ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বেড়ে গেছে লন্ডন তদবির

জাতীয় কাউন্সিলকে ঘিরে চলছে বিএনপি নেতাদের দৌড়ঝাঁপ

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

জাতীয় কাউন্সিলকে ঘিরে চলছে বিএনপি নেতাদের দৌড়ঝাঁপ

শরীফুল ইসলাম ॥ জাতীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে বিএনপি নেতাদের লন্ডন কানেকশন বেড়ে গেছে। পরবর্তী নির্বাহী কমিটিতে পছন্দের পদ পেতে নানামুখী তৎপরতার অংশ হিসেবে দলের অধিকাংশ নেতা লন্ডন প্রবাসী বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। ফোনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের পাশাপাশি কেউ কেউ সরাসরি লন্ডনেও চলে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ দেশে অবস্থান করেও তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজনদের মাধ্যমে লবিং করছেন। সূত্রমতে, ১৯ মার্চ বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলকে ঘিরে দলের সর্বস্তরের নেতাদের দৌড়ঝাঁপ বেড়ে গেছে। দলে নিজ নিজ অবস্থান পাকাপোক্ত করতে সব নেতাই এখন বিভিন্ন মাধ্যমে লবিং করছেন। তবে যারা বিএনপি চেয়ারপার্সন বা তাঁর কাছের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন তারা লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। আর যারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারছেন তারাও গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে তারেক রহমানের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন। এ সুযোগে বিএনপি নেতাদের কাছে লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানের কাছের মানুষদের কদর বেড়ে গেছে। দলের কোন কোন নেতা সরাসরি তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়ে তার ঘনিষ্ঠজনদের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছেন। এদিকে জাতীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে দলের পদ-পদবি বাগিয়ে নিতে বিএনপি নেতাদের লন্ডন কানেকশন বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখছেন না কিছু সিনিয়র নেতা। তারা চান দলের অন্য নেতারা তারেক রহমানের কাছে না গিয়ে তাদের কাছে আসুক। কিন্তু দলের পদলোভী নেতারা বাস্তবতার আলোকে অন্যবারের মতো দলের সিনিয়র নেতাদের মাধ্যমে লবিং না করে এবারের জাতীয় কাউন্সিলের আগে সরাসরি হাইকমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় কাউন্সিল করতে ইতোমধ্যেই গণপূর্ত বিভাগের অনুমতি পেয়েছে বিএনপি। আর অনুমতি পাওয়ার পর ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি জোরদার করতে শুরু করেছে বিএনপি। জাঁকজমকভাবে কাউন্সিল করতে যা যা করণীয় তা করতে দলের ক’জন সিনিয়র নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে প্রস্তাব জমা দেয়ার জন্য দলের কাউন্সিলরদের কাছে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। লন্ডন থেকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও কাউন্সিল সফল করতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। জানা যায়, গতবছর ১৫ সেপ্টেম্বর বিএনপি চেয়ারপার্সন লন্ডনে গিয়ে জাতীয় দলের কাউন্সিল নিয়ে ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে তারেক রহমানের বাসায় অবস্থান করে মা-ছেলে দলের ভবিষ্যত নিয়ে নানামুখী পরিকল্পনা করেন। ২১ নবেম্বর খালেদা জিয়া দেশে ফিরে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গেও জাতীয় কাউন্সিলের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। আর জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দল গোছানোর বিষয়টি মাথায় রেখেই এবার ৫ জানুয়ারি সরকারের ২ বছর পূর্তিকে কেন্দ্র করে কোন আন্দোলন কর্মসূচী দেয়া হয়নি। এদিকে যেসব সাংগঠনিক জেলার কমিটি এখনও পুনর্গঠন করা হয়নি সেগুলোর মধ্যে বেশকিছু জেলার কমিটি এ মাসেই করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর পরও যেসব জেলা-উপজেলায় কমিটি না হবে সেগুলো থেকে কাউন্সিলর নির্ধারণ করা হবে ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের মতো মনোনীত ( সিলেক্টেড) প্রতিনিধিদের নিয়েই। ২০০৯ সালে কাউন্সিলের আগে ৬ মাস চেষ্টা করেও সর্বস্তরে কমিটি করতে পারেনি বিএনপি। পরে কেন্দ্র থেকে কাউন্সিলর ঠিক করে দিয়ে তাদের নিয়ে জাতীয় কাউন্সিল করা হয়। এবারও গতবছর আগস্ট মাস থেকে দেশব্যাপী বিভিন্ন স্তরে কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন দলের হাইকমান্ড। কিন্তু দলীয় কোন্দলসহ বিভিন্ন কারণে অধিকাংশ জেলা-উপজেলায় কমিটি পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়নি। যদিও আগস্ট মাসে কেন্দ্র থেকে জেলা-উপজেলা নেতাদের কাছে পাঠানো চিঠিতে নির্ধারিত সময়ে কমিটি পুনর্গঠন করতে না পারলে কেন্দ্র থেকে কমিটি চাপিয়ে দেয়ার আগাম ঘোষণা দেয়া হয়। অবশ্য দ্বিতীয় দফায় কমিটি পুনর্গঠনের সুযোগ নিয়ে ইতোমধ্যেই সিলেট জেলা ও মহানগর কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। আরও অন্তত ২০টি জেলা ও শতাধিক উপজেলা কমিটি এ মাসেই হয়ে যাবে। এর মধ্যে ১০ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা ও নওগাঁ জেলায় সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাজশাহী মহানগরের সম্মেলন হতে যাচ্ছে ১৫ ফেব্রুয়ারি। খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ ফেব্রুয়ারি। আর ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রংপুর, জয়পুরহাট, নোয়াখালী, লালমনিরহাট, কুষ্টিয়া, ঝালকাঠি, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও রাজবাড়ী, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর, কুমিল্লা, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা সম্মেলন করার প্রস্তুতি চলছে। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের দিন খালেদা জিয়াকে পুনরায় চেয়ারপার্সন এবং সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এর পর ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব করে দলের ৩৮৬ সদস্যের জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। ২০১১ সালের ১৬ মার্চ তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। ওই বছর ৬ এপ্রিল দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেন খালেদা জিয়া। এবারের জাতীয় কাউন্সিলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দীর্ঘ ৫ বছর পর ভারমুক্ত করা হচ্ছে। তবে যারা মির্জা ফখরুলকে পছন্দ করেন না তারা ইতোমধ্যেই তারেক রহমানের কাছে তার ঘনিষ্ঠজনদের মাধ্যমে আপত্তি জানিয়েছেন। তবে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে ক্লিন ইমেজের অধিকারী মির্জা ফখরুলকে মহাসচিব করতে খালেদা জিয়ার কাছে অনুরোধ এসেছে বলে জানা গেছে। আর খালেদা জিয়া নিজেও দলের পরবর্তী মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুলের নাম তাঁর গুডবুকে রেখেছেন। এ ছাড়া মির্জা ফখরুলের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রয়েছে দলের এমন ক’জন নেতাও বিভিন্ন মাধ্যমে তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি ক্রমেই জোরদার করা হচ্ছে। আমরা ১৯ মার্চই জাতীয় কাউন্সিল করতে চাই। আর জাতীয় কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে দলে পছন্দের পদ পেতে চেষ্টা-তদ্বির থাকতেই পারে। আর তারেক রহমান বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তাই বিদেশে অবস্থান করলেও দলের নেতারা তার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন এটাই স্বাভাবিক। মির্জা ফখরুল বিএনপির ভারমুক্ত মহাসচিব হচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দলের দুর্দিনে তিনি অনেক কষ্ট করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি তার কাজের স্বীকৃতি পাবেন। জানা যায়, এবার কাউন্সিলের পর নতুন কমিটিতে বিএনপির বর্তমান ৩৮৬ সদস্যের নির্বাহী কমিটি থেকে ১০০ জনের বেশি নেতা বাদ পড়তে পারেন। কমিটিতে যাদের রাখা হবে তাদের মধ্য থেকে অনেকেরই পদ-পদবি রদবদল হবে। আর নতুন কমিটিতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিশ্বস্ত শতাধিক তরুণ নেতাকে সুবিধাজনক অবস্থানে স্থান দেয়া হবে। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ জনকে নেয়া হবে সাবেক ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও মহিলা দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা তরুণ নেতাকে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির ১৯টি পদের মধ্যে ৩টি পদ বর্তমানে শূন্য রয়েছে। আর স্থায়ী কমিটির আরও ক’জন সদস্য অসুস্থতা ও বার্ধকের কারণে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। তাই স্থায়ী কমিটির বেশ ক’টি পদে নতুন মুখ আসবে। সে ক্ষেত্রে ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হবে। স্থায়ী কমিটিতে নতুন জায়গা পেতে পারেন বলে যাদের নাম আলোচনায় আসছে তাদের মধ্যে রয়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুল্লাহ আল নোমান, সেলিমা রহমান, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক, আবদুল আউয়াল মিন্টু, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও শামসুজ্জামান দুদু। এদের মধ্যে কেউ কেউ খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদ রয়েছে ১৭টি। এর মধ্যে বর্তমান কমিটিতে ৩টি পদ শূন্য রয়েছে। আরও ক’জন স্থায়ী কমিটিতে স্থান পেয়ে গেলে যে কটি পদ খালি হবে সেখানে স্থান পেতে দলের বেশ ক’জন নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছেন বলে জানা গেছে। এবার ভাইস চেয়ারম্যান পদে নতুন যারা আসতে পারেন বলে আলোচনায় আছেন তারা হলেন, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, খায়রুল কবির খোকন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, মিজানুর রহমান মিনু, রুহুল কবির রিজভী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, বরকতউল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, অর্থনৈতিকবিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সালাম, মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস প্রমুখ। তারা ইতোমধ্যেই পদোন্নতির জন্য খালেদা জিয়া ও লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলে জানা গেছে। এবার যুগ্ম মহাসচিব পদ পেতে যারা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে শোনা যাচ্ছে তারা হলেন সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক এহসানুল হক মিলন, নাজিমউদ্দিন আলম, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবির খোকন, যুববিষয়ক সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আকবর খন্দকার খন্দকার, নজরুল ইসলাম মঞ্জু, সহ-প্রচার এমরান সালেহ প্রিন্স, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি প্রমুখ।
×