ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এক্স-রে, সোনোগ্রাফির দিন ফুরাল?

প্রকাশিত: ০৭:১১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

এক্স-রে, সোনোগ্রাফির দিন ফুরাল?

‘সর্বনাশী আলো, কেন তুই সর্বগ্রাসী হলি?’ কবি আল মাহমুদের এই আক্ষেপ-যন্ত্রণা কি বাড়ত আরও, যদি জানতেন, আলোও পারে ‘মর্মভেদী’ হতে! আলোর এই ‘মর্ম কথা’ আমাদের জানা ছিল না বছর দশেক আগেও। জানলে কি আর এত খাতির-আদর জুটত রঞ্জন রশ্মির (এক্স-রে) কপালে? আলট্রা সোনোগ্রাফির জন্য পড়ে যেত এত হুড়োহুড়ি? আলো যে শুধুই অত জোরে ছোটে, তা-ই নয়, কোষ, কলা ফুঁড়ে-ঢুঁড়ে তা অনায়াসে ঢুকেও পড়তে পারে আমাদের শরীরে। এমনটাই জানাচ্ছে সাম্প্রতিক এক গবেষণার ফলাফল। তা হলে কি এক্স-রে, আলট্রা সোনোগ্রাফিকে পুরোপুরি ‘গুড বাই’ জানানোর দিন এসে গেল? ‘নেচার’ জার্নালে যাঁর গবেষণাপত্রটি প্রকাশের পর রীতিমতো হইচই শুরু হয়ে গিয়েছে বিশ্বজুড়ে, মার্কিন মুলুকের মিসৌরির সেন্ট লুই শহরে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির সেই বায়ো-মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার লি হাং ওয়াং তাঁর নিবন্ধের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘‘আমরা সব সময় যে আলো খালি চোখে দেখি (ঙঢ়ঃরপধষ খরমযঃ), তাকে আমাদের শরীরের দশ সেন্টিমিটার ভেতরে ঢোকানোটা দশ বছর আগেও ছিল রীতিমতো দুরূহ ব্যাপার। আর সেই শরীরে ঢোকা আলো দিয়ে ভেতরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, কোষ ও কলার ঝকঝকে ছবি (ঐরময জবংড়ষঁঃরড়হ ওসধমরহম) তোলাটা ছিল একেবারেই কাল্পনিক। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, দৃশ্যমান আলো দিয়েই এবার আমরা শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ঝকঝকে ছবি তুলতে পারব। এক্স-রে, আলট্রা সোনোগ্রাফির আর দরকার হবে না।” ‘মর্মভেদী’ আলোর কথা প্রথম জানা গিয়েছিল ২০০৭ সালে। নেদারল্যান্ডসের এনশেদে তোয়েন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ এ্যালার্ড মস্কি প্রথম দেখেছিলেন, সাদা রং করা পুরু কাচের স্কাইড ফুঁড়ে স্কাইডের অন্য প্রান্তে অনায়াসেই চলে যেতে পারছে আমাদের চোখে দেখা আলো। ওই স্পাইডে কোন ফুটো না থাকা সত্ত্বেও। ওই বছরেই ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বায়ো-ইঞ্জিনিয়ার শাং হুই ইয়াং মুরগির বুক ফুঁড়ে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন আমাদের চোখে দেখা আলো। আর এখন তো ইঁদুরের কানের কোষ, কলা ফুঁড়েও ঢুকে পড়তে পারছে দৃশ্যমান আলো। তুলছে পারছে ঝকঝকে ছবি। বিজ্ঞানীদের আশা, দৃশ্যমান আলো এবার আমাদের শরীরের অন্তরে-অন্দরে আরও বেশি করে ঢুকে পড়তে পারবে, খুব শীঘ্রই। সে দিন আর বেশি দূরে নেই। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির বায়ো-মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার লি হাং ওয়াঙের সহযোগী বাঙালী গবেষক তীর্থঙ্কর বসু চৌধুরী ই-মেলে জানিয়েছেন, ‘‘আমাদের এই আটপৌরে আলো দিয়েই এবার মস্তিষ্কে ধমনীর অবাঞ্ছিত ফুলে-ফেঁপে ওঠার মতো জটিল অসুখ (অহবঁৎড়ংুস) সারিয়ে ফেলা যাবে। আর অস্ত্রোপচার করতে হবে না। কোষ, কলায় ঢুকে শরীরে জন্মানো টিউমারও চুপসে দিতে পারবে আটপৌরে আলোই।’’ তীর্থঙ্কর জানাচ্ছেন, ‘‘ দৃশ্যমান আলো দিয়ে তোলা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, কোষ ও কলার ছবি এক্স-রে ও আলট্রা সাউন্ডের চেয়ে অনেক বেশি ঝকঝকে হবে। কারণ, দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে থাকা ফোটন কণাগুলো শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও কোষ-কলায় থাকা জৈব অণুগুলোর (ঙৎমধহরপ গড়ষবপঁষবং) সঙ্গে খুব ভালভাবে বিক্রিয়া করতে পারে। তার ফলে, ওই জৈব অণুগুলো থেকে প্রতিফলিত দৃশ্যমান আলো শুধুই যে আরও বেশি ঝকঝকে ছবি তুলতে পারবে, তা-ই নয়, কোষ ও কলার অন্তরে-অন্দরে জৈব অণুগুলোর রাসায়নিক পরিবর্তন, কোষ-কলার গঠন ও রূপান্তর, রক্তে গ্লুকোজ ও অক্সিজেনের মাত্রা সম্পর্কেও অনেক বেশি নির্ভুলভাবে তথ্য তুলে আনতে পারবে। ফলে, দৃশ্যমান আলো দিয়ে তোলা ছবিগুলো থেকে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, কোষ-কলার গঠন, রূপান্তর ও বিবর্তন সম্পর্কে অনেক বেশি তথ্য জানা যাবে। যা এক্স-রে বা আলট্রা সোনোগ্রাফি দিয়ে করা সম্ভব নয়। আটপৌরে আলো দিয়ে শরীরের কোষ, কলা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নিখুঁত, ঝকঝকে ছবি তোলার ক্ষেত্রেও রয়েছে কয়েকটি অসুবিধা। তীর্থঙ্কর জানাচ্ছেন, ‘‘কোষ-কলা ফুঁড়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ার পর শরীরের অন্দরে জৈব অণুগুলোর সঙ্গে আটপৌরে আলো বিক্রিয়া করে বলে, সেই সব কোষ ও কলা থেকে ফিরে আসা আলো (প্রতিফলিত) একমুখী না হয়ে ছড়িয়ে পড়ে নানা দিকে। একে বলে, বিচ্ছুরণ বা, ‘ঝপধঃঃবৎরহম’। ফলে, তার ঔজ্জ্বল্য (ইৎরমযঃহবংং) অনেকটাই কমে যায়। তাতে ছবির মান খারাপ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এক্স-রে, আলট্রা সোনোগ্রাফির ক্ষেত্রে সেটা হয় না। কারণ, ওই দুটি তরঙ্গই শরীরের অন্দরে জৈব অণুগুলোর সঙ্গে কোন বিক্রিয়া করতে পারে না। আবার কখনও কোন কোন জৈব অণু পুরোপুরি শুষেও নিতে পারে দৃশ্যমান আলোকে। একে বলে, ‘অনংড়ৎঢ়ঃরড়হ’। সে ক্ষেত্রে শরীরের ভেতরে ঢুকে আলোক কণা ফোটন যে সব তথ্য জোগাড় করেছে, তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এক্স-রে, আলট্রা সাউন্ডের ক্ষেত্রে ওই সব সমস্যা নেই।’’ সুজয় চক্রবর্তী সূত্র : আনন্দবাজার
×