন্দর দিয়ে এগুলো বিদেশ পাচার করাটা যত সহজ, প্রতিবেশী ভারত তো নয়ই, এমনকি পাকিস্তান ও বার্মা থেকেও ততটা সহজ নয়। বিমানবন্দর দিয়ে কেন কচ্ছপ পাচার করা হচ্ছে প্রশ্ন করা হলে এপিবিএন এএসপি আলমগীর হোসাইন শিমুল জানান-সোনা পাচারের চেয়েও লাভ বেশি কচ্ছপ পাচারে। এক কেজি সোনা চোরাচালান করলে বড়জোড় ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা লাভ হতে পারে। কিন্তু তাতে বিনিয়োগ করতে হয় ৪০ লাখের টাকারও বেশি। কিন্তু এক কেজি ওজনের একটি কচ্ছপ মাত্র এক হাজার টাকায় কিনে তা থাইল্যান্ডের মার্কেটে অনায়াসে পনেরো থেকে বিশ হাজার টাকা বিক্রি হয়। এ হারে সোনার চেয়ে কচ্ছপে লাভের পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি। এটাই সবচেয়ে বড় কারণ। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে কচ্ছপ লাগেজে ভরে যতটা সহজে বাইরে পাচার করা যায়, সে তুলনায় সোনার চালান আনা ততটাই কঠিন। বিমানবন্দরের সব গোয়েন্দাদের মূল টার্গেট থাকে সোনার চালানের প্রতি। এ ফাঁকে কচ্ছপের চালান চলে যায় অনায়াসে। এ সম্পর্কে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিদর্শক অসীম মল্লিক জনকণ্ঠকে বলেন- গত শুক্রবার রাতে শাহজালার বিমানবন্দরে যে প্রজাতির কচ্ছপ তা বিশ্বে অত্যন্ত বিরল প্রজাতির। বাংলাদেশে এখন প্রায় বিলুপ্তের পথে। এক সময় এগুলো সাতক্ষীরা যশোর খুলনা এলাকার জলাশয় নদ নদী ও পুকুরে বিপুল সমাহার ছিল। এখন সে পরিমাণ নেই। এ জাতীয় কচ্ছপ সিঙ্গাপুর, চীন, থাইল্যান্ড কোরিয়া ও জাপানে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ সব প্রাণী ভোজনীয় ও ব্যবহারিক চাহিদা রয়েছে। এ কচ্ছপ দিয়ে চীনে এক ধরনের স্যুপ তৈরি করা হয় যা খুবই মূল্যবান। এর মাংস দিয়ে চীনাদের কাছে মজাদার খাবার তৈরি করা হয়। মূল্যবান ওষুধ তৈরিতেও ব্যবহার করা হয় এ প্রাণী। কচ্ছপের খোলস দিয়ে তৈরি করা অর্নামেন্ট বক্স তৈরি করা হয় যার একেকটির দাম এক হাজার ডলার। এছাড়া দুনিয়াব্যাপী একুরিয়ামেও এ জাতীয় কচ্ছপ রাখা হয় সৌন্দর্য ছড়াতে। রাখা হয় প্রাণী জাদুঘরেও। কচ্ছপ এতসব গুণের অধিকারী বলেই বিশ্ববাজারে তার চাহিদা আকর্ষণীয়। অসীম মল্লিক বলেন- উদ্ধারকৃত কচ্ছপগুলো বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম এলাকা থেকে সংগ্রহ করা। এ চালান পাচার করা হচ্ছিল মালয়েশিয়ায়। সেখানেও এর মূল্য রয়েছে। বিত্তবানেরা বাসাবাড়ির একুরিয়ামে এগুলো পোষেণ। এটা শৌখিন মানুষের কাছে অভিজাতের প্রতীক। এ কচ্ছপগুলোর বয়স ৬০ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত। এগুলো বাচে তিনশ’ বছর পর্যন্ত। এসব কারণে একেকটি কচ্ছপের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য পনেরো থেকে বিশ হাজার টাকা। অথচ বাংলাদেশে এ প্রজাতির একটি কচ্ছপ অনেক সময় মাত্র এক হাজার টাকায়ও কেনা যায়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যে এতটা তারতম্য বলেই এখন কচ্ছপ হয়ে উঠেছে চোরাচালানের অন্যতম আকর্ষণীয় বস্তু। এদিকে বিমানবন্দরের একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়-কচ্ছপ পাচারের জন্য ৩৫ সদস্যের একটি সিন্ডিকেট শাহজালালে সক্রিয়। এরএয়ারলাইন্স, সিভিল এভিয়েশান ও বন্যপ্রাণী পাচারকারী রয়েছে। এ চক্রের তিনজনকে গত শনিবার আটকের পর জেল জরিমানা করা হয়। উল্লেখ্য, গত শুক্রবার রাতে শাহজালাল বিমানবন্দরে ৩০টি কচ্ছপ আটক করে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। বিমানবন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শরীফ মোঃ ফরহাদ হোসেন তাদের জেল জরিমানা করেন। দ-িতরা হলেন- মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের সহকারী স্টেশন ম্যানেজার সামিউর রহমান (৩৫), একই বিমান সংস্থার প্যাসেঞ্জার সার্ভিস স্পেশালিস্ট জুয়েল আহমেদ (২৯) ও ব্যাগেজ হ্যান্ডেলার মিজানুর রহমান (৩০)। পলাতক থাকায় হাসান পারভেজের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সিভিল এভিয়েশনের কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়। উদ্ধার হওয়া কচ্ছপগুলো শনিবার বন বিভাগের পরিদর্শক অসীম মল্লিকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে কচ্ছপগুলো গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে অবমুক্ত করা হয়েছে।
×