ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ খুব রঙিন সময়। কেবলই রং ছড়াচ্ছে। পোশাকে রং। মনেও। ঢাকার চারপাশটা লক্ষ্য করলে টের পাওয়া যায় বৈকি! কারণটি আর কিছু নয়, ঋতুরাজ বসন্ত আসছে! একেবারে জাগ্রত দ্বারে। শনিবার ১ ফাল্গুন। এদিন বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকা উৎসবে মাতবে। বসন্ত বরণ উৎসব। প্রস্তুতি চলছিল। এরই মাঝে উৎসব অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। আর যেসব আয়োজন এরই মাঝে পুরনো হয়ে গিয়েছিল, সেগুলোতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে বসন্ত। তবে বইমেলার আয়োজনটি সব সময়ই বিশেষ। এর সঙ্গে বসন্ত যোগ হলে আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। গত কয়েক দিনের মেলা ঘুরে বসন্তের আগমনী বার্তা টের পাওয়া গেছে। অমর একুশে গ্রন্থ মেলার ১১তম দিনে বৃহস্পতিবারও ছিল অভিন্ন চিত্র। বসন্তের ঢেউ যেন আছড়ে পড়তে শুরু করেছে একাডেমি চত্বর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বই আর বসন্ত। একসূত্রে গেঁথে নিলে শহরের আর কোন গল্প অবশিষ্ট থাকে না। [RTF bookmark start: }page1[RTF bookmark end: }page1 বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গ্রাফিক নভেল সিরিজ বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। এই মহাজীবন পাঠ করে শেষ করা মুশকিল। এর পরও তাঁকে আবিষ্কারের যত চেষ্টা, অব্যাহত রয়েছে। নানাভাবে ভাষায় তুলে ধরা হচ্ছে জাতির জনককে। বাচ্চাদের উপযোগী প্রকাশনাও কম নয়। তবে এ ক্ষেত্রে বিশেষ সংযোজন গ্রাফিক নভেল সিরিজ। ‘মুজিব’ শিরোনামের সিরিজটিতে ছোটদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং বোধগম্য করে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করা হচ্ছে। খেলাচ্ছলে কার্টুন দেখার আনন্দে বিপুল ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হয়ে যাচ্ছে শিশুরা। বুদ্ধিদীপ্ত উদ্যোগটি সিআরআই প্রকাশনার। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থ অবলম্বনে এই সিরিজ প্রকাশনার উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রথম খ-টি আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৩তম দিবসে শনিবার আসছে সিরিজের দ্বিতীয় গ্রন্থ। নতুন খ-ে অবিভক্ত ভারতের প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মুজিবের ঘটনাবহুল পরিচয় পর্ব। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো বিশাল মাপের নেতাদের শৈশবেই আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন মুজিব। সেই ইতিহাসটি কার্টুন এঁকে দেখানো হয়েছে। একইভাবে স্থানীয়ভাবে নিজ উদ্যোগে মুসলিম লীগ গঠনের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরা হয়েছে। ফুটবলার শেখ মুজিবকে দেখেও মজা পাবে বাচ্চারা। এই খেলায় নেতা ছিলেন দারুণ সফল। সমাজের প্রতি মুজিবের যে দায়বোধ, সেটিও ফুটে ওঠে চমৎকারভাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময় তৎকালীন ভারতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। তখন একজন সমাজকর্মীর ভূমিকায় পাওয়া যায় নেতাকে। এভাবে নানা ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে কিশোর মুজিবের জীবনের খুঁঁটিনাটি তুলে ধরা হয়েছে। সবই কার্টুন এঁকে। সবই ছোট ছোট কথায়। প্রথম পর্বটি এখন মেলায় পাওয়া যাচ্ছে। বাংলা একাডেমি চত্বরে সিআরআই’র স্টলে সাজানো আছে প্রথম খ-। হাতে নিয়ে সত্যি মুগ্ধ হতে হয়। বইতে মুজিবের ছেলেবেলা। দুরন্ত শেখ মুজিব। লেখাপড়া চলছে। সেইসঙ্গে খেলাধুলো। দুষ্টুমি। ন্যায় অন্যায়ের বোধ ছিল টনটনে। বহু মানুষের বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। এমন নানা ঘটনার বর্ণনা এসেছে বইয়ে। পিতা পুত্রের মধ্যকার সম্পর্কটিকেও ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপিত হয়েছে। জানা যায়, সিরিজের বাকি বইগুলোর কাজও এগিয়ে চলেছে। সবকটি পাঠে বঙ্গবন্ধুর জীবন সম্পর্কে জানা হবে না শুধু, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানসহ গোটা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক সমাজতাত্ত্বিক ইতিহাসের বাঁকগুলো ঘুরে আসা সম্ভব হবে। এ প্রসঙ্গে সিরিজ প্রকাশনার প্রকাশক রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক বলেন, বঙ্গবন্ধু দূর গ্রামের একজন সাধারণ কিশোর ছিলেন। অথচ পরিণত বয়সে সেই তিনি বাঙালী জাতির আশা ও স্বপ্নকে ধারণ করেছিলেন। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ দূরদর্শী নেতার চিন্তার ফসল। স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। দেশের প্রতি জাতির প্রতি তাঁর নিবেদন, আত্মত্যাগ আগামী প্রজন্মকে জানতে হবে। সে লক্ষ্যেই গ্রাফিক নভেল সিরিজ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়। আমরা মনে করি, মুজিবকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে হলে প্রচলিত দু’ একটি পথ ধরে হাঁটলেই চলবে না। সময়ের চাহিদা মাথায় রাখতে হবে। নভেল সিরিজ তার উদাহরণ হতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে আগামী প্রজন্মের কাছে সরল সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তুলে ধরতে বাকি খ-গুলোর কাজ এগিয়ে চলেছে বলেও জানান বঙ্গবন্ধু পরিবারের গর্বিত এই সদস্য। গ্রাফিক নভেল মুজিব সম্পাদনা করেছেন শিবু কুমার শীল। কাহিণী বিন্যাস ও সংলাপ লিখেছেন সিদ্দিক আহমেদ। চিত্রণের কাজটি করেছেন সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময়। নতুন বই অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১১তম দিনে বৃহস্পতিবার মেলায় এসেছে ১৩১টি নতুন বই। বাংলা একাডেমির তথ্য কেন্দ্রে জমা পরা বইয়ের সংখ্যা এটি। এর বাইরেও এসেছে নতুন নতুন বই। শিশুপ্রহর ঘোষণা আজ শুক্রবার মেলার শিশুপ্রহর। শিশুদের পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে বিশেষ এই আয়োজন। শিশু কিশোরদের খোলামেলা পরিবেশে বই দেখার ভাল সুযোগ করে দিতে মেলার প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করে দেয়া হবে সকাল ১১টায়। চলবে বেলা ১টা পর্যন্ত। সচেতন বাবা-মায়েরা, অভিভাবকেরা নিশ্চয়ই কাজে লাগাবেন এই সুযোগ। মেলা মঞ্চের আয়োজন গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলা একাডেমির হীরকজয়ন্তী : অমর একুশে গ্রন্থমেলা- অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। বিষয়ের উপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষক বদিউদ্দিন নাজির। আলোচনা করেন মুহম্মদ জাহাঙ্গীর, ড. জালাল আহমেদ এবং খান মাহবুব। সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমদ। লিখিত প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক বলেন, ১৯৮৪ সাল থেকে ঐ নামেই বাংলা একাডেমির উদ্যোগে গ্রন্থমেলা বৃহৎ কলেবলে নব উদ্যমে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সেই থেকে প্রতিবারই অংশগ্রহণকারী প্রকাশকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমির গ্রন্থমেলার অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৫২টি, এখন তার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তিনি বলেন, এক সময় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে গ্রন্থমেলার স্থান সঙ্কুলান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে আর তাই ২০১৪ সাল থেকে মেলাকে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। তবে বলতে গেলে মূল গ্রন্থমেলাটি এখন সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত হচ্ছে। ২০১৫ সালে গ্রন্থমেলায় স্টলের পাশাপাশি সুপরিসর প্যাভিলিয়নের ব্যবস্থা করায় মেলা আরও সুদৃশ্য ও পেশাদারী চেহারা পেয়েছে। এই গ্রন্থমেলা ইতোমধ্যে দেশের একটি প্রধান সাংস্কৃতিক আয়োজন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। দেশের প্রকাশক ও পাঠকদের জন্য বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা হয়ে উঠেছে মহামিলনতীর্থ। বলতে গেলে বাংলাদেশের সৃজনশীল গ্রন্থের প্রকাশনাই এখন অমর একুশে গ্রন্থমেলাভিত্তিক হয়ে উঠেছে। আলোচকরা বলেন, বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা এখন বিশ্বের দীর্ঘ সময়ব্যাপ্ত গ্রন্থমেলার স্বীকৃতি অর্জন করেছে। একুশের অমলিন চেতনার গ্রন্থমেলার সঙ্গে গত কয়েক বছর যাবত যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাত্রা। তবে এখন আমাদের গ্রন্থমেলা নিয়ে কিছু অগ্রবর্তী ভাবনারও সময় এসেছে। অনতিবিলম্বে অমর একুশে গ্রন্থমেলার একটি প্রামাণ্য ইতিহাস প্রণয়ন করা জরুরী। সেইসঙ্গে মেলায় এদেশের পথিকৃৎ প্রকাশকদের ছবি ও পরিচিতি সংবলিত একটি প্রদর্শনী আয়োজন করা উচিত যার মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে গ্রন্থসুহৃদ পূর্বসূরিদের। তাঁরা বলেন, একই সঙ্গে অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজনে মাসব্যাপী আলোচনায় বইয়ের সম্পাদনা, মুদ্রণ, বিপণন ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। গণমাধ্যমে বইয়ের প্রচারের ক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকাও প্রয়োজন, যার মাধ্যমে প্রকৃত ভাল বই পাঠকের কাছে পৌঁছুতে পারে। সভাপতির বক্তব্যে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা আজ এক সাংস্কৃতিক মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। এর অতীতে ফিরে তাকানোর পাশাপাশি বর্তমানের অভিজ্ঞতায় ভবিষ্যতের দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে, যেন একুশে গ্রন্থমেলাকে যথার্থই জ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগানো যায়। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী শাহীন সামাদ, কল্যাণী ঘোষ, বুলবুল মহলানবীশ, মাহমুদ সেলিম, হায়দার হোসেন, মাহমুদুজ্জামান বাবু এবং শেখ মিলন। আবৃত্তি করেন প্রকাশ সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীরা।
×