ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ ডিজিটাল শিক্ষা শিশুর অধিকার

প্রকাশিত: ০৪:০১, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

একুশ শতক ॥ ডিজিটাল শিক্ষা শিশুর অধিকার

মুজিবুর রহমান স্বপন এখন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সহ-সভাপতি। ছয় বছর যাবত এক নাগাড়ে সমিতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমার সঙ্গেও সমিতিতে কাজ করেছেন চার বছর। এর বাইরে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা কম্পিউটার বাজার বিসিএস কম্পিউটার সিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি যে কেবল স্বপনকে ¯েœহ করি সেটাই নয়, স্বপন আমার কাছে অনেক দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন একজন মানুষ। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করত বলে মানুষের সঙ্গে কাজ করার ক্ষমতা অসাধারণ। কম্পিউটারের মেলা সাজাতে তার তুলনা বিরল। আমি যখন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি ছিলাম তখন সবার আগে স্বপনকে কম্পিউটার মেলার দায়িত্ব দিতাম। অবশ্য কম্পিউটারের মেলা করার জন্য আমার হাতে মানুষই ছিল তিন জন- স্বপন, শফিক ভাই ও সাইদ মুনীর। বিসিএস কম্পিউটার সিটিতেও মেলার আয়োজন করার কাজটা স্বপন অহরহ করে। কদিন আগে জানিয়েছিল যে, বিসিএস কম্পিউটার সিটিতে ১৮ জানুয়ারি ২০১৬ থেকে মেলা করবে। মেলার উদ্বোধন, অতিথি ও কর্মসূচীসমূহ নিয়ে কথা বলতে বলতে জানিয়েছিল, এবারের মেলায় সে শিশুদের গুরুত্ব দিতে চায়। তখন সে মেলার সেøাগান প্রস্তাব করেছিল, ‘কম্পিউটার দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করা শিশুর অধিকার।’ স্বপন জানে যে, মেলার সেøাগান নিয়ে আমার আগ্রহ বহুদিনের। ‘শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত কম্পিউটার চাই’ সেøাগান থেকে ‘একুশের স্বপ্ন ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সেøাগানগুলো আমারই দেয়া। আমি স্বপনের প্রস্তাব শুনে বললাম, তুমি কেবল ‘ডিজিটাল শিক্ষা শিশুর অধিকার’ এই সেøাগানটা দাও। ১৭ জানুয়ারি ১৬-এর পত্রিকায় ওদের সাংবাদিক সম্মেলনের খবর পড়ে আনন্দিত হয়েছিলাম এটি দেখে যে, স্বপন আমার দেয়া সেই সেøাগানটাকেই মেলার প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিল। ১৮ জানুয়ারি সেই মেলার উদ্বোধন হয়ে ২৪ জানুয়ারি সেই মেলার সমাপ্তিও ঘটেছে। মেলা শিশুদের কেন্দ্র করেই সাজানো হয়েছিল। আমি স্বপন ও বিসিএস কম্পিউটার সিটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সকলকে এমন একটি সেøাগান গ্রহণ করার জন্য অভিনন্দিত করি। তবে আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে পুরো কম্পিউটার মেলাটিকে আরও শিশুবান্ধব করা যেত। শিশুরা কিভাবে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতে পারে বা তাদের শিক্ষাকে কিভাবে ডিজিটাল করা যায় এবং কি ধরনের ডিভাইস তারা হাতে নিতে পারে কিংবা তাদের জন্য কি ধরনের সফটওয়্যার বা ডিজিটাল কনটেন্ট রয়েছে সেটা দেখানো যেত। শিশুদের ডিজিটাল শিক্ষার একটি জোন করা যেত। শিশুদের শিক্ষামূলক গেমের আয়োজন করা যেত। এমনকি শিশুদের প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাও করা যেত। আমি নিজে মনে করি অভিভাবক ও শিক্ষকদের নিয়ে ডিজিটাল শিক্ষার ওপর সেমিনার করা যেত। যাহোক, ভাবনাটিই প্রশংসার। আগামীতে ওপরের বিষয়গুলো ভেবে দেখা যেতে পারে। অনেকেই অবাক হতে পারেন যে, কম্পিউটার বিক্রি করে এমন একটি বাজারের মেলার সেøাগান শিশুদের নিয়ে কেন? সচরাচর আমরা বুঝি যে, শিশুরা চকোলেট কিনবে, খেলনা কিনবে বা শিশুদের জন্য ব্যবহার্য সামগ্রীর প্রতি তাদের আগ্রহ থাকবে। তাই শিশুদের প্রতি আগ্রহী হবেন সেই ব্যবসায়ীরা যারা মিল্কফুড, ডাইপার, বেবি লোশন, আইসক্রিম, চকোলেট বেচেন তারা। বাজারজাতকরণের সূত্র অনুসারে ব্যবসায়ীদের মেলায় এমন বিষয়কেই কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে রাখা উচিত যে বিষয়টির ক্রেতা বিরাজ করে। অন্যদিকে তাদেরই ক্রেতা হিসেবে গণ্য করা উচিত যাদের কেনার জন্য আর্থিক ক্ষমতা আছে বা যারা কেনার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আমাদের বেশিরভাগ মানুষের ধারণা, কম্পিউটার তো এখনও শিশুদের প্রিয় বস্তু নয় কিংবা তাদের হাতে কেনার টাকাও নেই বা তারা কম্পিউটার কেনার সিদ্ধান্তও নিতে পারে না। সেই অবস্থাতে কম্পিউটারের মেলার বিষয় হিসেবে শিশুদের কথা ভাবা কি সঠিক হলো? আমি মনে করি, শিশুদের বিষয়টি আমরা বহুদিন ধরে অবহেলা করে আসছি। এমনকি কম্পিউটারকে শিক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কথাই আমরা ভাবিনি। প্রথাগতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প-কলকারখানা কম্পিউটার ব্যবসায়ীদের ভাবনার কেন্দ্রে রয়েছে। কোন কোন সময় সরকারের কথাও ভাবা হয়। কিন্তু দেশের চার কোটি ছাত্র-ছাত্রীর কথা মোটেই ভাবা হয় না। আমি মনে করি, শিশু তো বটেই সামগ্রিকভাবে শিক্ষাখাত আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কেন্দ্রতেই বিবেচিত হতে পারে। আমি মনে করি, এটি কম্পিউটার খাতের সবচেয়ে বড় হার্ডওয়্যার বাজার। শিক্ষার ডিজিটাল কনটেন্টও হতে পারে বিশাল একটি ক্ষেত্র। এর কারণটি হচ্ছে বাংলাদেশে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি এবং শিশুদের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। ওরা এখন বই-খাতা-কলম দিয়ে পড়াশোনা করে। বড়দের কেউ কেউ ল্যাপটপ জাতীয় যন্ত্র ব্যবহার করে। ওদের হাতে নিজেদের স্মার্ট ফোনও থাকে। কিন্তু শিশুরা না হতে পারে কম্পিউটারের মালিক না হতে পারে স্মার্ট ফোনের অধিকারী। ওদের হাতে বাবা-মার স্মার্ট ফোনটা হয়তো কখনও খেলনা হিসেবে পৌঁছে এবং তারা তাতে গেম খেলে আনন্দ পায়। এই শিশুদের হাতে যদি ডিজিটাল ডিভাইস হিসেবে কম্পিউটার দেয়া যায় তবে সেই সংখ্যাটি হবে দুই কোটি। বিষয়টি এখানেও থামবে না। প্রতিবছর নতুন শিশুর জন্ম হচ্ছে এবং কেবল প্রাথমিক স্তরে প্রতিবছর অন্তত ২৫ লাখ নতুন শিশু যোগ দেয়। দুই কোটি বিদ্যমান শিশুর সঙ্গে যদি প্রতিবছরের ২৫ লাখকে যোগ করা যায় তবে আমরা বুঝতে সক্ষম হব যে মুজিবুর রহমান স্বপন অত্যন্ত দূরদর্শী একটি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। তবে প্রশ্ন হচ্ছে যে, শিশুদের হাতে কম্পিউটার নামক ডিজিটাল যন্ত্র কিভাবে পৌঁছানো যাবে। এরই মাঝে আমরা সরকারকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা স্তরে কম্পিউটার ল্যাব গড়ে তুলতে দেখছি। আমাদের সরকার ও নীতি নির্ধারকরা মনে করেন যে, কম্পিউটার শেখা এবং কম্পিউটার দিয়ে শেখার জন্য ডিজিটাল ক্লাসরুম গড়ে তোলাটা কেবল তরুণ-তরুণীদের বা যুবাদের জন্যই হওয়া উচিত। যদিও কোন কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এরই মাঝে একটি করে ল্যাপটপ বা কোথাও একটি ল্যাপটপ-একটি প্রজেক্টর দেয়া হয়েছে তথাপি শিশুদের কথা, তাদের ক্লাসরুম বা শিক্ষকের কথা মোটেই ভাবা হয়নি। সমাজের সকল স্তরেই তাই শিশুরা বড়দের নজরে পড়ে না। ওদের প্রয়োজন কেউ বোঝে না- ওদের আনন্দ কি সেটাও তারা অনুভব করে না। বরাবরই ওদেরকে গেম খেলতে বাধা দেয়া হয়- বরাবরই ওদেরকে ইন্টারনেট স্পর্শ করতে দেয়া হয় না। ওরা যখন টিভিতে কার্টুন দেখতে চায় তখন তাদের হাতের রিমোটটা কেড়ে নেয়া হয়। বাংলাদেশের প্রধান কোন টিভি চ্যানেল শিশুদের জন্য কোন অনুষ্ঠানও করে না। কোন কোন সময়ে শিশুদের নাচ-গানের অনুষ্ঠান হয় কিন্তু সেইসব তাদের প্রিয় কিনা সেটি তারা বিবেচনা করে না। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি যে এই শিশুদের অধিকার হচ্ছে নিজের হাতে একটি ডিজিটাল ডিভাইস পাওয়া। আমার এই ভাবনাটি অনেক আগের। আমি ৮৭ সালে এ্যাপল কম্পিউটারকে শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে দেখেছি। তারা ক্লাসরুমে কম্পিউটার নিয়ে গেছে। তারা সেই সত্তর দশকে শিক্ষামূলক ইন্টারএ্যাকটিভ সফটওয়্যার বানিয়েছে। এমনকি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কম্পিউটারের দাম কম রেখেছে। মালয়েশিয়ার স্মার্ট স্কুল দেখেছি। সেখানে ছেলেমেয়েরা বই নিয়ে ক্লাসে যায় না। আমি ডেনমার্কের স্কুলের জন্য সফটওয়্যার বানিয়েছি। ওরা আমাদের সফটওয়্যার দিয়ে ডেনিস ভাষা শেখে। আমি ৯৭ সালে আমেরিকা থেকে সফটওয়্যার এনে নিজের ছেলেকে পড়িয়েছি। সেই ভাবনা থেকেই ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর গাজীপুরের ছায়াবীথিতে আমি একটি স্কুল গড়ে তুলি। গাজীপুরের আজিমউদ্দিন কলেজের শিক্ষক মজিবুর রহমানের পরিচালনায় স্কুলটির উদ্বোধন করেন ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ও তার স্ত্রী সেলিনা মল্লিক। সেখানেই আমরা বাংলাদেশের শিশুদের জন্য প্রথম কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করি এবং তাদের ক্লাসরুমে কম্পিউটার নিয়ে গিয়ে কম্পিউটার দিয়ে লেখাপড়া করানো শুরু করি। তবে যে সমস্যাটি তখন তীব্র হয় সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের পাঠ্য বিষয় নিয়ে বাংলায় তৈরি ডিজিটাল কনটেন্ট পাওয়া যায়নি। আমার নিজের পরিচালনায় ৩২টি মাল্টিমিডিয়া সেন্টার থেকে এ ধরনের কনটেন্ট তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েও গুণগতমান ভাল না হওয়ায় সুবিধা করতে পারছিলাম না। অবশেষে ২০০৯ থেকে বিজয় ডিজিটালের প্রধান নির্বাহী জেসমিন জুঁই ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর ২০১১ সালে প্রথম বিজয় শিশু শিক্ষা আত্মপ্রকাশ করে এবং এরপর থেকে অবিরাম কাজ করতে করতে আমরা ২০১৬ সাল নাগাদ প্রাক প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত সফটওয়্যার তৈরি করতে সক্ষম হই। জেসমিন ও তার বাহিনীকে এজন্য অভিনন্দন। ওরা আমার স্বপ্নটাকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে এসেছে। বস্তুত, ২০১১ সাল থেকেই এদেশের শিশুরা কম্পিউটার দিয়ে লেখাপড়া করার জগতে দারুণভাবে প্রবেশ করে। অনেকেই ব্যক্তিগত কম্পিউটারে আমাদের সফটওয়্যারগুলো ইনস্টটল করে শিশুদের তাদের শিক্ষা গ্রহণে সহায়তা করতে থাকেন। এরই মাঝে সরকারের এটুআই টিচার লেড কনটেন্ট নামক এক ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। সরকারের আইসিটি ডিভিশন বিনা টেন্ডারে ব্র্যাক নামক একটি এনজিওকে দিয়ে প্রাথমিকের সফটওয়্যার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও ব্র্যাককে দিয়ে একইভাবে বিনা টেন্ডারে ষষ্ঠ শ্রেণীর ডিজিটাল কনটেন্ট বানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সাবেক শিক্ষা সচিব এন আই খান এক সময়ে ষষ্ঠ শ্রেণীর সকল ছাত্র-ছাত্রীকে ২৫ লাখ ট্যাব দেবেন বলেও ঘোষণা করেছিলেন। তবে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের কোন ফল আমরা এখনও দেখতে পাইনি। কবে এর ফল জাতি নিতে পারবে সেটিও জানিনা। এসব কাজের কোনটাই আলোর মুখ দেখার আগে আমরা একটি সাহসী উদ্যোগ নিতে সক্ষম হই। নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার আরবান একাডেমির প্রথম শ্রেণীর ৪০টি শিশুর হাতে আমরা ৮ ইঞ্চির একটি ডিজিটাল ডিভাইস দিতে সক্ষম হই। মাত্র নয় হাজার টাকায় অরিজিনাল উইন্ডোজসহ এই ডিভাইসটিতে দেয়া হয় বিজয়-এর সকল শিক্ষামূলক সফটওয়্যার। ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫ এই ক্লাসরুমটির উদ্বোধন করেন নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক তরুণ কান্তি শিকদার। সেদিনের ফিতা কাটার ক্ষণটিতে আমি, জেসমিন, পরমাসহ স্থানীয় বিশিষ্টজনরাও ছিলাম। এরপর আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল গৌরীপুরের শিশু শ্রেণীর সকলকে এই ডিজিটাল ডিভাইস প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর বাইরেও অন্তত ২৫টি স্কুলে এই ডিভাইস পরীক্ষামূলকভাবে প্রদান করা হয়। আমি প্রত্যাশা করছি সরকারের টেলিকম বিভাগ সহসাই দেশের ২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সকল ছাত্র-ছাত্রীর হাতে এ ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস দেবার জন্য একটি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এরই মাঝে রবি নামক মোবাইল অপারেটরটি গোপালগঞ্জের একটি স্কুলের একটি শ্রেণীকে ডিজিটাল করার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রসঙ্গটি জাতীয় মিডিয়ারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৮ জানুয়ারি ১৬ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ছাপা হয় একটি খবর। এর শিরোনাম ছিল, ‘পুরোপুরি ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশু আনন্দের সঙ্গেই শিখতে পারে।’ খবরটিতে এ্যাপল কম্পিউটার থেকে আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল গড়ে তোলা এবং নিজস্ব ইন্টারএ্যাকটিভ মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার তৈরির বিবরণ দেবার পর নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলার আরবান স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের অভিজ্ঞতার বিবরণও প্রদান করা হয়। এতে বলা হয়, “নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার আরবান একাডেমির অধ্যক্ষ সৈয়দ আরিফুজ্জামানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিদ্যালয়টির ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথমে বিজয় শিশুশিক্ষার প্রাক্-বিদ্যালয় বিষয়বস্তুগুলো শ্রেণীকক্ষে বড় পর্দায় দেখানো শুরু করি। এতে বেশ ভাল ফল পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীরা আগ্রহের সঙ্গে পড়াশোনা করে।’ এরপর তিনি ভেবে দেখেন, যদি প্রতিটি শিশুর হাতে তা পৌঁছে দেয়া যায়, তবে আরও ভাল হয়। এর মধ্যে বিজয় শিশুশিক্ষা দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা উপকরণ তৈরি করে ফেলে। এগিয়ে আসে বেসরকারী সংস্থা ডিনেট। ওদিকে মোস্তাফা জব্বার সরকারী-বেসরকারী সব পর্যায়ে চেষ্টা চালিয়ে যান স্বল্পমূল্যে ট্যাবলেট কম্পিউটারের খোঁজে। অবশেষে সব ব্যবস্থা হয়ে গেলে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর আরবান একাডেমির প্রথম শ্রেণীতে পড়ুয়া ৪০ শিক্ষার্থীর হাতে কি-বোর্ডসহ ট্যাবলেট কম্পিউটার তুলে দেয়া হয়। ‘স্বদেশ’ নামের এই ট্যাবলেট কম্পিউটার বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে শিশুদের পাঠদানের উপযোগী করে। প্রতিটি ট্যাবলেটে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রথম শ্রেণীর সিলেবাস অনুসরণ করে তৈরি করা বিজয় প্রাথমিক শিক্ষা-১ সফটওয়্যার ইনস্টল করা আছে। উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে চলা এসব কম্পিউটার ও ডিজিটাল শ্রেণীকক্ষের কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে বিজয় ডিজিটাল। সৈয়দ আরিফুজ্জামান ২০১৮ সালের মধ্যে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর হাতে এই ট্যাবলেট কম্পিউটার পৌঁছে দেয়ার আশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘খুব দ্রুত এই শিক্ষার্থীরা ট্যাবলেট কম্পিউটারের ব্যবহার আয়ত্ত করে ফেলেছে। শিখছেও দ্রুত। এই মাধ্যমে শিক্ষা খুব কার্যকর হচ্ছে।’ আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রে যে বিপ্লবের সূচনা হয়েছে, আমাদের দেশে তা হচ্ছে এতদিন পর। তবু তো চাকা গড়াল। সে জন্যও উদ্যোক্তারা একটা ধন্যবাদ তো পেতেই পারেন। তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে একদিন জ্যোতির্ময় বাংলাদেশ গড়ে উঠবে এমনটাই সবার প্রত্যাশা। কেবল পূর্বধলার অভিজ্ঞতাই নয়, আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল, গৌরীপুর, ই-বর্ণমালা স্কুল নোয়াপাড়া যশোর, ইংলিশ ভার্সন স্কুল মিরপুরসহ অন্তত শ’খানেক স্কুলে বিজয়-এর সফটওয়্যারসহ মিনি ল্যাপটপ পৌঁছেছে। কেউ কেউ ছাত্র-ছাত্রীদের হাতেও এই মিনি ল্যাপটপ পৌঁছে দিয়েছেন। কেউ কেউ ক্লাসরুমটাকে ডিজিটাল করেছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে আমি পূর্বধলার স্কুলটির খবর নিই। আরিফ জানান যে, এখন স্কুলের সকল ছাত্র-ছাত্রী প্রথম শ্রেণীর দরোজা আর বারান্দায় ভিড় করে। কদিন আগে বৃষ্টির সময় প্রথম শ্রেণীতে ৩৯ জনের ৩৭ জন উপস্থিত ছিল-আর অন্য ক্লাসে ছিল ১/২ জন। ডিজিটাল ডিভাইসটি এরই মাঝে শিশুদের প্রাণের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ২৪ জানুয়ারি ১৬ শেষ হওয়া বিসিএস কম্পিউটার সিটির মেলার বিষয়টিও আমরা উল্লেখ করতে পারি। এবারের মেলায় বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রজেক্টর, ল্যাপটপ ও মিনি ল্যাপটপ সংগ্রহ করেছেন। শিক্ষাকে ডিজিটাল করার যে সেøাগানটি এই মার্কেটের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করেছিলেন তারা নিজেরাই মনে করেন যে, সেটি যথার্থ ও সঠিক হয়েছে। এটি আজ সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত যে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষা পাওয়াটি সত্যিকার অর্থেই শিশুদের মৌলিক অধিকার। আমি মনে করি, শত বছরের প্রাচীন ধারার শিক্ষা শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেয়া একটি নিবর্তনমূলক অপরাধ। ঢাকা, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ [email protected] w.bijoyekushe.net, www.bijoydigital.com
×