ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বসন্ত, ভালবাসা ও শহীদ দিবস

যশোর ও ঝিনাইদহে চাষীদের লক্ষ্য ॥ ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি

প্রকাশিত: ০৪:১১, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

যশোর ও ঝিনাইদহে চাষীদের লক্ষ্য ॥ ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি

সাজেদ রহমান, যশোর অফিস ॥ বসন্ত উৎসব, বিশ্ব ভালবাসা দিবস এবং শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে মহাব্যস্ত সময় পার করছেন ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালির চাষীরা। ফুলের ক্ষেত থেকে সময়মতো পর্যাপ্ত ফুল পেতে গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত তারা। এবারের এ তিন দিবসে ১৫ কোটি ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তাদের। আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে গদখালির চাষীরা বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ফুল বাজারে সরবরাহ করবে। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, যশোর ঝিকরগাছা উপজেলার এ অঞ্চলের প্রায় ৫ হাজার কৃষক দেড় হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ করেছে। এবারের বসন্তবরণ, ভ্যালেন্টাইন ডে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে গদখালি এলাকার কৃষকরা ১৫ কোটি টাকার ফুল সরবরাহ করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, এ বছর রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভাল। আশা করছি কৃষকরা ফুলের ভাল দাম পাবেন। তবে এসএসসি পরীক্ষা ফুলের বাজারে কোন প্রভাব ফেলবে না বলেও তিনি জানান। ফুলের রাজ্য গদখালি পানিসারা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মাঠজুড়ে শুধু ফুল আর ফুল। সেখানে রং-বেরঙের জারবেরা, গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, হলুদ গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা ফুল হাতছানি দেয়। প্রায় প্রতিটি ক্ষেতেই চাষীরা গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত। চাষীদের সাথে কথা বলে জানা গেল- বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘিরে তাদের ব্যস্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা জানান, এ তিনটি উৎসবে সবচেয়ে বেশি ফুল বিক্রি হয়। পানিসারা গ্রামের ফুলচাষী ইসমাইল হোসেন বলেন, প্রায় চার বিঘা জমিতে জারবেরা, চন্দ্রমল্লিকা, গ্লাডিওলাস ও রজনীগন্ধা ফুল রয়েছে। বসন্তবরণ ও বিশ্ব ভালবাসা দিবসে ফুল সরবরাহ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছি। তিনি আরও বলেন, ফুলের ভরা মৌসুমে এসএসসি পরীক্ষা চলছে। তাই তুলনামূলক ফুলের চাহিদা কম। পরীক্ষা থাকলে সাধারণত পারিবারিক অনুষ্ঠান স্থগিত থাকে। এতে ফুলের চাহিদা কমে যায়। তবে এবার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভাল থাকায় আশায় আছি ফুলের দাম পাব। হাড়িয়া নিমতলা গ্রামের ফুলচাষী নাজির হোসেন বলেন, এক বিঘা গোলাপ ও দুই বিঘা গ্লাডিওলাস ফুলের আবাদ করেছি। বর্তমানে গোলাপ ৩ টাকা ও গ্লাডিওলাস ২-৪ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। পহেলা বৈশাখের আগে ফুলের দাম বাড়বে বলে মনে হয় না। তিনি বলেন, এক বিঘা গোলাপ রোপণে ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়। ৪ হাজার চারার দাম ৪০ হাজার টাকা। আর রোপণসহ অন্যান্য খরচ আরও ৪০ হাজার টাকা। এছাড়াও পরিচর্যার খরচ রয়েছে বাড়তি। একবার রোপণে ৬-৭ বছর পর্যন্ত গোলাপ ফুল পাওয়া যায় বলে তিনি জানান। এম রায়হান ঝিনাইদহ থেকে জানান, বসন্তবরণ, ভালবাসা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও নববর্ষের মতো দিনগুলোতে ফুলের অতিরিক্ত চাহিদা থাকে। আর এ চাহিদার সিংহভাগ যোগান দিয়ে থাকে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ফুলচাষীরা। যার কারণে দিন দিন কালীগঞ্জে ফুল চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে কালীগঞ্জ উপজেলার ১২টি গ্রামের ২৩৮ একর জমিতে এখন চাষ হচ্ছে গাঁদা, রজনীগন্ধ্যা, গ্লাডিওলাস, গোলাপসহ নানা জাতের ফুল। মাঠের পর মাঠ হলুদ গাদা ফুলের দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। বিশ্ব ভালবাসা দিবস উপলক্ষে এ জেলার ফুলচাষীরা কয়েক কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট নিয়েছেন এবার। এসব ফুল ক্ষেত থেকে সংগ্রহ ও মালা গাঁথা থেকে শুরু করে বিক্রি করা পর্যন্ত এ এলাকার মেয়েরা কাজ করে থাকেন। ফলে পুরুষের পাশাপাশি মেয়েদেরও কর্মসংস্থান হচ্ছে। এ এলাকার উৎপাদিত ফুল প্রতিদিন দূরপাল্লার পরিবহনে চলে যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে। জাতীয় ও বিশেষ দিনগুলো ছাড়াও সারাবছর এ অঞ্চলের উৎপাদিত ফুল সারাদেশের চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখে। কথা হয় জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ছোট্র গ্রাম ডুমুরতলার চাষী মশিয়ার রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ফুল চাষ দেখে তিনি কৃষি বিভাগের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে ২০ শতক জমিতে গাঁদা ফুল চাষ করেছেন। বাংলা আশ্বিন মাসে চারা গালানোর পর ৩৫ থেকে ৪৫ দিনের মাথায় ফুল এসেছে। গত এক সপ্তাহে তিনি ১০ হাজার টাকা ফুলও বিক্রি করেছেন। সার, কীটনাশক, পরিচর্যা বাবদ তার খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। এই ২০ শতক জমি থেকে তিনি ৫০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান। এতে তার লাভ থাকবে ৪০ হাজার টাকা। ফুলনগরী বলে খ্যাত বড়ঘিঘাটি গ্রামের ফুলকন্যা নাজমা, নুরজাহান, সরস্বতী ও আয়েশা বেগম জানান, বছরের বারো মাসই ফুল তোলার কাজ করেন তারা। কিন্তু বিশেষ বিশেষ দিন সামনে রেখে কাজ বেশি করতে হয়। আয়-উপার্জনও বেশি হয়। তারা জানান, এখন ভালবাসা দিবস উপলক্ষে সকাল বিকাল কাজ করতে হচ্ছে। ব্যাপারীরা ফুল নিতে ফুল মালিকের বাড়ি বসে থাকছে। যে কারণে সব কিছু রেখে সারাদিন ফুল তুলছেন তারা। তারা আরও জানান, প্রতি ঝোপা ফুল তুলে গেঁথে দিলে ফুল মালিক ১০ টাকা করে দেয়। প্রতিদিন তারা ১২ থেকে ১৮ ঝোপা ফুল তুলতে পারে। সরেজমিন বালিয়াডাঙ্গা বাজার ও কালীগঞ্জের মেন বাসস্ট্যান্ডে দেখা যায়, দুপুর থেকে শত শত কৃষক তাদের ক্ষেতের উৎপাদিত ফুল ভ্যান, স্কুটার ও ইঞ্জিনচালিত বিভিন্ন পরিবহন যোগে নিয়ে আসছে। বেলা গড়ার সাথে সাথে বালিয়াডাঙ্গা বাজার ও কালীগঞ্জ মেন বাসস্ট্যান্ড ভরে যায় লাল, সাদা আর হলুদ ফুলে। একাধিক ফুলচাষীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সারা বছরই তারা ফুল বিক্রি করে থাকে। তবে প্রতিবছর নববর্ষের দিন, স্বাধীনতা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ভালবাসা দিবস প্রভৃতি দিনগুলোতে ফুলের অতিরিক্ত চাহিদা থাকে। এ সময় দামও থাকে ভাল। ফুলচাষীরা নিজেরা না এসে সারা বছর তাদের ক্ষেতের ফুল চুক্তি মোতাবেক ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বড় বড় শহরের ফুলের আড়তে পাঠিয়ে দেয়। এ সকল স্থানের আড়তদাররা বিক্রির পর তাদের কমিশন রেখে বাকি টাকা পাঠিয়ে দেয়। ফলে ফুলচাষীদের টাকা খরচ করে ফুল বিক্রির জন্য কোথাও যেতে হয় না। তারা মোবাইল বা ফোনালাপের মাধ্যমে বাজার দর ঠিকঠাক করে ফুল পাঠিয়ে থাকে বলেও জানান কৃষকরা। বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের ফুলচাষী সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক জানান, ১৯৯১ সালে এ এলাকায় সর্বপ্রথম ফুল চাষ করেন ছব্দুল শেখ। তিনি ওই বছর মাত্র ১৭ শতক জমিতে ফুল চাষ করে স্থানীয় বিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠান ও জাতীয় দিবসগুলোতে ক্ষেত থেকেই বিক্রি করে ৩৪ হাজার টাকা লাভ করেছিলেন।
×