হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ প্রতিবছরই বাড়ছে বার্ষিক উন্নয়ন কমসূচী (এডিপি) আকার। যা এখন দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ১ লাখ কোটি টাকার ওপরে। কিন্তু বাস্তবায়ন রয়েছে সেই তিমিরেই। প্রস্তুতিতেই চলে যায় উন্নয়ন প্রকল্পের একটি বড় সময়। কোন কোন ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়ায় শুরুর দিকের কার্যক্রমগুলো, এমনকি প্রকল্পই বাস্তবায়ন হয় না শেষ পর্যন্ত। সমস্যা উদ্ঘাটন হয়েছিল আগেই। কিন্তু সমাধানের কোন উদ্যোগ ছিল না। এতদিন পর এ সমস্যা সমাধানের একটি সৃজনশীল উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছে। গঠন করা হচ্ছে প্রজেক্ট প্রিপারেটরী ফান্ড। এছাড়া এই ফান্ড থেকে অর্থ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রস্তাব মূল্যায়ন ও সুপারিশের জন্য একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। এতে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাক্কলিত ব্যয়ের সমপরিমাণ বরাদ্দ এবং নক্সা তৈরির জন্য এক কোটি টাকা পর্যন্ত নেয়া যাবে এই ফান্ড থেকে, এমনই প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে গতিশীলতা আনতে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে কাঠামোগত এবং পদ্ধতিগত পরিবর্তনসংক্রান্ত বৈঠকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আগামীকাল সোমবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এতে পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল এবং অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী
এমএ মান্নান উপস্থিত থাকবেন।
প্রজেক্ট প্রিপারেটরী ফান্ড বিষয়ে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, উদ্যোগটি ভাল, কিন্তু কথা হলো সমস্যার গোড়াতে হাত দিতে হবে। তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নক্সা সম্পর্কিত সমস্যা দেখা দেয়, সেই সমস্যার সমাধান অর্থ যোগান দিলেই যে হয়ে যাবে সে নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়। তবে এক্ষেত্রে দক্ষ মানুষদের দিয়ে তৈরি করা যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন কারণে তাড়াতাড়ি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে এডিপিতে যুক্ত করার একটা প্রচেষ্টা থাকে। এই প্রবণতা রোধ করতে হবে। তাছাড়া এই ফান্ডে দুর্নীতি মুক্ত ও স্বচ্ছ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সূত্র জানায়, এর আগে মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ফাস্ট ট্রাক প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় প্রজেক্ট প্রিপারেটরী ফান্ড গঠনের। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠনো হয় ইআরডিতে। পরবর্তীতে ইআরডি তৈরি করেছে প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পাদনের জন্য বাজেট অনুমোদন,বরাদ্দ, ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত নীতি ও পদ্ধতির প্রাথমিক ধারণাপত্র তৈরি করেছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, এডিপির আকার বাড়ছে প্রতি অর্থবছরই। কিন্তু মাঝপথে আবার বরাদ্দ ছেঁটে দিয়ে করতে হয় সংশোধন। তারপরও শতভাগ বাস্তবায়ন হয় না। তাই শুধু টাকার অঙ্কেই নয়, প্রকৃত বাস্তবায়ন বাড়াতে এবার ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে গঠন করা হচ্ছে প্রজেক্ট প্রিপারেটরী ফান্ড। আশা করা হচ্ছে এই ফান্ডের অর্থের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পে গতি আসবে।
সূত্র জানায়, আগামী সোমবার বৈঠকে উপস্থাপন হতে যাওয়া ইআরডির প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পাদনের জন্য বাজেট অনুমোদন, বরাদ্দ, ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নীতি ও পদ্ধতির প্রাথমিক ধারণপত্রে পাঁচটি ধাপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং এসব ধাপের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, প্রথমত, যেসব খাতের জন্য এ ফান্ড প্রযোজ্য হবে। এ অংশে বলা হয়েছে বিনিয়োগ প্রকল্পের প্রাক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, অর্থনৈতিক সমীক্ষা, কারিগরি সমীক্ষা ইত্যাদি সমীক্ষা বা স্টাডির ক্ষেত্রে। প্রকল্পের দলিল (ডিপিপি/টিপিপি) প্রণয়ন ও সংশ্লিষ্ট আনুষঙ্গিক কাজসমূহ। প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রয়োজন থাকলে তার নক্সা, পরিমাণ এবং ভূমি অধিগ্রহণ। পূর্ত কাজের নকসা প্রণয়ন। পণ্য/কার্য বা সেতা ক্রয়ের জন্য টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি এবং প্রক্রিয়াকরণ এবং প্রকল্প অনুমোদনপূর্ব অন্তর্বর্তীকালীন প্রকল্প টিমের অফিস পরিচালনা ব্যয়।
দ্বিতীয়ত, উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয় বা বিভাগ, সরকারী সংস্থা, দফতর, পরিদপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং প্রকল্পের ক্ষেত্রে মধ্যমেয়াদী বাজেট কাঠামো (এমটিবিএফ) অথবা এডিপি বা সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দহীনভাবে অননুমোদিত প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত প্রকল্প।
তৃতীয়ত, অর্থের সর্বোচ্চ পরিমাণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ভূমি অধিগ্রহণের ব্যয় ছাড়া প্রকল্পের অন্যান্য প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য ১ কোটি টাকা। তবে বিশেষক্ষেত্রে এ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাক্কলিত ব্যয়ের সমপরিমাণ বরাদ্দ।
চতুর্থত, প্রস্তুতিমূলক কাজের মেয়াদের অংশে বলা হয়েছে, ভূমি অধিগ্রহণের ব্যয় ছাড়া সরকারী তহবিলের অর্থায়নের প্রকল্পের অন্যান্য প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য সর্বোচ্চ এক বছর এবং বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের জন্য দেড় বছর এবং ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কাজ থাকলে সেক্ষেত্রে দেড় বছর সময় পাবে।
পঞ্চমত, অর্থায়ন প্রস্তাব অনুমোদন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, আবেদন দাখিলের নিয়ম হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক কাজের উদ্দেশ্য, মেয়াদ, বাজেট, সুনির্দিষ্ট আউটপুট প্রকল্প সাহায্যপ্রাপ্তির সম্ভাব্য উৎস ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্যসহ নির্দিষ্ট ফরমেটে অর্থায়ন অনুমোদনের আবেদন করতে হবে। তাছাড়া ব্যয়ের খাত এবং সময়ভিত্তিক (মাসিক) পরিকল্পনার বিস্তারিত বিবরণ দাখিল করতে হবে। তবে ভূমি অধিগ্রহণ ব্যতীত অন্য কোন মূলধনী প্রকৃতির ব্যয় এ কাজের অন্তর্ভুক্ত থাকবে না। অর্থবিভাগে আবেদন প্রেরণ করতে হবে।
প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, নীতিমালা অনুযায়ী প্রস্তাব মূল্যায়ন ও সুপারিশের জন্য অর্থ বিভাগে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। ওই কমিটিতে উদ্যোগী মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট সেক্টর বিভাগ, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা থাকতে পারেন।
এর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, আমাদের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সরকারী ব্যয়ের বিদ্যমান শ্রেণী বিন্যাসকরণ, কাঠামোর সংশোধন এবং তার সফল বাস্তবায়ন। সময়ের পরিক্রমায় উৎপাদন প্রযুক্তি ও পণ্যের চাহিদায় পরিবর্তন আসে। ফলে অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বিদ্যমান ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি প্রচলিত বিধিবিধান ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোরও সংস্কার প্রয়োজন। বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন সংস্কার করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছর ৯৭ হাজার কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন করে সরকার। এর বাইরে বিভিন্ন সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে আরও ৩ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় উন্নয়ন খাতে। সব মিলে এডিপির আকার এক লাখ ৯৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্থবছরের ছয় মাসে ব্যয় হয়েছে মাত্র ২৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ২৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। আর ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যয় হয়েছিল ১৮ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যেই এডিপি কাট-ছাঁটের প্রক্রিয়া এগিয়ে গেছে অনেক দূর।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২৪ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৮ শতাংশ। শতাংশের হিসাবে তিন বছরের মধ্যে চলতি অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়ন সর্বনিম্ন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন,পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে (আইএমইডি) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে আইএমইডি সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার জনকণ্ঠকে বলেন, এডিপির বাস্তবায়ন সবসময়ই প্রথম দিকে কম হয়। তাছাড়া এই সময়ের মধ্যে অনেক কাজ হলেও অর্থ পরিশোধ করা হয় না, ফলে সেটি এডিপি বাস্তবায়ন অংশে আসে না। আশা করছি আগামীতে বাস্তবায়ন হার আরও বাড়বে।
আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অর্থবছরের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এডিপি বাস্তবায়নের হার ১০ শতাংশের নিচে। এর মধ্যে রয়েছে শিল্প ও খাদ্য মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। এছাড়া পাঁচটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের বরাদ্দের ২০ শতাংশও ব্যয় করতে পারেনি। এর মধ্যে রয়েছে অর্থ বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) বাস্তবায়নে গতি না থাকায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল। এ পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত ১০ মন্ত্রণালয়সহ এডিপি বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন মন্ত্রী। বৈঠকে বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে সচিবরা অনুপস্থিত থাকায় অসন্তোষ ও হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, এডিপি বাস্তবায়নসংক্রান্ত মিটিংয়ের চেয়ে অন্য কোন মিটিং গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। ভবিষ্যতে এসব মিটিংয়ে উপস্থিত না থাকলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে (হায়ার অথরিটি) উচ্চ পর্যায়ে জানানো হবে বলে উপস্থিত কর্মকর্তাদের হুঁশিয়ার করেন তিনি। এছাড়া এডিপির বাস্তবায়ন বাড়াতে ফরওয়ার্ড প্লানিং করার তাগিদ দেন পরিকল্পনামন্ত্রী।