ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পরীক্ষা শুরুর আগেই পারস্পরিক যোগসাজশে শিক্ষার্থীদের হাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার গুরুতর অভিযোগ

বদলে যাচ্ছে ঢাকার বহু নামীদামী কলেজ স্কুলের পরীক্ষা কেন্দ্র

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বদলে যাচ্ছে ঢাকার বহু নামীদামী কলেজ স্কুলের পরীক্ষা কেন্দ্র

বিভাষ বাড়ৈ ॥ এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের যোগসাজশে প্রশ্ন ফাঁসসহ অব্যাহত অনিয়ম বন্ধে কেন্দ্র নির্ধারণে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। গত দুই-তিন বছরে পাবলিক পরীক্ষায় যেসব স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে পরীক্ষা শুরুর আগেই বান্ডিল খুলে প্রশ্নের উত্তর ঠিক করে পরীক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তাদের সকল কেন্দ্র রদবদল করা হয়েছে। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের তদন্তে যেসব প্রতিষ্ঠান সন্দেহের তালিকায় এসেছে তাদের কেন্দ্রও পরিবর্তন করা হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে যেসব প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্র একই স্থানে নির্ধারিত হয়ে আসছে পরিবর্তন করা হয়েছে তাদের কেন্দ্রও। আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষাতেই রাজধানী ও তার আশপাশে অবস্থিত প্রায় সকল নামী কলেজের পরীক্ষা কেন্দ্র বদলে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা কিছুটা কমতে শুরু করার পর এবার নতুন উদ্যোগে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বোর্ড কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ইতোমধ্যেই কেন্দ্র পরিবর্তন হওয়ায় সকল প্রতিষ্ঠানের নাম চূড়ান্ত করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পরীক্ষায় অনিয়ম বন্ধে কঠোর পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারির কারণে ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা কিছুটা কমতে শুরু করলেও এ সঙ্কট এবার নতুন মোড় নিয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসে সরাসরি জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে খোদ অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। যেখানে তাদের শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র পড়ছে সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরীক্ষা শুরুর দুই-তিন ঘণ্টা আগেই বান্ডিল খুলে প্রশ্নের উত্তর ঠিক করে পৌঁছে দিচ্ছেন পরীক্ষার্থীদের কাছে। দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অবৈধ বোঝাপড়ার ফলে পুরো পরীক্ষাই সঙ্কটের মুখে পড়ছে। গত এক বছরে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাতেই রাজধানীতে এমন ঘটনায় হাতেনাতে ধরা পড়েছেন বেশ কয়েটি নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। দুই প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে প্রশ্ন ফাঁসের বিনিয়মে লেনদেন হচ্ছে নগদ অর্থ, এক প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানকে ঘুষ হিসেবে দিচ্ছে জেনারেটর, এসিসহ নানা সুবিধা। প্রশ্ন ফাঁস ছাড়াও ব্যবহারিক পরীক্ষায় পূর্ণ নম্বর দেয়ার জন্যও হচ্ছে একই লেনদেন। এজন্য স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তাদের পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে এক হাজার থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত টাকাও হাতিয়ে নিচ্ছে বলে বারবার অভিযোগ আসছিল সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে। জানা গেছে, ঠিক এমন অবস্থায় আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষাতেই নামী দামী সকল প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্র পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ফলে কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট ভাঙ্গা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গত বছর যেসব কেন্দ্রে নামী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিয়েছে আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষায় সেখানে বসতে পারবে না। যেসব নামী প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্র পরিবর্তন করা হয়েছে তার মধ্যে আছেÑ রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, নটরডেম কলেজ, ভিকারুননিসা-নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ, সরকারী শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, মতিঝিল মডেল স্কুল ও কলেজ, দনিয়া কলেজ, সেন্ট জোসেফ স্কুল ও কলেজ। এ তালিকায় আরো আছেÑ শহীদ লে. আনোয়ার গার্লস কলেজ, ঢাকা ইম্পেরিয়াল কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজ, ন্যাশনাল আইডিয়াল কলেজ, ঢাকা কলেজ, বিএএফ শাহীন কলেজ, তেজগাঁও, মাইলস্টোন কলেজ, সামসুল হক খান স্কুল ও কলেজ, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, ক্যামব্রিয়ান কলেজ, শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ, ট্রাস্ট কলেজ, গুলশান কমার্স কলেজ, উত্তরা হাই স্কুল এ্যান্ড কলেজ, হামদর্দ পাবলিক কলেজ, নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল হাই স্কুল ও কলেজ, সরকারী বাঙলা কলেজ, ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক স্কুল ও কলেজ, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল এ্যান্ড কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ, সরকারী বিজ্ঞান কলেজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ পাবলিক স্কুল ও কলেজ, হলিক্রস কলেজ, ঢাকা কমার্স কলেজ, সরকারী কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারী মহিলা কলেজ। এর বাইরেও আছে রাজধানী ও আশপাশের আরও বেশকিছু কলেজের নাম। অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে কোন কেন্দ্রই রাখা হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক বছরে এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর পর রাজধানীতে এমন ঘটনায় হাতেনাতে ধরা পড়েছেন নামী দামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তত ১০ শিক্ষক-কর্মচারী। পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁস করে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়ার কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে গেছে রাজধানীর ডেমরার গোলাম মোস্তফা মডেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। এ প্রতিষ্ঠানের কেলেঙ্কারির ঘটনার পরই শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেন। টানা তিন বছর ধরে পাবলিক পরীক্ষায় একই অপকর্ম করে প্রতিষ্ঠানের পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তি প্রায় শতভাগ নিয়ে এসেছিল প্রতিষ্ঠানটি। তবে শেষ পর্যন্ত প্রমাণসহ ধরা খেয়েছেন গবর্নিং বডির সভাপতি, সদস্য, অধ্যক্ষসহ পুরো চক্র। গত বছর এইচএসসিতেও নির্দিষ্ট সময়ের তিন ঘণ্টা আগেই এখানে পরীক্ষা নেয়ার প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। পরীক্ষার দিন ভল্ট থেকে প্রশ্ন বের করে সকাল সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত পরীক্ষার্থীদের হলরুমে একত্র করে প্রশ্নের সমাধান করা হয়েছে। প্রমাণ মিলেছে নির্ধারিত সময়ের আগে পরীক্ষা নিয়ে ৬০ জনের মধ্যে ৫৯, অর্থাৎ ৯৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ শিক্ষার্থীই জিপিএ-৫ পেয়েছিল। শিক্ষাবিদদের পরামর্শ ॥ গত ১ ফেব্রুয়ারি প্রশ্ন ফাঁসের কোন বিতর্ক ছাড়াই সারাদেশে শুরু হয়েছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। বলা হচ্ছেÑ গত কয়েক বছরের মধ্যে এবারই কোন বিতর্ক ছাড়া নির্বিঘেœ পরীক্ষা হচ্ছে। তবে গত কয়েক বছর অব্যাহতভাবে নিয়োগ পরীক্ষা থেকে শুরু করে, মেডিক্যাল ভর্তি ও পাবলিক পরীক্ষায় সরকারের সাফল্যকে অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে ‘প্রশ্ন ফাঁস’। অনেকে হতাশা প্রকাশ করে বলছেন, ভবিষ্যতে মনে হয় পরীক্ষাই নেয়া যাবে না। কিন্তু এ অবস্থার সমাধানের পথ কী? জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শেখ একরামূল কবীর বলছিলেন, আসলে শিশুদের পরীক্ষা নিয়েও এখন একটি মহল ভুয়া প্রশ্ন ছেড়ে দিয়ে বাণিজ্য করে। তারপরও বিভিন্ন সময় কিছু পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় মানুষ আস্থা হারিয়েছে। এ আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে আস্থা হারিয়েছে বলে সকল পরীক্ষা নিয়েই গুজবে কান দেয়া ঠিক নয়। তিনি বলেন, আস্থা ফিরিয়ে আনতে পুরো প্রক্রিয়াকে মানুষের কাছে আরও স্বচ্ছ করতে হবে। একটি জাতীয় কমিটি করা যেতে পারে। যে কমিটি করলে মানুষ আরও আস্থা পাবে। তবে এ কমিটি কোন প্রশ্ন দেখতে পারবে না। তারা পরীক্ষা মনিটরিং করবে। পরীক্ষার কেন্দ্র পরিবর্তন ইতিবাচক ফল দেবে বলেও আশা করছেন এ শিক্ষাবিদ। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের উপাধ্যক্ষ সৈয়দ সাদিক জাহিদুল ইসলাম বলছিলেন, শিক্ষকদের প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত থাকার বিষয়টি খুবই উদ্বেগের। অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক বা অন্য শিক্ষকরা যদি আগেই প্রশ্নপত্রের বান্ডিল খুলে তাদের পরীক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয় তাহলে বুঝতে হবে আমাদের চিন্তাধারা কত নিচে নেমে গেছে। তবে আশার কথা, শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা এসব অপরাধের বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছেন। শক্ত অবস্থান নেয়ায় এবার পরীক্ষায় কোন প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা দেখা যায়নি।
×