ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ॥ সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ॥ সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

(৯ ফেব্রুয়ারির পর) আনোয়ার তখন বুঝতে পারেন কিছু একটা ঘটছে। ডিউটি রুমে নির্দেশ দেন একটি প্যাট্রল যেন শেখ মনির বাসায় যায়। তারপর হেঁটেই সংসদ ভবনের কাছে অফিসে পৌঁছান। সেখানে প্যাট্রল ডিউটিতে থাকা অফিসার জানান, তারা শেখ মনির বাসায় গিয়েছিলেন। মনি ও তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। তারা শুনেছেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতেও নাকি হামলা হয়েছে। আনোয়ার তাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতে বলেন। রক্ষীবাহিনীপ্রধান আনোয়ারকে বলে গিয়েছিলেন, প্রয়োজনে যেন তিনি সেনাবাহিনীপ্রধান শফিউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ কথা মনে হতেই লাল টেলিফোনে তিনি সেনাপ্রধানকে ফোন করেন। তিনি জানান, তাকেও ফোন করে ফোর্স পাঠাতে বলা হয়েছে। “শফিউল্লাহ আমাকে বললেন, তিনি ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলকে পাচ্ছেন না। বলে তিনি ফোন রেখে দিলেন।” [পৃ. ১৪১] এর মধ্যে খবর পান বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। আবার ফোন করেন সেনাপ্রধানকে। পেয়েও যান। “তিনি আমাকে বললেন, সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং ডিজিএফআইপ্রধান আবদুর রউফ তার সঙ্গে আছেন। আরও বললেন, ‘ডব ধৎব মড়রহম ঃড় ফড় ংড়সবঃযরহম’. তোমরা অপেক্ষা করো এবং তৈরি থাকো।” [পৃ. ১৪২] তিনি এবং সরোয়ার এতে উজ্জীবিত হলেন। কারণ সেনাবাহিনী ও রক্ষীবাহিনী তাহলে ঐক্যবদ্ধভাবে পদক্ষেপ নিতে পারবে। এরই মধ্যে রক্ষীবাহিনীর অন্য লিডাররা এসে জানালেন, বঙ্গবন্ধু, আবদুর রব সেরনিয়াবাত নিহত হয়েছেন। আনোয়ার সৈয়দ নজরুল ইসলামকে পেলেন। তিনি খবর শুনে নির্বাক। কিন্তু রক্ষীবাহিনীর কার্যালয়ে যাবেন বলে জানালেন। আনোয়ার সৈয়দ নজরুল ও মনসুর আলী কাউকে পেলেন না। তবে মিন্টো রোডে যাওয়ার সময় দেখলেন ওই সাতসকালে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টার। এরপর খবর এলো তাদের ৪৬ ব্রিগেড সদর দপ্তরে যেতে হবে। মেজর জিয়াউদ্দিন এসে তাদের নিয়ে গেলেন ৪৬-এ। সেখানে গিয়ে দেখেন খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল বসে আছেন। ৩০-৩৫ জন সেনা কর্মকর্তা তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন। এরপর আনোয়ারের ভাষায়, “তাঁদের চেহারা দেখে আমরা বুঝতে পারলাম না, তাঁরা অভ্যুত্থানের পক্ষে, না বিপক্ষে। তবে একটা রহস্যজনক নীরবতা লক্ষ্য করা গেল। ব্রিগেড কমান্ডারের নির্ধারিত চেয়ারে বসে ছিলেন খালেদ মোশাররফ। তাঁর পাশে একটি চেয়ারে বসে ছিলেন ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার শাফায়াত জামিল। টেবিলের অপর পাশে চেয়ার খালি ছিল। তাঁরা সেখানে আমাদের বসতে বললেন। প্রথমেই খালেদ মোশাররফ যা বললেন, তা শুনে তো আমাদের চোখ ছানাবড়া, তিনি ইংরেজিতে বললেন, “ঝযধযববফ-ঝধৎধিৎ, ও শহড়ি ুড়ঁ ধৎব ঢ়ধঃৎরড়ঃং নঁঃ বি যধফ ঃড় ফড় রঃ নবপধঁংব বি ফড় হড়ঃ ধিহঃ ঃযরং পড়ঁহঃৎু ঃড় নব ধ শরহমফড়স.” [শহীদ-সরোয়ার, আমি জানি তোমরা দেশপ্রেমিক কিন্তু আমাদের কাজটি করতে হয়েছে। কারণ আমরা চাই না এ দেশটি একটি কিংডম (রাজতন্ত্র) হয়ে যাক।] আনোয়াররা ফিরে এলেন। সে সময়ের যা অবস্থা তা আনোয়ার বর্ণনা করেছেন এবং এটি সত্য। লিখেছেন তিনি- “এদিকে সারা দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের অগণিত নেতা ও কর্মী নিশ্চুপ হয়ে পড়লেন; প্রতিবাদে কেউ টুঁ শব্দ পর্যন্ত করলেন না। প্রকাশ্যে কোথাও কোনো প্রতিবাদ হলো না। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। আমি ভাবতে থাকি, বাঙালি জাতি কি এতই অকৃতজ্ঞ যে, তাদের মুক্তিদাতা জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো অথচ একজন বাঙালিও প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এলো না! ১৯৭১ সালের বীর বাঙালি ১৯৭৫ সালে এসেই ভীরু জাতিতে পরিণত হলো। এ তো বিশ্বাস করার মতো নয়। কোথাও কোনো প্রতিবাদ হয়েছে কিনা জানার জন্য বিভিন্ন জেলার রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পগুলোতে আমরা ফোন করতে থাকি। কিন্তু এমন কোনো খবর পাওয়া গেল না। অথচ জনগণের সমর্থন ছাড়া কোথাও কোনো প্রতিরোধ সফল হয়নি, সফল করা যায়নি।” [পৃ. ১৫০] রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে ট্যাংক। আনোয়ার-সরোয়ার আরো কয়েকজনকে ফোন করলেন। কাউকে পেলেন না। পেলেন তোফায়েল আহমেদকে। তাঁকে নিয়ে আসা হলো সদর দপ্তরে। “জাতির জনক সপরিবারে নিহত হয়েছেন জেনে তোফায়েল আহমেদ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হলেও আমাদের প্রধান কার্যালয় থেকে সেনাবাহিনীপ্রধান, সরকারের অন্যান্য নেতাসহ অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু কারো কাছ থেকেই ইতিবাচক সাড়া পাননি।” [পৃ. ১৫৩] তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে তারা আলাপ করেন পাল্টা পদক্ষেপ নেয়ার। কিন্তু সাভারে তারা আর যেতে পারেননি। এ সময় আরেকটি ঘটনা ঘটে যা তাদের অবাক করেছিল। লে. কর্নেল আমিন আহমেদ চৌধুরী একদল সেনা নিয়ে সাভার রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যান। যেখানে একজন ভারতীয় প্রশিক্ষক অবস্থান করছিলেন। তিনি সেই মেজরকে রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে নিয়ে আসেন এবং তাকে রেখে চলে যান। তাকে রক্ষীবাহিনীর দপ্তর থেকে ভারতীয় হাইকমিশনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আনোয়ার জানিয়েছেন, “বেসামরিক প্রশাসনের পক্ষে সরকারিভাবে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুস ও প্রধানমন্ত্রীর সচিব আবদুর রহিম। সংকটময় ওই মুহূর্ত পরামর্শের জন্য তাদের আমরা পাইনি। তাঁরাও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।” [পৃ. ১৫৫] ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আবার সরোয়ার ও আনোয়ারকে যেতে বলেন বঙ্গভবনে। সেখানে গিয়ে দেখেন খালেদ একটি অপারেশন রুম খুলেছেন। ভীষণ ব্যস্ততা দেখাচ্ছেন তিনি। সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সৈন্য সমাবেশ করছে এসব তথ্য নাকি তারা পাচ্ছেন। তার সঙ্গের কর্মকর্তারাও ব্যস্ততা দেখাচ্ছেন। ভাবটা এ রকমÑ যে কোনো সময় ভারত আক্রমণ করতে পারে। আনোয়ার লিখেছেন, খালেদ আসলে একটা ভাব দেখাচ্ছিলেন। “তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে অন্য কাজে বেশি ব্যস্ততা দেখালেন। তবে আমরা ঠিকই বুঝতে পারলাম যে, ভারত বাংলাদেশ আক্রমণের তৎপরতা দেখাচ্ছে, এই মর্মে আমাদের তিনি ধোঁকা দিতে চাচ্ছেন। আমরা সামরিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হলেও সাধারণ জ্ঞানহীন তো নই।” [পৃ. ১৫৯] তিনি আরো লিখেছেন, “বঙ্গভবনে দেখা গেল বঙ্গবন্ধুর খুনিরা রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে ভীষণ ব্যস্ত। তাদের মধ্যে একটা উৎসব উৎসব ভাব। আমিন আহমেদ চৌধুরীকে দেখা গেল তিনি রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি বনে গেছেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ মতিন বীরপ্রতীককে দেখা গেল বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নিরাপত্তার দায়িত্বে। জিয়াউর রহমান, বিডিআরপ্রধান খলিলুর রহমান, পুলিশপ্রধান একে নুরুল ইসলাম ও ব্রিগেডিয়ার মসহুরুল হক একটা কক্ষে কথাবার্তা বলছিলেন।” [পৃ. ১৫৯] জিয়া আনোয়ারের কাছে জানতে চাইলেন, তোফায়েল রক্ষীবাহিনীর দপ্তরে আছেন কিনা। উত্তর দেয়ার আগেই জিয়া বললেন, সিদ্ধান্ত হয়েছে তাকে পুলিশ হেফাজতে নেয়ার। তোফায়েল আহমেদকে পুলিশ হেফাজতে না দিয়ে বাসায় পৌঁছে দেয়া হয়। পরবর্তীতে সামরিক বাহিনী তাকে তুলে নিয়ে অত্যাচার চালায়। এ সময় “একটি কক্ষে দেখি সেনাপ্রধান কেএম শফিউল্লাহ আর বিমানবাহিনীপ্রধান একে খন্দকার নির্লিপ্তভাবে এক কোনায় বসে আছেন। আমরা তাদের কাছে গেলে শফিউল্লাহ আমাদের খোঁজখবর নেন এবং বঙ্গবন্ধুর জন্য কিছুই করতে পারলেন না বলে অনুশোচনা প্রকাশ করেন। তিনি বললেন, ‘ঝযধযববফ, ও রিষষ মড় নষধপশ রহ ঃযব যরংঃড়ৎু ড়ভ ইধহমষধফবংয.’ [পৃ. ১৬০] ঠিক মন্তব্যই করেছিলেন তিনি। এতসব ঘটনার মধ্যেও একটি ঘটনা ঘটে যা এখন সবাই বিস্মৃত। বঙ্গবন্ধু হত্যায় রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা ছিলেন ভারাক্রান্ত। তাদের দুজন সদস্য আত্মহত্যা করেন। চলবে...
×