ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দেশ-বিদেশের বইমেলা ফিরিয়ে নাও ঘাতককাঁটা -অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ০৩:২৯, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

দেশ-বিদেশের বইমেলা ফিরিয়ে নাও ঘাতককাঁটা   -অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ এখন দুনিয়ার অনেক দেশে বাংলা বইমেলা হয়। বাঙালী যখন যেখানে থাকে তার সঙ্গে থাকে একটুকরো বাংলাদেশ। দেশের ভেতর যারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্য দলে বিভক্ত বিদেশে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গড়ে তোলে শহীদ মিনার। তাদের পরিশ্রমে বেড়ে ওঠে বইমেলা। আমাদের এই সিডনিতে একুশে একাডেমি যে মিনারটি স্থাপন করেছে তা এখন মহীরুহ। সে যে কত কাজে লাগে আমাদের। দেশে যখনই কোন সমস্যা হয় বা কোন ধরনের বিপাকে পড়ি আমরা ওখানে ছুটে যাই। একদল পরিশ্রমী মানুষের আত্মবেদন আর কঠোর শ্রমে গড়ে ওঠা স্মৃতিসৌধ তথা মিনারটি নিয়ে কিছু ঝঞ্ঝাট থাকলেও সেটা ব্যক্তিগত। এটা আমাদের স্বভাব। আমরা কাউকে যেন তার প্রাপ্য দিতে জানি না, তেমনি কাউকে নিজের কাজের শরিকও করতে পারি না। সে ঝামেলা সংগঠনের। আমরা আছি মিনারের ছায়ায়। বিশেষত যারা তরুণ-তরুণী বা শিশু তাদের গল্প বলে বশ করার দিন নেই আর। এখন তারা অনেক বুদ্ধিমান আর বুদ্ধিমতী। তাদের করে দেখাতে হয়। এই শহীদ মিনারটি ঘিরে তাদের কৌতূহল আর আগ্রহ এদেশে আমাদের প্রজন্মকে পথভ্রষ্ট হতে দেবে না। এখানে একটা ছোটখাটো বইমেলাও হয়। যতবার আমি সেখানে যাই আমার স্মৃতি ও সত্তায় ভেসে ওঠে এক অনুপম বাংলাদেশ। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি মানুষ ডলারের রোজগার ফেলে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে। হাতে হাতে বই নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। যতটা সম্ভব বাংলাদেশের আদলে সবকিছু রাখার এক আপ্রাণ চেষ্টা আমার মতো অনেককেই আশান্বিত করে তোলে। এটাই তো হওয়া উচিত। এখানে হাটে-মাঠে-ঘাটে নানা দেশের নানা ভাষার পুস্তকের ছড়াছড়ি। আপনি যে ভাষার বই চান তাই পাবেন। সেগুলোকে জড়ো করে বহুজাতিক সাজার দরকার পড়ে না। আমরা বহুজাতিক সমাজের একটা অংশ হিসেবেই বাস করি। ফলে আইডেনটিটি বা সত্তার দিকটাই জরুরী। যে কারণে আমি চাই এই মেলার অবয়বে আসুক আরও বেশি বাঙালিয়ানা। আমাদের দেশের নবীন প্রবীণ লেখকদের আরও বই আসুক এসব মেলায়। রাজশেখর বসু, সুনীল বা হুমায়ূন তো থাকবেনই আমরা কি নবীনদের জানব না? জানব না তারা কিভাবে দেশ ও বিদেশের এলাকাকে আত্মস্থ করছেন? কিন্তু তাদের খুব একটা দেখা যায় না। বাণিজ্য ও বিপণনের কারণে তারা প্রায় নেই। উল্টোদিকে দেশের মেলাটি হওয়া উচিত বহুমুখী। তাতে বিপুল পরিমাণে বিদেশী বই পুস্তক ও অনুবাদের জোয়ার থাকলে এ জাতি ও তার তারুণ্য অভিশাপমুক্ত হতে পারবে। বিজ্ঞান ও আবিষ্কারের লেখা সৌরজগতের লেখা অঙ্কের লেখা মিডিয়ার ওপর লেখা আত্মজীবনী বা মানুষের উদ্ভাসের বই যত বেরুবে যত থাকবে তত আমরা আলোকিত হব। এটা বুঝি তরুণ-তরুণীরা এখানে নিজেদের প্রথম তুলে ধরতে আসে। সে কারণে কবিতা বা গদ্য বইয়ের ছড়াছড়ি। থাক সেও থাক। কিন্তু পাশাপাশি আমাদের জানতে দিন কেন ছোট ছোট দেশে যেখানে কোনদিন ভাষা নিয়ে সংগ্রাম বা বিপ্লব হয়নি অথচ পরাধীন ছিল তারা কিভাবে জীবনের সব বিষয়ে মাতৃভাষায় বই পুস্তক প্রকাশ করতে পারছে। এত ছোট ছোট দেশ আছে যাদের মোট জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আমাদের কোন শহরের চেয়েও কম তারাও তা পারল কিভাবে? আর আমরা বরকত সালাম রফিক জব্বারের রক্তের গৌরবে বলীয়ান হওয়ার পরও জীবনের বহু বিষয়ে বাংলাহীন। এটা আর যাই হোক প্রগতি হতে পারে না। যারা আমাদের দেশের বইমেলাটির আয়োজক তাদের হাতে বাংলাভাষার গৌরব ও ভবিষ্যত নির্ভর করে। কিছুটা তো বটেই। তাদের দায় বা দায়িত্ব কেবল তাঁবু খাটিয়ে কিছু প্রকাশনাকে জায়গা করে দেয়া নয়। আজকের বাংলাদেশে এক ধরনের অন্ধকার ঘনীভূত। আমরা মাঝে মাঝে ভাঙ্গা হারমোনিয়াম তবলা সরোদে তার প্রমাণ পাই। প্রমাণ দেখি মানুষের আক্রোশে। এদের সাইজ করতে হলে এসব কাজ করতে হবে। দেশের মেলাটি আমাদের প্রাণভোমরা। এই সেদিনও আমরা বিদেশ থেকে ছুটে যেতাম আনন্দে আর শঙ্কাহীন চিত্তে। এই মেলায় দাঁড়িয়ে রাতের রেখা ঘন করে বাড়ি ফিরেছি সেদিনও। তখন আমরা কোন সময় ভাবিনি বের হলেই চাপাতি হাতে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। রুটি বাসি ডাল ধুলো গরম কফি আর আনন্দ আড্ডাকে লাল করে দেয়ার মতো রক্তধারা কোনদিন দেখিনি আমরা। আজ যে কারণেই হোক সবাই কমবেশি শঙ্কিত। পুলিশ বা বাহিনী দিয়ে এর প্রতিকার অসম্ভব। চাই মানুষের সংযোগ। মনটা খারাপ হয় এ কারণে বাইরের মেলা পরিপাটি সাজানো তকতকে। তার সবকিছুতে বেশি বেশি সজ্জা আর নৈপুণ্য। যে মেলা আমার মায়ের মতো যে মেলায় আমাদের শৈশব কৈশোর যৌবনের কাদার দাগ যে মাটিতে আমাদের বীজ তার বাইরে ভয় আর ঘাতক থাকে দাঁড়িয়ে। আমরা এর অবসান চাই। দেশ-বিদেশের বাঙালী ও বইমেলা হোক আনন্দমুখর নির্বিঘœ। রাজনীতি যেন তাতে থাবা বসাতে না পারে।
×