ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মাতৃভাষার মাধ্যমে জীবন ও জগত সম্পর্কে যে গভীর বোধ জাগ্রত হয় তা আর বিদেশী কোন ভাষার মাধ্যমে হয় না। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ‘অমর একুশের ষাট বছর’ শিরোনামে বাংলাভাষার ওপর একটি রচনা লিখেছিলেন। ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি ওই স্মারকপত্র প্রকাশ করে। সেখানে মাতৃভাষার সর্বগামিতার প্রশ্নে তিনি অস্ট্রেলিয়ার কিম্বার্লি ল্যাঙ্গুয়েজ রিসোর্স সেন্টারের কর্মকর্তা জুন অস্কারের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আপনি নিজের অনুভূতি যেভাবে নিজের ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন, সেভাবে ইংরেজীতে প্রকাশ করতে পারবেন না। আপনি অনুভব করতে এবং বুঝতে পারছেন কী বলা হচ্ছে, কিন্তু ঠিক তা মাথায় ঢুকছে না।’ একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটি গভীর বোধ বাড়ানোর জন্য মাতৃভাষার সহায়তার প্রয়োজনীয়তার ওপর একটি চমৎকার ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। রবীন্দ্রনাথ জগদানন্দ রায়কে লেখা একটি চিঠিতে বলেছেন, ‘ছেলেরা মাতৃভাষা একটু একটু করে বাঁধ বেঁধে বেঁধে পাকা করে শেখে না। তারা যা জেনেছে এবং যা জানে না সবই তাদের ওপর অবিশ্রাম বর্ষণ হতে থাকে- হতে হতে কখন যে তাদের শিক্ষা সম্পন্ন হয়ে ওঠে তা টেরই পাওয়া যায় না।’ মাতৃভাষার এই ‘অবিশ্রাম বর্ষণের’ কারণে ব্যক্তিগত চৈতন্য, বোধ, জাতিগত শিক্ষা, বোধগম্যসহ জাতীয় ধীশক্তি বাড়ে। সহজভাবে জিনিসটি বোঝানো যায় শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত করাচিতে ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে যখন যুক্ত করার কথা বলেছিলেন, তখন তার যুক্তি ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক (তখন ছয় কোটি ৯০ লাখ লোকের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল চার কোটি ৪০ লাখ) যারা বাংলায় কথা বলে। এত সংখ্যক লোকের জীবনবোধ গড়ে উঠবে বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষা ব্যবহার করার মাধ্যমে। পাকিস্তান আন্দোলন যখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকাপোক্ত হয়ে উঠতে লাগল, তখন বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালী বুদ্ধিজীবী মহলে সংশয় বাড়তে থাকে। ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পাওয়ার এক বছরের মধ্যে যখন ১৯৪৮ বা ’৪৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ও ১ জানুয়ারি কার্জন হলে প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর ভাষণে বললেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ রেখে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।’ ড. শহীদুল্লাহর বক্তব্যের ভিত্তি ছিল বাংলা ভাষা, তথা যে কোন ভাষার, নিহিত চরিত্র হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলমান উভয়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে জীবনবোধ, জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করবে এটা হবে মূল লক্ষ্য। সেখানে বাংলাকে গর্হিত করে রাখার প্রশ্নই ওঠে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে এর আন্তর্জাতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি হিসেবে এক আদেশে তিনি বলেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজী ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই, দেশের প্রতি তার ভালবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’ বঙ্গবন্ধুর এ ক্ষোভযুক্ত বাণী যে প্রেক্ষাপটে উচ্চারিত হয়েছিল, সে প্রেক্ষাপট যে এখনও খুব বদলেছে তা নয়। যা বদলাচ্ছে সেটা যে বাংলার প্রতি প্রীতি বা বাংলায় দক্ষতা বেড়ে গেছে বলে বদলাচ্ছে তা নয়, বেড়েছে ইংরেজীর প্রতি প্রীতি বজায় থেকে এবং নানা কারণে ইংরেজীতে দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে। অর্থাৎ ওই চেতনা এখনও কাজ করছে যে বাংলা ভাষার মাধ্যমে বুঝি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বুদ্ধির মুক্তি ও জ্ঞানের পথে দেশের কিছু মানুষকে নয়, সব মানুষকে সহযাত্রী করতে চাইলে বাংলা ভাষার ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই।
×