ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পটুয়াখালীতে প্রথম দেশের পতাকা উত্তোলনকারী যুদ্ধকালীন কমান্ডারের আকুতি

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

পটুয়াখালীতে প্রথম দেশের পতাকা উত্তোলনকারী যুদ্ধকালীন কমান্ডারের আকুতি

নিজস্ব সংবাদদাতা, পটুয়াখালী ॥ আলতাফ হায়দার! তৎকালীন পাকিস্তানী হায়েনাদের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক বীর মুক্তিযোদ্ধা।এ অঞ্চলের একমাত্র যুদ্ধকালীন কমান্ডার। দেশ স্বাধীনের অন্যতম সূর্য সন্তান। পটুয়াখালীতে প্রথম দেশের পতাকা উত্তোলনকারী। সময়ের ব্যাবধানে এখন বিনা চিকিৎসায়, অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটে তার। তার পৈত্রিক বসত-বাড়ি হানাদাররা পুড়িয়ে দেয়ার ফলে সরকারের পক্ষ থেকে একটা বাড়ি পাওয়ার কথা ছিল তার। অভ্যান্তরীন দলাদলীতে এখন সেটাও হাতছাড়া হওয়ার পথে। তাই অচল দেহটাকে অপর দুজনের সহায়তায় সেই মির্জাগঞ্জের নিভৃত পল্লী থেকে টেনে নিয়ে এসেছেন পটুয়াখালী জেলা শহরে। উদ্যেশ্য তার বাড়ীটি পাওয়ার আকুতি নিয়ে যাবেন জেলা প্রশাসকের দরবারে। সংবাদ কর্মীদের সুহৃদ আলতাফ হায়দার সোমবার রাতে প্রেসক্লাবে আসেন দুই নাতীর সহযোগীতায়। যুদ্ধকালীন কত স্মৃতি-বিস্মৃতির কথা। কথাই যেন তার ফুরায় না। তিন তিন বার ব্রেইন ষ্ট্রোক করার পরেও তার স্মৃতিতে এতটুকুও ধুলা জমে নি। পিনপতন নিবরবতায় তন্ময় হয়ে সংবাদকর্মীরা শুনছিলেন এ অকুতভয় যোদ্ধার যুদ্ধকালীন নানা যুদ্ধের ঘটনা। স্বাধীনতা যুদ্ধের এক সময়ের পরক্রমশালী যোদ্ধা আজ ব্যাক্তিগত জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক সৈনিক। কঠিন অসুখ বাসা বেঁধেছে তার দেহে। মৃত্যুর প্রহর গুনছেন প্রতি মূহুর্তে। শেষ যাত্রার ডাক এলে হয়ত চলে যাবেন না ফেরার দেশে, সবার অলক্ষ্যে। পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটারের দুরত্বে মির্জাগঞ্জ উপজেলার দেউলী গ্রামের সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম এই বীর যোদ্ধার। বাবা মৃত: আলহাজ্ব আবদুল কাদের জমাদ্দার ও মৃত: মোসাঃ লালবরু বেগমের দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের মধ্যে আলতাফ হায়দার সবার ছোট। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের জন্য জাতির জনকের ডাকে সাড়া দিয়ে নিভৃত পল্লীর এই টগবগে যৌবনের যুবক ঝাপিয়ে পরেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। তিনি সম্মুখ যুদ্ধে এতটাই সাহসী-পারদর্শী ছিলেন যে, বরগুনা-পটুয়াখালী অঞ্চলে আসা পাকিস্থানী হায়েনারা রীতিমত আতঙ্কে থাকতো। আলতাফ হায়দারকে দমাতে তৎকালীন সময়ে পাকিস্থানী হায়েনারা পুরিয়ে দেয় তার বসত ঘরটিও। তার পরেও এতটুকু দমেননি এই সাহসী যোদ্ধা। তার অদম্য সাহসের কারনে তার নামেই তৈরী হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের ‘হায়দার বাহীনি’। হায়দার বাহীনি ৭১’র ৭ ডিসেম্বর পটুয়াখালী জেলা শহরে আক্রমন করার খবরে পাকিস্থানীরা পালিয়ে যায়। ৮ ডিসেম্বর সকালে তিনি বর্তমান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। আজ সেই হায়দার বাহীনির প্রধান আলতাফ হায়দার এখন জীবনের শেষ বেলায়। হয়তো চলে যাবেন না ফেরার দেশে, তাই সংবাদকর্মীদের কাছে থেকে বিদায় নেয়া এবং দোয়া চাইতে আসা পটুয়াখালী প্রেসক্লাবে। হয়তো আর বেশি সময় তার নেই। কিন্তু এক বুক কষ্টের কথা বলে গেলেন সাংবাদিকদের কাছে। তার গোছানো আবেগঘন কথা উপস্থিত সংবাদকমীদের আবেগে আপ্লুত করেছে। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি স্ত্রী, এক পুত্র ও পাঁচ কন্যা সন্তানের গর্বিত মানুষ। পাঁচ মেয়ের মধ্যে তিন মেয়েকে বিয়ে দিলেও ছোট ছোট দুইটি কন্যা সন্তান রয়েছে। তাদের ভাবনায় তার রাতের ঘুম বিদায় নিয়েছে বহু আগে। দেশ স্বাধীনের এই দীর্ঘ সময়ে মাসে মাসে সামান্য কয়টা টাকা ভাতা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোন সাহায্য পান নি তিনি। আশাও ছিল না কখনো। কিন্তু নিজের শাররীক অসুস্থতা দিন দিন তাকে আর্থিক দৈন্যতার দিকে ঠেলে দেয়। নিজের চলার শক্তি হারিয়ে ৭/৮ জনে সংসারের ভার বহন করতে গিয়ে হাপিয়ে ওঠেন এ যোদ্ধা। বর্তমান বসত ঘরটিও এখন বসাবাসের অনুপোযোগী। আগামী বৃষ্টিতে আর ঐ ঘরে থাকার কোন সুযোগ নেই। নিজের জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আগমী প্রজন্মের জন্য একটু আশ্রয়ের ব্যাবস্থা করতে না পারা নিজের বড় পরাজয় মনে করছেন এ মানুষটি। দেশে স্বাধীনের জন্য ইস্পাত কঠিন দৃঢ় মনোবল থাকলেও আজ নিজের জীবন যুদ্ধে যেন খেই হারিয়ে ফেলেছেন। কারন পটুয়াখালীতেই বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের সময়ে আশ্রয়ের ব্যাবস্থাটুকু হলো না। বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা বান্ধব সরকার তার জন্য একটি ঘর বরাদ্দ দিলেও উপজেলা কমান্ডার তার বরাদ্দকৃত ঘরটি আত্মসাৎ করেছেন বলে তিনি আজ মঙ্গলবার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. নজরুল ইসলামের কাছে অভিযোগ করেন। এ কষ্টের কথা তিনি কাকে বলবেন। তার এ কষ্ট লাঘব যিনি করতে পারেন, তিনি হলেন জাতীর জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তার এ কথা হয়তো তার কান পর্যন্ত গড়াবে না। আর তার কষ্টও লাঘব হবে না। জীবন সাহাহ্নে এসে আলতাফ হায়দার প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার সুচিকিৎসা ও তার বরাদ্দকৃত ঘরটির দাবী জানিয়েছেন।
×