ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বকাপের প্রথম সেমিতে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বিশ্বকাপের প্রথম সেমিতে বাংলাদেশ

মিথুন আশরাফ ॥ ‘এই দলটি শুরু থেকেই দারুণভাবে আত্মবিশ্বাসী। এদের মধ্যে মেধাবী কয়েকজন রয়েছে যারা ভবিষ্যত তারকা হতে পারে। সবকিছু মিলিয়েই বাংলাদেশ অনুর্ধ ১৯ দারুণ একটি দল।’ শুক্রবার সুপার লীগের কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ-নেপাল ম্যাচের সময় খানিক সময় ধারাভাষ্য দিতে এসে এমন কথাগুলো বলেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের কোচ চন্দ্রিকা হাতুরাসিংহে। তার কথার প্রমাণ হাতে নাতেই মিলে গেছে। নেপাল যুব দলকে ৬ উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো যুব ক্রিকেট বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলা নিশ্চিত করে নিয়েছে বাংলাদেশ যুব দল। ইতিহাস গড়েছে। বিশ্বকাপের কোন আসরে এই প্রথম বাংলাদেশের কোন দল সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করল। তা করে দেখাল মিরাজবাহিনী। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচে টস জিতে নেপাল। আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয়। অধিনায়ক রাজু রিজালের ৭২ রানে ৫০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে ২১১ রান করে নেপাল। মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন ২ উইকেট নেন। জবাবে ৪ উইকেট হারিয়ে জাকির হাসানের অপরাজিত ৭৫ ও মেহেদী হাসান মিরাজের অপরাজিত ৫৫ রানে ৪৮.২ ওভারে ২১৫ রান করে জিতে বাংলাদেশ। মেহেদী হাসান মিরাজ ও জাকির হাসান মিলে ১১৭ রানের জুটি গড়ে দলকে সেমিফাইনালে তোলেন। নেপালের গড়া স্কোর অতিক্রম করতে গিয়ে ১৭ রানেই প্রথম উইকেটের পতন ঘটে যায়। ওপেনার সাইফ হাসান (৫) আবারও ব্যর্থ হন। ওপেনার নিয়ে যে দুর্ভাবনা করা হয়, সেটি এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেও বজায় থাকে। এরপর পিনাক ঘোষ ও জয়রাজ শেখ মিলে দলকে ৬৩ রানে নিয়ে যান। এ মুহূর্তে ভুল বোঝাবোঝিতে পিনাক (৩২) রান আউট হয়ে যান। বাংলাদেশ খানিক বিপদে পড়ে যায়। প্রতি ম্যাচেই এমনটি দেখা গেছে, দ্রুত বাংলাদেশের উইকেট পড়ে যায়। এরপর গিয়ে মাঝের এক-দুই ব্যাটসম্যান উইকেট আঁকড়ে থাকেন। শেষ পর্যন্ত জয় মিলে বাংলাদেশের। শুক্রবার শান্ত (৮) কিছুই করতে পারেননি। তবে ৯৮ রানে জয়রাজ আউট হওয়ার আগে দলের স্কোরবোর্ডে ৩৮ রান যোগ করে যান। ২৯ ওভারে গিয়ে বাংলাদেশের স্কোর বোর্ডে ৯৮ রান যোগ হয়। তখন খানিকটা ভয়ও ধরে যায়। জিততে পারবে তো বাংলাদেশ? এরপর যে জাকির হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজ খেলা শুরু করেন, ম্যাচ জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন। ৪৮ বলে জিততে তখন ৫৭ রানের দরকার থাকে, এমন সময় থেকেই মিরাজ-জাকির যেন আরও বিধ্বংসী হয়ে ওঠেন। ৪৪ ওভারে গিয়ে এক ওভারেই ১২ রান স্কোরবোর্ডে যোগ হয়। সেখানেই বাংলাদেশ ম্যাচে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। জিততে তখন ৩৬ বলে ৩৭ রানের প্রয়োজন থাকে। জাকির অর্ধশতক করে ফেলেন। কিছুক্ষণ পর মিরাজও অর্ধশতক পূরণ করেন। ১৮ বলে গিয়ে যখন ১৭ রানের প্রয়োজন, এমন সময় দুইজন মিলে ১০০ রানের জুটিও গড়ে ফেলেন। ১২ বলে যখন জিততে ৭ রানের প্রয়োজন, ৪৮.১ ওভারে চার ও ৪৮.২ ওভারে ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচ জিতিয়ে দেন ৭৭ বলে ৫ চার ও ১ ছক্কায় অপরাজিত ৭৫ রান করা জাকির। আর গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলের হাল ধরে ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলে (অপরাজিত ৫৫ রান) ম্যাচ সেরাই হয়ে যান অধিনায়ক মিরাজ। তার হাত ধরে ইতিহাসও গড়া হয়ে যায়। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের আসরে বাংলাদেশ সেমিফাইনালে খেলবে। এর আগে শুরুতেই ১৯ রানে নেপালের ২ উইকেট তুলে নিলে দিনটি ভাল হওয়ার ইঙ্গিত মিলে। কিন্তু এরপর থেকেই যেন নেপাল ঘুরে দাঁড়ায়। তৃতীয় উইকেটে ওপেনার সুনীল ধামালা ও রিজাল মিলে ৪৪ রানের জুটি গড়েন। এ জুটিতেই যেন নেপাল এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা খুঁজে পায়। চতুর্থ উইকেটে গিয়ে রিজালের সঙ্গে আরিফ শেখ আরেকটি বড় জুটি (৫১ রানের জুটি) গড়েন। এ জুটিটিই খাদের কিনারায় পড়ে থাকা নেপালকে পুরোপুরি টেনে তোলে। যে রিজালের বয়স নিয়ে এত কথা, সেই রিজালই ঝলক দেখিয়ে দেন। কোয়ার্টার ফাইনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে রিজালের ব্যাটে ভর দিয়েই বহুদূর এগিয়ে যায় নেপাল। সেঞ্চুরির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন এ ব্যাটসম্যান। যেই ৭২ রান হয়, রিজাল রানআউট হয়ে যান। রানআউট থেকেও বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এক রান নিতে যান রিজাল। নাজমুল হোসেন শান্ত বলটি পেয়ে উইকেট বরাবর মারেন। উইকেটরক্ষক জাকির হাসান বলটি ধরে উইকেটে লাগানোর আগেই হাত লেগে বেলস পড়ে যায়। কিন্তু বুদ্ধিমানের কাজটি করেন জাকির। সঙ্গে সঙ্গে উইকেটই উপরে ফেলেন। তা না হলে নিয়ম অনুযায়ী আউট হতো না। আগে হাত লেগে বেলস পড়লে, পরে শুধু বল হাতে নিয়ে উইকেটের বেলস ফেললে রানআউট হয় না। উইকেট উপড়ে ফেলতে হয়। জাকির সেই কাজটি করলেন এবং রিজাল ৮০ বলে ৮ চার ও ১ ছক্কায় ৭২ রান করে আউট হয়ে যান। যেন বাংলাদেশ যুবারাও একটু নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু সেই নিঃশ্বাস আর ঠিকমতো ফেলা গেল কোথায়। ১৪৬ রানে রিজাল আউট হলেও এরপর দিপেন্দ্র সিং আইরি (২২), কুশাল ভুরটেল (১৪) ও প্রেম তামাং (২২*) এর ব্যাটিংয়ে ২১১ রান করে ফেলে নেপাল। যে বাংলাদেশের বোলাররা গ্রুপ পর্বে দুর্দান্ত বোলিং করেন, তারাই এদিন খানিক নিষ্প্রভ হয়ে যান। তবে শেষপর্যন্ত নেপালের এতেও কাজ হয়নি। ১০ বল বাকি থাকতেই জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ। ১৯৮৮ সাল থেকে যুব বিশ্বকাপ হয়। এর আগে যুব বিশ্বকাপের ১০ আসর অনুষ্ঠিত হয়। এবারেরটি ১১তম আসর। প্রথম আসর বাদ দিয়ে ৯ আসরেই টানা অংশ নেয় বাংলাদেশ। তিনবার গ্রুপ পর্ব অতিক্রম করে সুপার লীগের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলে আর চারবার প্লেট চ্যাম্পিয়ন (নবম স্থান) হয়। ২০০৬, ২০০৮ ও ২০১২ সালে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলে। আর ১৯৯৮, ২০০৪, ২০১০ ও ২০১৪ সালে প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। প্রথম আসরে বাংলাদেশ খেলেনি। তবে আইসিসি এ্যাসোসিয়েটস নামে যে একটি দল খেলে সেই দলে বাংলাদেশ থেকে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক, প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও সাবেক ক্রিকেটার হারুনুর রশিদ লিটন ছিলেন। এরপর ১০ বছর পর ১৯৯৮ সালে যুব বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসর অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ এবার অংশ নেয়। বাংলাদেশ গ্রুপ পর্বের গ-ি অতিক্রম করতে না পারলেও প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০০০ সালে তৃতীয় আসরেও সুপার লীগে খেলতে পারেনি বাংলাদেশ। ২০০২ সালেও একই অবস্থা হয়। এবার প্লেট চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে নেপালের কাছে হারে বাংলাদেশ। ২০০৪ সালে আবার প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ২০০৬ সালে বর্তমান জাতীয় দলের টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো সুপার লীগের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলে বাংলাদেশ যুবদল। এই দলটি এবারের বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত সেরা দল ছিল। যে দলে মুশফিক, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল খেলেন। এখন তিনজনই জাতীয় দলের কা-ারি। ২০০৮ সালেও কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে বাংলাদেশ। ২০১০ সালে আবার গ্রুপ পর্ব অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়। তবে এবারও প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ২০১২ সালে আবারও কোয়ার্টার ফাইনালে খেলে বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে আবারও ব্যর্থ হয়। তবে এবারও প্লেট চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। এবার ১১তম আসরে এসে নিজেদের দশম আসরে সেমিফাইনালে উঠে ইতিহাসই গড়ে ফেলে বাংলাদেশ।
×