ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মালয়েশিয়ায় ১৫ লাখ কর্মী পাঠানোর স্মারক মন্ত্রিসভায় অনুমোদন

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

মালয়েশিয়ায় ১৫ লাখ কর্মী পাঠানোর স্মারক মন্ত্রিসভায় অনুমোদন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ তিন বছরে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে ১৫ লাখ কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে দেশটির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের অনুমতি দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এটি স্বাক্ষরিত হলে স্বল্প খরচে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো সম্ভব হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এই চুক্তির খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, দুই দেশের সম্মতিতে আগামী এক মাসের মধ্যে এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আগের বিটুবি (বিজনেস টু বিজনেস) এবং জিটুজি (গবর্নমেন্ট টু গবর্নমেন্ট) পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় এবার সরকারী- বেসরকারী পর্যায়ের সমন্বয়ে ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে কর্মী পাঠানো হবে। বাংলাদেশের বড় অর্জন হলো সোর্স কান্ট্রি (যেসব দেশে থেকে কর্মী নেবে) হিসেবে বাংলাদেশকে মালয়েশিয়া তালিকাভুক্ত করেছে। এর ফলে সেবা, উৎপাদন, নির্মাণ খাতে কর্মী পাঠানো যাবে। আগে এটা প্লানটেশনে সীমাবদ্ধ ছিল। এই চুক্তির আওতায় কাজ নিয়ে মালয়েশিয়ায় যেতে মাথাপিছু ৩৪ থেকে ৩৭ হাজার টাকা খরচ হবে এবং এই টাকা নিয়োগ কর্তাই বহন করবে বলে জানান তিনি। নতুন সমঝোতা স্মারক কার্যকর হলে ২০১২ সালে সই হওয়া সমঝোতা স্মারক ও ২০১৪ সালে স্বাক্ষরিত প্রটোকল বাতিল হয়ে যাবে বলেও জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল। বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির বড় বাজার মালয়েশিয়া। বর্তমানে প্রায় ছয় লাখ বাংলাদেশী সেখানে বিভিন্ন পেশায় রয়েছেন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০১৩ সালে জিটুজি পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নিতে শুরু করে মালয়েশিয়া। সে অনুযায়ী শুধু সরকারীভাবে মালয়েশিয়ার ‘প্ল্যান্টেশন’ খাতে শ্রমিক পাঠানো হচ্ছিল। কিন্তু ‘প্ল্যান্টেশন’ খাতে কাজ করতে আগ্রহীর সংখ্যা কম হওয়ায় ওই উদ্যোগে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। সে সময় প্রতি ছয় মাসে ৫০ হাজার শ্রমিক পাঠানোর লক্ষ্য ঠিক হলেও জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসেবে গত তিন বছরে পাঠানো হয়েছে মাত্র সাত হাজার শ্রমিক। এরপর জিটুজি পদ্ধতি সংস্কার করে এতে বেসরকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। একেই বলা হচ্ছে জিটুজি প্লাস। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সরকারী পর্যায়ে (জিটুজি) কর্মী পাঠানোর জন্য ইতোমধ্যে আগ্রহীদের যে তথ্যভা-ার তৈরি করা হয়েছে, সেখান থেকেই বাছাই করে বিটুবি’র মাধ্যমে শ্রমিক নেবে মালয়েশিয়া। প্রত্যেক শ্রমিককে তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হবে, এরপর তিনি আরও এক বছর কাজ করার সুযোগ পাবেন। এই প্রক্রিয়ায় দুই পক্ষের মধ্যে স্বচ্ছতার জন্য কিছু নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ার শুরুতে মালয়েশিয়া সরকার নিয়োগকর্তার সক্ষমতা ও চাহিদা যাচাই করে চাকরির সব সুবিধা নিশ্চিত করবে। তাতে মধ্যস্বত্বভোগীদের কোন সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। নতুন পদ্ধতিতে কর্মীদের বেতন কত হবে তা না জানালেও মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, কর্মীদের বেতন সরাসরি ব্যাংক এ্যাকাউন্টে পরিশোধ করা হবে। নিয়োগ কর্তৃপক্ষকে ঢাকায় মালয়েশিয়া হাইকমিশন থেকে সত্যায়িত হতে হবে। জিটুজি প্লাস প্রক্রিয়ায় মহিলা কর্মী নেয়ারও সুযোগ তৈরি হয়েছে জানিয়ে শফিউল বলেন, নিয়োগকর্তাই নিরাপত্তা জামানত, বায়োমেডিক্যাল ফি, ভিসা ফি, স্বাস্থ্য বিনিয়োগ, ক্ষতিপূরণ বীমাসহ সব কিছু নির্বাহ করবে। মালয়েশিয়া সরকার নিয়োগকর্তার কর্মী চাহিদা যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত কোটা নির্ধারণ করবে। নিয়োগকর্তারা প্রাপ্ত কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ দেবে। মালয়েশিয়া ওই প্রকৃত কোটার তথ্য অনলাইন সিস্টেমের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিএমইটির পোর্টালে পাঠাবে। আর বাংলাদেশ সরকার যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা মালয়েশিয়া সরকারের অনলাইন সিস্টেমে পাঠাবে জানিয়ে তিনি বলেন, ওই তালিকা থেকে রিক্রুটিং এজেন্সি নির্বাচন করা হবে। বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কর্মী সংগ্রহ, কর্মীদের বায়োমেডিক্যাল, নিরাপত্তা যাচাই, চুক্তি সম্পাদন, ভিসা প্রক্রিয়াকরণ এবং প্রশিক্ষণ ও বহির্গমন কাজে সহায়তা করবে বলে জানান শফিউল আলম। তিনি বলেন, রিক্রুটিং এজেন্সি আগের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত না হওয়ায় যথাযথ কাজ হয়নি। বায়রা ডাটা বেইজ থেকে কর্মী সংগ্রহ করবে। এজন্য তারা কিছু ফি পাবে। আশা করছি এবারের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও জবাবদিহিপূর্ণ হবে। এছাড়া মন্ত্রিসভার বৈঠকে মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটিকে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন আইনের খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পুনরায় মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। সূত্র জানায়, এর আগে গত ৯ নবেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনের জন্য জিটুজি প্লাস উত্থাপন করার কথা ছিল। মালয়েশিয়ার আপত্তির কারণে শেষ মুহূর্তে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। মালয়েশিয়ার শর্ত ছিল, কর্মী ব্যবস্থাপনার কাজ অবশ্যই মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে। এ শর্তের কারণে পিছিয়ে যায় জিটুজি প্লাস। তবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ার কোন শর্ত ছিল না। সমঝোতা স্মারকের খসড়ার বিভিন্ন দিক ভালভাবে যাচাই-বাছাই করতে সময় নেয় দুই দেশ। মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠান বা কোন নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কর্মী ব্যবস্থাপনার কাজ দেয়া হবে না। সূত্র জানায়, যেসব প্রতিষ্ঠানের অতীত রেকর্ড ভাল, তারা কাজ পাবে। সব রফতানিকারকই কর্মী পাঠানোর সুযোগ পাবে। গত বছরের জুনে মালয়েশিয়ান উপপ্রধানমন্ত্রী আহমেদ জাহিদ হামিদি বাংলাদেশ থেকে তিন বছরে ১৫ লাখ কর্মী নেয়ার ঘোষণা দেন। তবে দেশটির শ্রমিক সংগঠনগুলো প্রবাসী কর্মী নেয়ার বিরোধী। তাদের অভিযোগ, প্রবাসী কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতির দ্বার খুলেছেন মালয়েশিয়ান রাজনীতিবিদরা। দেশটির গণমাধ্যমের খবর, মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী কর্মী ব্যবস্থাপনার কাজ তার পারিবারিক প্রতিষ্ঠানকে দিতে চান। তিনি দাবি জানিয়ে বাংলাদেশের মন্ত্রীকে চিঠিও দিয়েছিলেন। বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। তিন বছর চেষ্টার পর মালয়েশিয়া কর্মী নিতে রাজি হয়। সরকারী ব্যবস্থাপনায় (জিটুজি) কর্মী পাঠাতে ২০১২ সালের ২৬ নবেম্বর দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়। জিটুজিতে মালয়েশিয়ান সরকারের চাহিদার ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার কর্মী পাঠাত। পাঁচ বছরে পাঁচ লাখ কর্মী পাঠানোর কথা থাকলেও ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে মাত্র নয় হাজার কর্মী নেয় মালয়েশিয়া। জিটুজির ব্যর্থতায় সাগর পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। গত বছরের এপ্রিলে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলে বাংলাদেশী এবং রোহিঙ্গাদের অর্ধশত গণকবর আবিষ্কৃত হয়। নিহতের সবাই সাগরপথে মানবপাচারের শিকার। হাজারো মানুষের মৃত্যুতে সারাবিশ্বে সমালোচনার ঢেউ ওঠে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মার্চ পর্যন্ত আগের ১৫ মাসে ৭৮ হাজার মানুষ সাগরপথে পাচার হয়েছে। তাদের অন্তত আট হাজার পথে নিহত হয়েছেন। সমালোচনার মুখে মালয়েশিয়া শ্রমবাজার উন্মুক্ত করার ঘোষণা দেয়। গত বছরের জুনে তৎকালীন প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের মালয়েশিয়া সফরের পর জানানো হয়, কর্মী পাঠানোর দায়িত্ব বেসরকারী খাতে (বিটুবি) ছেড়ে দেয়া হবে। মালয়েশিয়ান বেসরকারী নিয়োগকারীদের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানিকারকরা কর্মী পাঠাবেন। দুই মাস পর এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে দুই দেশ। গত আগস্টে মালয়েশিয়ান প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর শেষে জানানো হয়, বিটুবি নয়, সরকারী নিয়ন্ত্রণে বেসরকারী রফতানিকারকদের যুক্ত করে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে কর্মী পাঠানো হবে। সূত্র জানায়, জিটুজি পদ্ধতিতে শুধু বনায়ন খাতে (প্ল্যান্টেশন) কর্মী নিত মালয়েশিয়া। জিটুজি প্লাসে সেবা, নির্মাণ, কারখানা, কৃষি, বনায়নসহ মোট ১৫টি খাতে কর্মী পাঠানো হবে। এভাবে একজন কর্মী পাঠাতে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। জিটুজির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় ২০১২ সালে যেতে প্রায় ১৫ লাখ কর্মী নিবন্ধন করেন। সারাদেশে বিপুল সাড়া পড়ে। জিটুজির ব্যর্থতায় তাদের প্রায় ৯৯ ভাগই মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ পাননি। আগে যারা নিবন্ধন করেছেন, তাদের থেকেই কর্মী পাঠানো হবে। তবে নতুন করে নিবন্ধনের সুযোগ রয়েছে। প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৩০ হাজার ৪৮৩ কর্মী বৈধপথে মালয়েশিয়ায় কাজ করতে গেছেন। চলতি বছরের প্রথম মাসে গেছেন আরও সাড়ে ১২ হাজার কর্মী। জিটুজি প্লাস কার্যকর হলে এ সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। মালয়েশিয়ান সরকারের হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশী অবৈধভাবে বসবাস করছেন। বাংলাদেশীসহ সব অবৈধ অভিবাসীকে বৈধতা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে দেশটির সরকার।
×