ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জামায়াতের অর্থদাতা মীর কাশেম আলীকে বাঁচাতে আইনজীবীর ভূমিকা গ্রহণ করলেন ;###;সমস্ত সরকারী সুবিধা ভোগরত অবস্থায় এ কাজ নৈতিকতাবিরোধী- এ্যাটর্নি জেনারেল ;###;এই বিচারপতিই জেলহত্যা মামলায় ৬ আসামিকে বেকসুর খালাস দেন, যা পরে টেকেনি

যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে

আরাফাত মুন্না ॥ এখনও সরকারী সব সুবিধা ভোগ করে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর আইনজীবী প্যানেলে যোগ দিয়ে নৈতিকতাবিরোধী কর্মকা-ে জড়ালেন হাইকোর্টের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী। বুধবার মীর কাশেম আলীর আপীল শুনানিতে অংশ নেন এই বিচারপতি। দেশে প্রথমবার চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিলেন হাইকোর্টের সদ্য অবসরে যাওয়া কোন বিচারপতি। তিনি গত ১২ ডিসেম্বর অবসরে যান। অনেকটা আকস্মিকভাবে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে বিচারপতির এই অবস্থান হয়ে ওঠে টক অব দ্য কান্ট্রি। এ ধরনের কর্মকা-কে নৈতিকতাবিরোধী বলেছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। শুনানিতে বিচারপতি নজরুলের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সরকারী সুযোগ-সুবিধা নেয়া অবস্থায় অবসরপ্রাপ্ত ও বর্তমান বিচারপতিদের আদালতের প্রথা ও নিয়মকানুন মেনে চলা উচিত।’ এর একদিন আগেই এই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নিজের নৈতিকতা নিয়ে কথার ফুলঝুরি ঝরান। অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতিই জেলহত্যা মামলার ছয় আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য আপীল বিভাগে ওই রায় বাতিল হয়েছিল। জানা গেছে, সদ্য অবসরে যাওয়া বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন জেনারেল এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কমিটিরও (জিএ কমিটি) সদস্য ছিলেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দায়িত্ব গ্রহণের পর জিএ কমিটি পুনর্গঠন করলে সেখানে এক সময় তার বিএনপিপন্থী আইনজীবী নেতা বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীকে রাখেন। নিম্ন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি ও শৃঙ্খলার আদেশ জারি করা এ কমিটির কাজ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে বিচার বিভাগ নিয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে সদ্য অবসরে যাওয়া বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘যখন হাইকোর্টে বিচারক ছিলাম তখন কেউ কখনও অন্যায় অনুরোধ নিয়ে আমার সামনে আসেননি। কারণ তারা জানেন অনুরোধ করলে উল্টো ফল হবে।’ ওই অনুষ্ঠানে বিচারক নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে নানা সমালোচনা করেন। ‘নিমগাছ থেকে কোন দিন ফজলি আম হবে না’ বলেও ওই অনুষ্ঠানে তিনি মন্তব্য করেন। গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যেখানে ড. কামাল হোসেনও উপস্থিত ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ড. শাহদীন মালিক, এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী প্রমুখ। বুধবার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী মীর কাশেমের দ্বিতীয় দিনের আপীল শুনানিতে অংশ নেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের সপ্তম আপীলে অবসরপ্রাপ্ত কোন বিচারপতি অংশ নিলেন। কিন্তু এর আগে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ আরও ছয় মামলার শুনানিতে আপীলে এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এস এম শাহজাহান শুনানি করেছেন। শুধু মাত্র ফাঁসি কার্যকর হওয়া কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার পক্ষে ব্যারিস্টার রাজ্জাক শুনানি করেছিলেন। তবে এই প্রথম জামায়াতের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ও অর্থদাতা হিসেবে পরিচিত মীর কাশেমের আপীল শুনানিতে অবসরে যাওয়া কোন বিচারপতি অংশ নিচ্ছেন। শুনানির পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘মীর কাশেম আলী তার আপীল শুনানিতে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতিকে নিয়োগ দিয়েছেন। এ বিষয়ে আমি আদালতকে বলেছি, তিনি (ওই বিচারপতি) এখনও সরকারী বাসভবনে আছেন, সরকারী সুবিধা ভোগ করছেন, নিরাপত্তার জন্য গানম্যান ব্যবহার করছেন, এ অবস্থায় যদি তিনি আদালতে উপস্থিত হন, সেক্ষেত্রে সেটা হবে নৈতিকতা বিরোধী। সেক্ষেত্রে তার এ মামলায় উপস্থিত না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তখন প্রধান বিচারপতি জাজদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘যারা জাজেস কমপ্লেক্সে বাস করেন, তারা এই ভবনের মর্যাদা রক্ষা করে চলবেন।’ বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী শুনানিতে অংশ নিতে পারেন কি না এ প্রশ্নের জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আইনগত বাধা নেই, তবে এটা নৈতিকতার প্রশ্ন। ‘বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী যদি সরকারী সুবিধা না নিয়ে শুনানিতে অংশ নেন, তাহলে আমাদের কথা থাকবে না’ বলেও মন্তব্য করেন এ্যাটর্নি জেনারেল। মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমরা এতদিন শুনে এসেছি- মীর কাশেম আলী জামায়াতের অর্থের যোগানদাতা, বিত্তশালী। শুনেছি, মীর কাশেম আলী বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছেন। এখন সেই কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে। মীর কাশেম আলী বড় বড় আইনজীবী নিয়োগ করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর অন্য নেতাদের শুনানির সময় সিনিয়র আইনজীবীরা সাধারণত আধা ঘণ্টার বেশি এজলাস কক্ষে বসে থাকতেন না। কিন্তু মীর কাশেমের শুনানিতে সিনিয়র আইনজীবীরা সকাল থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এজলাস কক্ষে বসে থাকছেন।’ পরে সন্ধ্যায় মামলায় যুক্ত হওয়া এবং সরকারী সুবিধা নেয়ার বিষয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংবিধান আমাকে এই সুযোগ দিয়েছে, তা মেনেই আমি আইনজীবী দায়িত্ব পালন করছি। বাড়ি, গাড়ি ও গানম্যান আর কয়েক মাস পাচ্ছি। তবে এসবের অপব্যবহার আগেও করিনি, আর ভবিষ্যতেও করব না’। বুধবার যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর আপীল শুনানি শেষে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করেন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপীল বেঞ্চে মীর কাশেমের আপীল শুনানি হয়। বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান। জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাশেম আলীর আপীল শুনানি অব্যাহত রয়েছে। তার আগে আদালতে মীর কাশেম আলীর পক্ষে মঙ্গলবার সকালে লিখিত আর্গুমেন্ট জমা দেন এস এম শাহজাহান। এরপর অভিযোগগুলো পাঠ শুরু করেন। এর আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি আদালত মীর কাশেম আলীর আপীল শুনানির জন্য ৯ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন। বুধবার ছিল শুনানির দ্বিতীয় দিন। গত ২ ফেব্রুয়ারি তার আইনজীবীদের শুনানির জন্য এক সপ্তাহ সময় দেন আদালত। সেই অনুযায়ী মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধে ২০১৪ সালের ২ নবেম্বর কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- ঘোষণা করে রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। রয়ের বিরুদ্ধে ৩০ নবেম্বর মীর কাশেম আলী আপীল করেন। উল্লেখ্য, নজরুল ইসলাম চৌধুরী ২০০১ সালের ৩ জুলাই তিনি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হন এবং ২০০৩ সালের ৩ জুলাই হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি নিযুক্ত হন। তিনি গত ১২ ডিসেম্বর হাইকোর্ট থেকে অবসরে যান। বিচারক হওয়ার আগে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত প্যানেল থেকে নির্বাচন করে সমিতির সম্পাদকও হয়েছিলেন তিনি।
×