ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদিতে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ- যৌন নির্যাতনের শিকার অনেক নারী

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সৌদিতে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ- যৌন নির্যাতনের শিকার অনেক নারী

ফিরোজ মান্না ॥ নিজের ভাগ্য ও পরিবারের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য মমতাজ বেগম সৌদি পাড়ি জমিয়েছিলেন। কিন্তু মমতাজের ভাগ্যের চাকা সামনের দিকে ঘোরেনি, সেই চাকা উল্টো দিকেই ঘুরছে। তিনি আরও বেশি বিপদসঙ্কুল অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। রংপুর শহরের বাহারকাতের পাড়ার মৃত বাবা জহুরুল হকের পাঁচ ছেলে মেয়ের মধ্যে মমতাজ সবার ছোট। বিয়েও হয়নি তার। পরিবারের অসচ্ছলতা দূর করার জন্য গত ২২ সেপ্টেম্বর সরকারী ব্যবস্থাপনায় সৌদি যান। সেখানে তিনি চাকরির বদলে পেয়েছিলেন শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন। এই বর্বরতার বর্ণনা তিনি সেখান থেকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। তবে মালিকের বাড়ি থেকে পালিয়ে বাঙালী এক পুরুষ কর্মীর সহযোগিতায় বাংলাদেশ দূতাবাসে যেতে পেরেছিলেন। সেখান থেকে তিনি বাড়িতে যোগাযোগ করেন। এরপর অনেক চড়াইউতরাই পার করে সম্প্রতি তিনি দেশে ফিরেছেন। বন্দী জীবন থেকে মুক্ত মমতাজ দেশে ফিরে প্রবাসী কল্যাণ ভবনে অভিযোগ জানাতে এসেছিলেন। সেখানেই তার সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ফেলছিলেন। মমতাজ বলেন, তিনি যখন ঢাকা থেকে সৌদি আরবে যান-তখন তাকে ‘জেদ্দা সাইট’ নামের একটি ভবনে তোলা হয়। সেখানে মমতাজ দেখেন তার আগেই প্রায় চার হাজারের বেশি বাংলাদেশী নারীও সেখানে আটক রয়েছেন। প্রথম দিন তার ভালই কেটেছে। সৌদি কোন পুরুষ তাকে কিছু বলেনি। তবে অন্যদের বেলায় নানা আপত্তিকর দৃশ্য দেখে তিনি আঁতকে উঠেন। অন্য নারীদের কাছে তিনি বন্দীশালায় প্রতিদিন কি ঘটে তা জানতে চান। যখন একের পর এক নিপীড়ন নির্যাতন ও যৌনতার কাহিনী শোনেন তখন তিনি দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলে কি হবে। দেশটা তো সৌদি আরব সেখান থেকে আসতে হলে তাকে ইমিগ্রেশন পার হয়ে উড়োজাহাজে উঠতে হবে। সেটা তো আর চাইলেই পারবেন না। মনে মনে এই সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই বিকেল বেলায় কয়েকজন সৌদি পুরুষ এসে তাকে মালিকের বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। যেতে অস্বীকার করলে অত্যাচার শুরু করে। জোর করে তাকে সেখান থেকে অনেক দূরে এক মালিকের বাড়িতে নিয়ে যায়। প্রথম দিন বাড়ির কাজ কর্ম বুঝিয়ে দেয়। রাতে শোয়ার জন্য একটা ঘর দেয়া হয়। সেই ঘরে কোন দরোজা নেই। খোলা ঘর। মালিকের দুই ছেলে এবং মালিক নিজে দিন রাতে পালাক্রমে আসেন। ‘সারারাত ঘুমাতে পারিনি। সে এক ভয়াবহ রাত। তখন নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য হাতের কাছে তেমন কোন কিছু পাইনি। পেলে হয়তো ওই রাতটাই আমার জীবনের শেষ রাত হতো। পরের দিন অনেক কৌশলে ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। আমার মতো আর কয়েকজন নারী নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কৌশলে পালিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে চলে আসেন। পরে দূতাবাসের সহযোগিতায় আমরা এক সঙ্গেই দেশে ফিরেছি।’ মমতাজের মতো গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর সাদুহাটি গ্রামের মরহুম ফিরোজ আহমেদের মেয়ে শাহিনা ইয়াসমিন সংসারের সচ্ছলতা আনতে গৃহকর্মীর ভিসায় সৌদিতে গিয়েছিলেন। তাকেও এমন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে শাহিনাসহ ১৩ নারী কর্মী দেশে ফিরে এসেছেন। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্র জানিয়েছে, ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সালের নবেম্বর পর্যন্ত তিন লাখ ৪৩ হাজার ৮৪৫ জন নারী কর্মী বিদেশে গেছেন। এর মধ্য সবচেয়ে বেশি গেছেন লেবাননে, যার সংখ্যা ৮৯ হাজার ৮৮১ জন। ২০১৪ সালে মোট কর্মীর প্রায় ৮৪ শতাংশ গেছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে এ হার ১৮ শতাংশ। নারী কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, বিদেশের মাটিতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ নারী কর্মী কাজ করলেও তাদের সমস্যা এবং সহযোগিতার জন্য নেই কোন শেল্টার হোম, দ্রুত সহযোগিতা পাওয়ার জন্য নেই হটলাইন। অনেক দেশেই নারীকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে সহযোগিতা চাইলেও পাচ্ছেন না। নারী কর্মীদের তাৎক্ষণিক সহযোগিতার জন্য সরকারের উচিত দ্রুত হটলাইন এবং শেল্টার হোম খোলার উদ্যোগ নেয়া। কারণ, বিদেশে নারী কর্মীর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, সেই সঙ্গে প্রবাসে নারী কর্মীর সমস্যাও বাড়ছে। বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে গৃহকর্মী নেয়ার জন্য চুক্তি হয়েছিল গত বছর। সৌদি সরকার দুই লাখের বেশি নারীকর্মীর চাহিদা জানালে বাংলাদেশ থেকে মাসে দশ হাজার নারীকর্মী পাঠানোর কথা বলা হয়েছিল। অথচ ২০১৫ সালের হিসেবে মাত্র ২০ হাজার ৯শ’ ৫২ জন নারী সৌদি আরবে গিয়েছেন। সৌদি সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশকে জানিয়েছে, তাদের কাছে এখন দুই লাখ নারীর জন্য ভিসা প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু গৃহকর্মী হিসেবে বাংলাদেশী নারীদের সৌদি আরবে যাওয়ার আগ্রহ খুবই কম। চুক্তির এক বছরে চাহিদার দশ ভাগের একভাগ নারী বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে গেছেন। কাজ করতে যাবার অল্প দিনের মধ্যে আবার নারীদের ফেরত আসার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। ঢাকায় সৌদি একটি নিয়োগকারী সংস্থা আল শারক’র ব্যবস্থাপক বলেন, বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি নারীকর্মী সৌদি আরবে দরকার। গত একবছরে আমরা মাত্র দেড় শ’ জনের মতো নারী নিয়োগ দিতে পেরেছি। বাংলাদেশী গৃহপরিচারিকা আমাদের জনগণের পছন্দ কারণ তারা মুসলিম এবং কাজে বেশ ভাল। গৃহকর্তাদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলছেন অনেকে। ২০১৫ সালে যারা সৌদি আরব গেছেন তাদের মধ্য থেকেও বেশ কিছু নারী দেশে ফিরে এসেছেন। ঋণ করে সৌদিতে কাজে গিয়ে এক মাস থেকেই ফেরত আসা একজন বলছিলেন তার স্বপ্নভঙ্গের কথা। দেশে ফিরে ওই নারী বলেন, দশ পনের দিন ভালই ছিলাম। কিন্তু আমারে বাড়িতে ফোন করতে দেয় না, বাড়ির বাইরেও যাইতে দেয় না। তবে যে অভিযোগে তিনি দেশে ফিরেছেন সেটি আরও বেশি ভয়াবহ। বলছিলেন, আমি সারাদিন কামকাজ করি, পরে যখন রাইতে ঘুমাইতে যামু তার আগে কাপড় ইস্ত্রি করি, ওই সময় উনি (বাড়ির মালিক) আমার ঘরে গিয়া ডিস্টার্ব করত। আমার রুমে ও ঘুমাইব। আমি রাজি হইনি, তারপরও জোর করে থাকতে চায়। আমার কথা শুনত না, পরে আমি ওর বউরে ডাক দিয়া সব কইলাম। পরে কৌশলে অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশে ফেরত আসেন তিনি। ‘আমিতো দেহ ব্যবসা করতে যাই নাই। আমিতো গেছি কামের জন্য, কাম করমু, ভাত খামু, পয়সা ইনকাম কইরা পোলাপান মানুষ করমু। কষ্টের লাইগা গেছি। তিন মাস কাজ করে ফিরে এসেছেন রূপগঞ্জের রহিমা। তার অভিযোগ সেখানে অতিরিক্ত কাজের চাপ।’ রহিমা বলেন, কাজের নির্যাতনে পইরা গেসিগা, সময়তে ওরা ভাল ব্যবহার করত সময়তে খারাপ ব্যবহার করত। অসুস্থ হইয়া কাম করতে পারি না হেরপরও জোর কইরা করাইত। সইতে না পাইরা আমি কইছি মা আমি বাংলাদেশে যামুগা। ফেরত আসা নারীদের এসব অভিজ্ঞতাও অনেক ক্ষেত্রে সৌদি আরবে নারী কর্মী কম যাওয়ার একটি কারণ বলে মনে করা হয়। সম্প্রতি বিবিসি এমন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিবিসির প্রতিবেদনে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব কাজী আবুল কালামের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, সৌদিতে নারীরা যেখানে যায় কোন পরিবার ভাল আবার কোন পরিবার খারাপও হতে পারে। রিয়াদে দূতাবাস আছে এবং জেদ্দায় কনস্যুলেট আছে। রিয়াদে সাময়িক শেল্টার হাউসও আছে। সেখানে থেকে সে তার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে পারবে এবং দূতাবাস তাকে সাহায্য করবে। এছাড়া যদি নির্যাতনের বিষয়টি খুব গভীরতর হয় সে শ্রম আদালতে মামলা করবে। সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা অনেকে যৌন হয়রানির অভিযোগ করছেন। এ বিষয়ে দূতাবাস তাকে সহায়তা করে। নিরাপত্তা বা তার সমস্যা সমাধান করার মতো ব্যবস্থা যে একেবারে নেই তা না। আছে তবে এটা আমাদের কর্মীদের জানতে হবে বুঝতে হবে এবং সেটার সুযোগও নিতে হবে। সৌদি আরবে প্রায় ১৩ লাখ বাংলাদেশী বিভিন্ন পেশায় কর্মরত রয়েছেন। সাত বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৫ সালে নারীকর্মী পাঠানোর মধ্য দিয়ে সৌদি আরবে বাংলাদেশী জনশক্তি রফতানির বাজার পুনরায় উন্মুক্ত হয়। সৌদি আরবে যাবার ক্ষেত্রে নারীকর্মীদের সমস্ত খরচ বহন করে সৌদি নিয়োগকারী সংস্থা। নারীদের আকৃষ্ট করতে সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে বিনা খরচে এক মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া নারীকর্মীদের বিদেশে পাঠানোর আগে স্বল্প খরচে বাংলাদেশে সরকারী ২৬টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আরবি ভাষা, গৃহস্থালীর কাজকর্ম এবং সৌদি নিয়ম-কানুন শেখানো হচ্ছে।
×