ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দিনভর নাটকীয়তার পর অবশেষে নিজ হাতে লেখা রায় জমা দিতে পারছেন বিচারপতি মানিক

অবসরে রায় লেখা যাবে না- বিতর্কে সিনহা অনড়

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

অবসরে রায় লেখা যাবে না- বিতর্কে সিনহা অনড়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দিনভর নানা নাটকীয়তার পর অবশেষে অবসরের পর নিজের হাতে লেখা রায় জমা দেয়ার সম্মতি পেয়েছেন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। রবিবার রাতে তিনি জনকণ্ঠকে এ কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তার লেখা রায় ও আদেশ গ্রহণ করতে আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহহাব মিঞা রাজি হয়েছেন। রবিবার সন্ধ্যায় বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞার সঙ্গে দেখা করার পর নিয়ম অনুযায়ী রায়গুলো জমা দেয়ার জন্য বলেছেন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত আপীল বিভাগের যে বেঞ্চের বিচারক ছিলেন বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহহাব মিঞা সেই বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারক (প্রিসাইডিং জাজ) ছিলেন। এর আগে রবিবার সকালে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী অভিযোগ করেছিলেন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা রায় লিখতে পারবেন না, প্রধান বিচারপতির এমন নির্দেশনার পর বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞা তার লেখা রায় গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে অবসরের পর তার লেখা ১৫টির মতো রায় এবং আদেশগুলো নিতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে চিঠি দেয়ার কথাও জানিয়েছিলেন বিচারপতি মানিক। সেইসঙ্গে প্রধান বিচারপতির আচরণকে সংবিধানপরিপন্থীও বলেন তিনি। চিঠি পাঠানো এবং রায় না নেয়ার অভিযোগ তুলে ধরে বিচারপতি শামসুদ্দিন সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার পর রবিবার বিকেলে সুপ্রীমকোর্টের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয় গণমাধ্যমে। সুপ্রীমকোর্টের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ দিলজার হোসেন স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে প্রধান বিচারপতি চার মাস আগে অবসরে যাওয়া বিচারপতি মানিককে রায় নিয়ে গণমাধ্যমে কথা না বলার পরামর্শ দেন। পাশাপাশি তার কাছে থাকা ‘অনিষ্পত্তিকৃত’ রায়ের মামলার ফাইলগুলো সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের অফিসে জমা দেবেন বলেও প্রত্যাশা করেন প্রধান বিচারপতি। এ প্রসঙ্গে রাতে বিচারপতি মানিক বলেন, আমি সুপ্রীমকোর্টে কোন সংবাদ সম্মেলন করিনি। আমার দেয়া চিঠির বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছে আমি তারই উত্তর দিয়েছি। আর সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ে ফাইল ফেরত দেয়ার কোন প্রশ্নই আসে না, কারণ প্রধান বিচারপতির এ ধরনের সিদ্ধান্ত সংবিধানপরিপন্থী বলে মন্তব্য করেন বিচারপতি মানিক। বিচারপতি শামসুদ্দিনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রীমকোর্টের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘প্রধান বিচারপতি সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহহাব মিঞার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি প্রধান বিচারপতিকে অবহিত করেন যে সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী তার কাছে লিখিত রায় কিংবা আদেশ গ্রহণ করার জন্য জমা দেননি।’ পরে রাতে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী জানান, তিনি তার হাতে লেখা রায়গুলোই জমা দিতে পারছেন। তিনি বলেন, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞার সঙ্গে আগে মৌখিক কথা হয়েছিল, রায় ও আদেশ গ্রহণ করা নিয়ে, তখন বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। তাই এগুলো জমা দেয়ার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারেনি। এখন আমার প্রিসাডিং জাজ বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহহাব মিঞার রায়গুলো যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী জমা দেয়ার জন্য বলেছেন। আমি তাই করব। বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক বলেন, অবসরের পর আমার ১৫টির মতো রায় লেখার বাকি ছিল, সেই সঙ্গে ছিল ৭০টির মতো আদেশ। সবই লেখা ইতোমধ্যে শেষ করেছি। রায় লেখার জন্য প্রয়োজনীয় স্টাফ প্রত্যাহার করে নেয়ায় রায়গুলো হাতেই লিখতে হয়েছে বলে জানান তিনি। একই সঙ্গে তিনি যে সকল মামলায় শুনানি গ্রহণ করেছেন ওই সব মামলার রায়ে তার স্বাক্ষর না থাকলে ওইগুলো রায়ই হবে বলেও মন্তব্য বিচারপতি মানিকের। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি সুপ্রীমকোর্টের দীর্ঘদিনের প্রথা ভঙ্গ করে অবসরের পর বিচারপতিদের রায় লেখার ওপর বাধা সৃষ্টি করছেন, যা সংবিধানপরিপন্থী। অবসরের পর রায় লেখা অসাংবিধানিক বলে প্রধান বিচারপতি যে বক্তব্য দিয়েছেন, সে বিষয়ে জাতীয় সংসদেও আলোচনা হয়েছে। দেশের প্রখ্যাত আইনজ্ঞরাও তার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন। তার এ ধরনের কর্মকা-ের মাধ্যমে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন বিচারপতি মানিক। প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিজের দায়িত্ব নেয়ার এক বছর পূর্তিতে গত ১৭ জানুয়ারি এক বাণীতে বিচারপতি সিনহা বলেন, অবসরে যাওয়ার পর বিচারকদের রায় লেখা ‘সংবিধানপরিপন্থী’। তার যুক্তি, বিচারপতিরা অবসরে যাওয়ার পর তাদের শপথের কার্যকারিতা থাকে না বলে তারা রায় লেখার অধিকারও হারান। ওই ‘ভুল’ আর করতে দেবেন না বলেও পরে আরেক অনুষ্ঠানে জানান প্রধান বিচারপতি। তার ওই বক্তব্যে বিএনপি নেতাদের পাশাপাশি তাদের সমর্থক আইনজীবীরা জোর সমর্থন দিয়ে বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের রায়ও ‘অবৈধ’ প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মনে করেন, ন্যায়বিচার পাওয়ার ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে ওই বক্তব্য এসেছে প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে। তবে ঘোষিত রায় পরে লেখা বেআইনী মনে করছেন না তিনি। বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদও বলেছেন, বিচারপতিদের অবসরের পর রায় লেখার দীর্ঘদিনের এই চর্চায় কোন সমস্যা তারা দেখেন না। জাতীয় সংসদেও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই আলোচনার মধ্যেই গত ২৯ জানুয়ারি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাতে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও ছিলেন। তবে ওই বৈঠকের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য আসেনি। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ওই বৈঠকে মীমাংসিত বিষয় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে প্রধান বিচারপতিকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে আলোচিত বেশ কয়েকটি মামলার বিচারক এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ২০০১ সালের জুলাই মাসে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে দুই বছরের মেয়াদ শেষে স্থায়ী নিয়োগ দেয়া হয়নি তাকে। এর বিরুদ্ধে আইনী লড়াইয়ের পর ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ তিনি হাইকোর্টে স্থায়ী হন। ২০১৩ সালের ৩০ মার্চ আপীল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী। গত বছর ১ অক্টোবর অবসরে যান তিনি।
×