ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাইফুজ্জামান

রফিক আজাদের কবিতা বিপন্ন বিষণ্ণতা

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

রফিক আজাদের কবিতা বিপন্ন বিষণ্ণতা

বাংলা কবিতার পালাবদলে ষাট দশকের কবিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিষয় বৈচিত্র্য, লৈখিক রীতি ও উপস্থাপনে নতুন নীরিক্ষা নিয়ে এ সময়ের প্রধান কবি রফিক আজাদ তেজদীপ্ত মহিমায় আবির্ভূত হন। রোমান্টিক মানস প্রবণতা, দ্রোহ ও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য তার কবিতাকে আকীর্ণ করে আছে। সূচনা পর্বের কবিতায় আত্মমগ্নতা তাকে অধিকার করলেও পরবর্তীতে তিনি সমাজ, স্বদেশ ও সমকাল লগ্ন হয়ে উঠেন। ব্যক্তি অনুভূতির প্রাবল্যের সুর অনুরণিত তার কবিতা প্রতœনৃগোষ্ঠীর জীবন ভাবনাকে তুলে ধরে। ব্যক্তির পরিবর্তন রফিক আজাদের কবিতার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। তিনি আবিষ্কার করেন ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থা মানুষের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান তৈরি করে। মানুষের একাকীত্ব, দুঃখকষ্ট, প্রেম-বিরহ তার কবিতারয় একীভূত হয়। মধ্যবিত্তের হাহাকার, প্রেম, প্রকৃতি বন্দনা, নষ্টালজিয়া, পুরুষের প্রধান আরাধ্য নারীর সান্নিধ্য পিপাসা, মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ও নিঃসঙ্গতা রফিক আজাদের কবিতার প্রধান উপাদান। রাজনীতির কুটিল চক্রান্ত, স্বৈরাচার এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী বিরূপ সমাজচিত্রের প্রতিচিত্র তার কবিতায় প্রতিবিম্বিত। পাশাপাশি যুক্ত থেকেছে অভিমান, দেশাত্মবোধ, স্মৃতি ও বিস্মৃতির বিবিধ অনুষঙ্গ। মানবতা ও সত্যানুসন্ধানে রফিক আজাদ সংলগ্ন হয়েছেন। মানবমন বিচিত্র গতিসম্পন্ন। সহজাত প্রবণতা ভালবাসায় আপ্লুত হওয়া। স্নেহসুধা, সান্নিধ্য আকাক্সক্ষার মিলিত ধারা পূর্ণতা পায় ব্যাকুলতা, প্রতীক্ষা প্রাপ্তির মাঝে। রফিক আজাদের কবিতায় প্রেম, শাশ^ত ও অমলিন। কাতরতা ও আত্মমুগ্ধতা ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে : খ-িত ব্রিজের মতো নত মুখে তোমার প্রতিই নীরবে দাঁড়িয়ে আছি: আমার অন্ধতা ছাড়া আর কিছুই পারিনি দিতে ভীষণ তোমার প্রয়োজনে; উপেক্ষা কোরনা তবু, রানী- তোমার অনুপস্থিতি কতো বেদনাময়- বড়ো বেশি মারাত্মক বাজে বুকের ভিতরে কী যে ক্রন্দনের মত্ত কলরোলে। ... অবিশ^াস্য উষ্ণতায়, চাপে দ্রুত গলে যেতে থাকে ঘড়ির ডায়াল আর তোমার নিটোল অবয়ব। তুমি সেই লোকশ্রুত পুরাতন অসম্ভব পাখি সোনালি নিবিড় ডানা ঝাপটালে ঝরে পড়ে যাব চতুর্দিকে আনন্দ, টাকার থলি, ভীষণ সৌরভ। রোমশ বালক বেলা খেলা করে রৌদ্রগন্ধ তটে। অস্তিত্বের দূরতম দ্বীপে এই দুঃসহ নির্জনে কেবল তোমার জন্যে বসে আছি উন্মুখ আগ্রহে সুন্দর সাম্পান চড়ে মাধবী এসেই বলে ‘যাই’। (মাধবী এসে বলে: অসম্ভবের পায়ে) কবি মাত্রই স্বপ্নপ্রবণ। সমাজ, সংসার, রাজনৈতিক ঘূর্ণি, মানুষের স্বার্থবাদী চিন্তা ও দুঃশাসকের দ- স্বপ্নহীন তাকে একাকিত্বে বিদ্ধ করে। রফিক আজাদ মাঝে মধ্যে হাতাশার ঘেরা টোপে আটকে যান। জীবন বিনাশী মৃত্যু ভাবনা, অসহায় সমর্পণ তাকে আলোড়িত করে। অসহায় নিষ্পেষণ আর প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার চিত্র প্রত্যক্ষ করে তিনি যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়ে উচ্চারণ করেন : এটম বোমার থেকে দু’বছর বড় এই আমি ধ্বংস ও শান্তির মধ্যে মেরুদূর প্রভেদ মানি না। ক্ষীয়মান মূল্যবোধে, সভ্যতার সমূহ সঙ্কটে আমি কি উদ্বিগ্ন খুব? উদ্বিগ্নতা আমাকে সাজে কি? রাষ্ট্র, রাষ্ট্রনীতি, নেতা, নানাবিধ আইন কানুন নিয়ন্ত্রিত করে যাচ্ছে যথারীতি প্রকাশ্য জীবন ... স্থান কাল পরিপাশের্^ নিজ হাতে চাষাবাদ করি সামান্য আপন জমি, বর্গা জমি চষি না কখনো। বিস্তীর্ণ প্রেইরী নয়-আপনার সীমিত সবুজে পরম নিশ্চিন্তে চরে নীল গাই, যুথবন্ধ মেঘ; নিরীহ হরিণ গুচ্ছ, নৃত্যপর জেব্রা ও জিরাফ। (অন্তরঙ্গে সবুজ সংসার; সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে) স্বাধীনতা-পরবর্তী বহুমাত্রিক ঘটনাবলী কবির হৃদয়কে রক্তাক্ত করে। মুক্তিযোদ্ধা কবি ক্ষোভে-বিক্ষোভে জ্বলে উঠেন। প্রেমিক কবি, দেশপ্রেমিক যোদ্ধা মানুষের লোভ, হিংসা ও ক্ষমতার দম্ভে আতঙ্কিত হয়ে বলেন; ভীষণ ক্ষুধার্ত আছি: উদরে শারীরবৃত্ত ব্যেপে অনুভূত হতে থাকে প্রতিপলে-সর্বগ্রাসী ক্ষুধা।/... আমার সামান্য দাবি: পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর/এই চাওয়া সরাসরি ঠা-া বা গরম/সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চালে হলে ক্ষতি নেই। মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাই/ দুবেলা দুমুঠো হলে ছেড়ে দেব অন্য সব দাবি/... যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবি/তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কা- ঘটে যাবে/ ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইস্টানিষ্ট, আইন কানুন/সম্মুখে যা কিছু পাব খেয়ে যাব অবলীলাক্রমে: / থাকবে না কিছু বাকি/ চলে যাবে হা ভাতের গ্রাসে/ (ভাত দে হারাম জাদা : সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে অন্ধকার, দুঃশাসন আর সামাজিক রীতিনীতিতে বীতশ্রদ্ধ রফিক আজাদ নিজের মধ্যে দুর্ভেদ্য দেয়াল রচনা করেছেন। আত্মগত বেদনাবোধ ও হতাশায় নিমগ্ন থেকেছেন। সবুজ বদ্বীপে প্রকৃতি, ঘাস, ফুল, নদী, নারী আর কবিতা লেখার বিশ^স্ত কলমের কাছে নতজানু হয়ে তুলে এনেছেন অন্তর্গত বোধকে। শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়াতে হয় মানুষকে। দুঃখের উল্টো পিঠে হাত ঢেকে তুলে ধরতে হয় মর্যাদা। আনন্দ ধ্বনি সুখের নিরন্তর বহমানতা তার আরাধ্য। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে উদিত বাংলাদেশকে যারা শৃঙ্খলিত করেছে তাদের বিরুদ্ধে কবি রফিক আজাদের কবিতা হয়ে ওঠে প্রতিবাদের প্রতীক। উটকো ভোদরের যুগে মানুষ প্রবেশ করেছে এমন ভাবনাও তাকে সজল বিধূর করে: মসৃণ বাতাসে আজ প্রতি ছাদে ওড়ে নারী স্বাধীনতার পতাকা পতাকার ওড়াউড়ি দেখে জানালায়-জানালায় আমাদের প্রিয় শাড়িগুলি দৃঢ় দাঁড়িয়ে রয়েছে। .... হতশ্রী বাংলাদেশে শাড়িদের স্বাধীনতা চাই সেøাগানো মুখর হোক ব্যস্ত রাস্তাগুলো ... মানুষ গিয়েছে খুব ন্যুব্জ হয়ে, ভাঙা চোরা নিঃসঙ্গ মানুষ আজ আর স্বাধীনতা শব্দটির মতো ভারী দুর্বহ পাথর (প্রিয় শাড়িগুলি: সশ্রস্ত্র সুন্দর) রফিক আজাদের কবিতা বিচিত্রমুখী। আশা-নিরাশার ভেলায় চড়ে তিনি হেঁটেছেন অনেকটা পথ। ব্যক্তির জীবনে রাজনীতির প্রভাব নেতিবাচক। মানুষের বদলে যাওয়া, আদর্শচ্যুত হওয়া, নীতি-নৈতিকতা বিমুখতা তার কবি চিত্তে ক্ষরিত হয়েছে। দমন-পীড়ন, মধ্যবিত্তের বিষন্নতা, নিসঙ্গ একাকীত্বে লীন হয়ে রফিক আজাদ হৃদয়স্পশী পঙ্ক্তিমালা রচনা করেছেন। ক্ষুধাপীড়িত মানুষ, লঙ্ঘিত মানবাধিকার ও সমাজ মনস্ক ভাবনার অগ্নিস্ফুরণ তার কবিতার আন্তর্জানালা খুলে দিয়েছে। রফিক আজাদ রাত্রি ও অন্ধকারকে গভীর মমতায় অবগাহিত করে স্রোতস্বিনী নদীতটে দাঁড়াবার ব্যাকুলতায় অধীর: সবার জীবনে আছে ভোরবেলা, আমারতো নেই, আমার অনন্ত রাত্রি, আমার জীবনে কোন ভোর নেই-শুধু রাত্রি রাত্রি-আমার বউয়ের নাম রাত্রি। ... ভোর কাকে বলে তা জানি না; আমি অন্ধকার প্রিয় আমার রয়েছে রাত অন্ধকারে নিমজ্জিত রাত- তাল তাল অন্ধকার বুকে করে আমি অন্ধকারে অনন্তবাহিনী ঐ নদী তীরে একটু দাঁড়াবো (আমার অনন্ত রাত্রি: ক্ষমা করো বহমান হে উদার অমেয় বাতাস) রফিক আজাদ ক্রমশ উদ্দীপ্ত হয়েছেন। দেশ মানুষ, সমাজ তাকে ক্ষতবিক্ষত করে। দেশের অভ্যন্তরে নেমে আসা অন্ধকারের মধ্যে থেকে আলোতে প্রত্যাবর্তন করতে প্রত্যক্ষ করেন মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, জাতীয় মূলনীতির পাল্টে যাওয়া। তিনি দ্বিধাহীন কণ্ঠে কবুল করেন ‘চুরি হয়ে গেছে আমাদের স্বপ্ন’ (মৌলবীর মন ভাল নেই) দৈশিক বিষন্ন বর্বরতা আর বিপন্নতা মধ্যবিত্ত জীবনকে আমূল বদলে দেয়। ক্লান্ত বিপর্যস্ত মানুষ দুঃস্বপ্নে প্রতিনিয়ত তাড়িত। বন্দী জীবন, নিয়তিবিদ্ধ সময়, রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা রাজনীতিকের ভ-ামি পূর্ণ স্বদেশে এক ধ্বংসের সৃষ্টি করে। রফিক আজাদ দুঃসময়কে অতিক্রম করতে চান। চুনিয়ার সবুজ, শান্ত প্রান্তর, সোমেশ^রী নদী প্রান্তে নৃগোষ্ঠীর সহজ সরল মানুষরা তাকে জীবনের কাছে ফিরিয়ে আনে। রফিক আজাদ বলেন: পর্ব ১. বিরিশিরি আজকাল অনেকেই যায় আমারতো সময় হয় না যে যাই তোমার আমার পাগলের খবর বলোতো সে কি ভালো আছে খুব স্বেচ্ছা নির্বাসনে। ... ৪. অভিমান আমার ও রয়েছে ব্যাধি আছে বাড়ছে শরীরে চিকিৎসা করব না কোন অভিযোগ নেই, নেই কোন খেদ নেই নেই অভিযোগ অভিমান নীরবেই ধরে যাব তুচ্ছ বন ফুল (হৃদয়ের কী দোষ) রফিক আজাদ ঐতিহ্য সচেতন। মুক্তি অন্বেষা তার কবিতা অন্যতম ভিত্তি। মার্কেজ, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, ববি স্যান্ডজ, চর্যাপদ, লালনের দর্শন তিনি কবিতায় আত্মস্থ করেছেন। বাঙালীর সংগ্রাম, জীবনধারা, প্রবহমান সংস্কৃতি ও যাপিত জীবন তাঁর কবিতায় উদ্ভাসিত হয়। রফিক আজাদ স্বাভাবিকভাবে একাত্ম: অন্যায়কে খুঁজতে আমার কিছু কবিতা ববি স্যান্ডসের মতো আমরণ অনশন করে যাচ্ছে- আমার কিছু কবিতা গ্রাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাসের উপাদান হওয়ার জন্যে দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছে গেছে খুব ভোরে; (হারানো কবিতাগুলো আমার: এক জীবনে) রফিক আজাদ পুরান থেকে এনেছে কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন। সমকালীন যুগযন্ত্রণা, ব্যক্তিগত বোধ, স্বদেশ মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও আত্মনুভূতি স্নাত তার কবিতা বিপন্ন বিষণœতাকে ধারণ করে। কৃষিজীবী মানুষের প্রতিনিধি কবি রফিক আজাদ নতুন শস্য উৎপাদনে নিমগ্ন হয়ে প্রতিনিয়ত আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠেছেন। বিষয় বৈভব, উপস্থাপনা ভঙ্গি ও বহুমাত্রিক বক্তব্য রীতি তার কবিতা পুষ্ট করে তুলেছে। ঐতিহ্য চেতনার সঙ্গে তার আন্তর্জাতিক মেলবন্ধন রূপায়ন কবিতাকে শিল্পনন্দন করে তোলে। রফিক আজাদ কবিতার মহান কারিগর।
×